বিমাসূত্রে ধনাগম হতে পারে। প্রেম-প্রণয়ে আনন্দ। কাজকর্মে অগ্রগতি ও সুনাম। ... বিশদ
ভারত তো বটেই, বিশ্বের ইতিহাসে ২০০৭ সাল একটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ বছর। নিউ ইয়র্ক টাইমসের সাংবাদিক টমাস ফ্রিডম্যান বিশ্লেষণ করেছিলেন কীভাবে ২০০৭ সাল আধুনিক পৃথিবীকে সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছে। ২০০৭ সালে মার্ক জুকেরবার্গ তাঁর একটি স্থানীয় অনলাইন প্রোডাক্ট প্ল্যাটফর্মকে প্রথমবার গ্লোবালি লঞ্চ করেছিলেন অর্থাৎ গোটা বিশ্বের জন্য খুলে দিয়েছিলেন। প্রোডাক্টের নাম ফেসবুক। ২০০৭ সালে মাত্র এক বছর পুরনো একটি মাইক্রোব্লগিং সংস্থার মালিক জ্যাক ডরসি স্থির করেছিলেন, এই ব্লগটির ভোলবদল করে এক অন্যরকম অনলাইন মিডিয়ার জন্ম দেবেন। সেই প্রোডাক্টের নাম ট্যুইটার। ২০০৭ সালে গুগল সংস্থা একটি ছোট ভিডিও কোম্পানিকে কিনে নেয় তাদের ব্যবসা বাড়াতে। সেই ভিডিও সংস্থার নাম ইউটিউব। পাবলিক ক্লাউড নামক একটি প্রযুক্তি অনেক বেশি করে জনপ্রিয় হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেওয়ার পর ১৯৯৪ সালে তৈরি হওয়া একটি অনলাইন ব্যবসার সংস্থা নিজেকে বদলে বিশ্বের জন্য ২০০৭ সালে দরজা খুলে দিল। সেই সংস্থার নাম অ্যামাজন। ২০০৭ সালে আইবিএম একটি বিশেষ প্রোজেক্ট শুরু করেছিল। তার নাম ওয়াটসন। যা আজকের আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের বিজনেস মডেলের পথিকৃৎ। ২০০৬ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার কুপেরটিনোয় নিজের ছেলের সঙ্গে টিভিতে খেলা দেখার ফাঁকে বাড়িতে আসা বন্ধুকে এক ভদ্রলোক জিনসের আপার পকেট থেকে একটি মোবাইল ফোন বের করে বলেছিলেন, এটা হবে আগামীদিনের সবথেকে বড় বিপ্লব। ঠিক কয়েকমাস পর ২০০৭ সালে সেই ফোন অফিসিয়ালি প্রকাশ করা হয়েছিল। ভদ্রলোকের নাম ছিল স্টিভ জোবস। প্রোডাক্টের নাম আই ফোন। ২০০৭ সালে গুগল একটি বিশেষ অপারেটিং সিস্টেম শুরু করেছিল। তার নাম অ্যান্ড্রয়েড। সান ফ্র্যান্সিসকোয় থাকা খাওয়ার ব্যয় অনেক বেশি। বাড়তি ইনকাম দরকার। তাই দুই বন্ধু ব্রায়ান চেস্কি এবং এবং জো গেবিয়া নিজেদের অ্যাপার্টমেন্টের লিভিং রুমে একটি এয়ারম্যাট্রেস বিছিয়ে ভাড়া দেওয়া শুরু করেছিল। থাকা এবং ব্রেকফাস্ট। যাকে বলা হয়, ব্রেড অ্যান্ড ব্রেকফাস্ট। ছাত্রছাত্রীদের জন্য। ২০০৭ সালে সেই লিভিং রুম থেকে একটি হোটেল বুকিং ব্যবসা শুরু করেছিল। কোম্পানির নাম এয়ার বিএনবি। যা আজ গোটা বিশ্বের এক নম্বর অনলাইন হোটেল বুকিং সংস্থায় পরিণত।
এই কথাগুলি বলার অর্থ হল, আজ আমরা ভারতীয়রা সম্পূর্ণভাবে সারাদিন সারারাত এই প্রতিটি প্রোডাক্টের উপর নির্ভরশীল। সবথেকে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, এই প্রতিটি কোম্পানিই আমেরিকান। গোটা বিশ্বের মধ্যে এই প্রতিটি কোম্পানির সবথেকে বেশি ইউজার ও কাস্টমারের সংখ্যা ভারতে। আজকাল আমাদের আলোচনায় উঠে আসে শেষ কোন ওয়েব সিরিজ দেখলাম। কোনটা দুর্দান্ত? কোনটা খারাপ? কিন্তু কোথায় দেখলাম? হয় অ্যামাজন প্রাইম অথবা নেটফ্লিক্স। দুটিই আমেরিকান।
আমাদের ভোকাবুলারি অর্থাৎ শব্দভাণ্ডার, আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের শিক্ষাগ্রহণ পদ্ধতি, আমাদের জ্ঞান অর্জনের প্রক্রিয়া, আমাদের মাইন্ডসেট, থট প্রসেস সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছে ১৯৯৮ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির দুই পিএইচডি ছাত্র ল্যারি পেজ এবং স্যার্জি ব্রিইন। তাঁরা তৈরি করেছিলেন একটি সার্চ ইঞ্জিন। তার নাম গুগল। অ্যালফাবেট আইএনসি এখন গোটা গুগল সাম্রাজ্যকে কন্ট্রোল করে। মোবাইল আছে, তাই আমাদের কারও আজকাল কোনও ফোন নম্বর মনে নেই। মোবাইল হারিয়ে গেলে কী হবে? গুগল ক্লাউডে রাখা আছে। আমাদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের ডিটেইলস কে জানে? গুগল পে। আমাদের গোপন ইমেলের আদানপ্রদান, চাকরি থেকে বিজনেস, প্রতিটি ব্যক্তিগত বার্তা কার কাছে গচ্ছিত থাকে? জি-মেলের কাছে।
সোশ্যাল মিডিয়ার প্ল্যাটফর্মে সবথেকে বেশি যে টপিক অথবা কনটেন্ট বেশিবার আলোচিত হয়, কমেন্ট পড়ে এবং ইউটিউব হিট হয়, সেটি হল রাজনীতি, জাতপাত, ধর্মীয় বিভাজন এবং বর্ণবিদ্বেষের কনটেন্ট। অর্থাৎ ঘৃণামূলক বিষয় যদি পোস্ট করা হয়, তাহলে সেগুলিতে অনেক বেশি লাইক, কমেন্ট, প্রতিবাদ, ঝগড়া হয়। একটি পোস্টে যত বেশি এরকম লাইক কমেন্ট শেয়ার হয় সেটির ভিউয়ারশিপ বেড়ে যায়। যত ভিউয়ারশিপ বাড়ে তত বেশি অ্যাডভার্টাইজমেন্ট জেনারেট হয়। অর্থাৎ সোশ্যাল মিডিয়ার সবথেকে বেশি প্রফিট হল হেট বিজনেস। যে কোনও প্রকার হেট অথবা বিদ্বেষমূলক আলোচনায় ওইসব কোম্পানির লাভ। কারা ঝগড়া করে? আমরা। সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মের লক্ষ্যই হল মানুষের প্যাশন, আবেগ, রাগ, প্রতিবাদ, ক্ষোভ, ভালোবাসার প্রকাশগুলি নিয়ে বিজনেস করা। আমরা সাধারণত আমাদের যত কিছু মনের কথা চারটি প্ল্যাটফর্মে বলে থাকি। ফেসবুক, ট্যুইটার, হোয়াটস অ্যাপ আর ইনস্টাগ্রাম। এই চারটি কোম্পানিই গোটা দুনিয়ার সিংহভাগ দেশের মানুষের মন পরিচালনা করছে। সকলের মনোভাবও জেনে যাচ্ছে। চারটি কোম্পানির মালিক দুজন। জ্যাক ডরসি এবং মার্ক জুকেরবার্গ। অর্থাৎ দুটি মানুষ সিংহভাগ বিশ্ববাসীর আবেগের বিস্ফোরণ নিয়ে বিজনেস করছেন। সম্প্রতি ফেসবুক জিওর শেয়ার ক্রয় করেছে। জিও এবং ফেসবুক একটি গ্রসারি বিজনেস মডেল করছে। মুদিখানার দ্রব্যের হোম ডেলিভারি। সঙ্গে সঙ্গে তৎপর হয়ে উঠেছে অ্যামাজন। তারা এখন চেষ্টা করছে এয়ারটেলের ৫ শতাংশ শেয়ার কিনে ভারতের টেলি বিজনেস ফর্মুলায় হোম ডেলিভারিতে প্রবেশ করতে। ইতিমধ্যেই ওয়ালমার্ট ভারতীয় সংস্থা ফ্লিপকার্টে ইনভেস্ট করেছে। সুতরাং আগামীদিনে ভারতের ই কমার্স বাজার চালাবে তিনটি আমেরিকান সংস্থা। ফেসবুক, অ্যামাজন, ওয়ালমার্ট।
দু’ হাজারের বেশি আমেরিকান কোম্পানি ভারতে ব্যবসা করে। ভারতের প্রযুক্তি, কয়লা, কৃষি, অটোমোবাইল, যন্ত্রাংশ, ফিনান্স আর ব্যাঙ্কিং—এই সেক্টরগুলি আমেরিকান সংস্থাই একপ্রকার শাসন করে। এটা স্বাভাবিক। এবং গ্লোবালাইজেশনের যুগে কাম্য। পক্ষান্তরে ভারত আর একটি দিকে পিছিয়ে নেই। আউটসোর্সিং এবং সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্টে ভারত আমেরিকার একমাত্র ভরসা। প্রতিদিন ভারতীয় নারী আমেরিকার বিভিন্ন শহরে ফোন করে তুখোড় আমেরিকান অ্যাকসেন্টে জানতে চায়, মাই নেম ইজ ফ্লিচ...আপনার সোশ্যাল সিকিউরিটি নম্বরের লাস্ট চার ডিজিট বলুন। অথবা কাস্টমার কেয়ার হিসেবে বলে, আমাদের ব্রাঞ্চ আছে লেক্সিংটনে সেকেন্ড অ্যাভিনিউর সেভেনথ ফ্লোরে। সাধারণ আমেরিকানদের কতজন জানে এই গোটা অ্যাসিস্ট্যান্স তিনি আসলে পাচ্ছেন সাত সমুদ্র তেরো নদী দূরের বেঙ্গালুরু অথবা নয়ডার মিডল ক্লাস একটি মেয়ের থেকে? আমেরিকার প্রথম সারির কোম্পানিগুলির গ্লোবাল চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার কারা? ভারতীয়রা। গুগলের কর্তা সুন্দর পিচাই, মাইক্রোসফটের সত্যা নাডেলা, নোকিয়ার রাজীব সুরি, উইওয়ার্কের সন্দীপ মাথরানি, মোটোরোলার সঞ্জয় কুমার ঝা, অ্যাডোবের শান্তনু নারায়ণ, কগনিজেন্টের ফ্র্যান্সিকো ডি সূজা।
এসবই ভালো খবর। কিন্তু খারাপ প্রবণতা কী? আমেরিকান কোম্পানির প্ল্যাটফর্ম মানুষের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করছে আর তার জেরে ছড়াচ্ছে দাঙ্গা, আইনশৃঙ্খলার অবনতি, বেআইনি কার্যকলাপ। সুশান্ত সিং রাজপুতের মৃত্যু অথবা হাতরাসের ধর্ষণ, বিজেপি ভালো নাকি কংগ্রেস? হিন্দু বনাম মুসলিম। এসব নিয়ে আমেরিকান সংস্থার যাবতীয় সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলি জনমত তৈরি করে দিচ্ছে ভারতে। হেট-বিজনেস করছে। প্রফিট করছে। আমরা বুঝতেই পারছি না। বোকার মতো ফাঁদে পা দিচ্ছি!
আগামী ৩ নভেম্বর আমেরিকায় ভোট। আমরা তর্কবিতর্ক করছি কে জিতবে? ডোনাল্ড ট্রাম্প নাকি জো বিডেন? রিপাবলিকান অথবা ডেমোক্র্যাট, প্রত্যেকেরই প্রাথমিক লক্ষ্য, তাদের দেশের কর্পোরেটকে বিশ্ববাজারে সুবিধা পাইয়ে দেওয়া। ভারতকে বুঝতে হবে নিজেদের শক্তি। সেইমতো নতুন প্রেসিডেন্টের চোখে চোখ রেখে আদায় করতে হবে ভারতের স্বার্থ। এবার সিস্টেমটা বদলে যাক। আমরা আর মার্কিন কর্পোরেটের হাতে পুতুল হয়ে ব্যবহৃত হব না। বরং আমরাই ব্যবহার করব আমেরিকাকে নিজেদের মতো করে। কারণ, ভারতকে আমেরিকার প্রয়োজন অনেক বেশি? প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ সেটা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। ২০০১ সালে টেক্সাসের গেস্টহাউসে তৎকালীন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ ভারতে নিযুক্ত আমেরিকান রাষ্ট্রদূত রবার্ট ব্ল্যাকউইলকে বলেছিলেন, বব, কল্পনা করো ইন্ডিয়াকে! ১০০ কোটির বেশি জনসংখ্যা, কমপ্লিট ডেমোক্রেসি, ইংলিশ স্পিকিং সিটিজেন, অ্যান্ড নো আল কায়েদা...! ওয়াও! হোয়াট আ স্পট!