পুরনো রোগ চাগাড় দেওয়ায় দেহকষ্ট ভোগ করতে হতে পারে। তীর্থ ভ্রমণ ও ধর্মকর্মে আত্মিক তৃপ্তিলাভ। ... বিশদ
১৯৯০-এর পর থেকে বিহারের রাজনীতি মূলত নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে জাতিগত দিক থেকে নিম্নবর্গের নেতৃত্বের দ্বারা। প্রথমে পিছিয়ে পড়া জাতি যাদব সম্প্রদায়ের নেতা হিসেবে ’৯০ থেকে লাগাতার ১৫ বছর শাসন করেছেন আরজেডি নেতা দম্পতি লালুপ্রসাদ-রাবড়ি দেবী। ২০০৫ থেকে শেষ ১৫ বছর শাসন করছেন কুর্মি সম্প্রদায়ের জেডিইউ নেতা নীতীশ কুমার। বিভিন্ন ভোটে বহু গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু উঠে এলেও শেষ বিচারে বিহারের রাজনীতি এখনও প্রধানত জাতপাত নির্ভর। একেকটি জাত একেকটি সামাজিক রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ১৪ শতাংশ যাদব। ৬ শতাংশ কৈরি। ৪ শতাংশ কুর্মি। ৭ শতাংশ বানিয়া। ৪ শতাংশ ভূমিহার। ৪ শতাংশ রাজপুত। ৫ শতাংশ ব্রাহ্মণ। তাঁরা ৩০ বছর যাবৎ প্রধানত নিজেদের পছন্দের রাজনৈতিক দলকে ভোট দেন। গত ১৫ বছর লালুপ্রসাদ বিরোধী আসনে থাকলেও যাদব ভোটারের ৭৫ শতাংশের সমর্থন আজও তাঁর পক্ষে আছে। আবার ব্রাহ্মণ-রাজপুতদের সমর্থন বিজেপির পক্ষে যেমন থাকে তেমনি কুর্মি, ভূমিহার এবং কৈরিদের সমর্থন নীতীশ কুমার পান। অতি পশ্চাৎপদ জাতির মানুষ ২১ শতাংশ। এসটি ১৬ শতাংশ এবং মুসলিম ১৭ শতাংশ। তাঁদের মধ্যে মুসলিমরা মূলত কংগ্রেস এবং আরজেডি সমর্থক। তবে নীতীশের ধর্মনিরপেক্ষ ভাবমূর্তির কারণে অল্প সংখ্যক মুসলিমের সমর্থন জেডিইউ পায়। অতি পশ্চাৎপদ এবং এসটি ভোটারের একটা বড় অংশের সমর্থন কিন্তু বিজেপিও পাচ্ছে। সেটা এবারও বিজেপি পাবে বলে জনমত সমীক্ষায় উঠে এসেছে।
বিহারের রাজনীতিতে জাতপাতের প্রভাব এতটাই যে জাতভিত্তিক দলগুলিকে নিয়ে জোট গড়া এবং প্রার্থী মনোনয়ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে ওঠে। ২০১৫-র ভোটে নীতীশ বিজেপিকে ছেড়ে দিয়ে লালু ও কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বাঁধেন। শত চেষ্টা করেও নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহরা বিজেপিকে সেবার জেতাতে পারেননি। শেষপর্যন্ত জোট ভাঙিয়ে নীতীশকে সঙ্গে নিয়ে তাঁরা বিজেপি-জেডিইউ সরকার গড়েন।
বিজেপি ২৪৩ আসনের বিধানসভায় চিরাগ পাসোয়ানের লোক জনশক্তি পার্টিকে বাদ দিয়ে জেডিইউ, জিতিন রামের এইচএএম এবং বিকাশীল ইনসাফ পার্টিকে নিয়ে জোট গড়েছে। এলজেপি সরাসরি নীতীশের বিরোধিতায় জেডিইউ-এর বিরুদ্ধে ১২০টির বেশি প্রার্থী দিয়েছে। প্রয়াত রামবিলাস পাসোয়ানের জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে চিরাগ, জেডিইউকে পর্যুদস্ত করে, বিজেপির সঙ্গে সরকার গড়ারর স্বপ্ন দেখছেন। অন্যদিকে আরজেডি-কংগ্রেস এবারও ঐক্যবদ্ধ। সিপিআই (এমএল), সিপিআই ও সিপিএম ওই জোটে রয়েছে। লালুপ্রসাদ জেলবন্দি। প্রচারে নামতে পারবেন না। স্বভাবতই কংগ্রেস-আরজেডি জোটের নেতৃত্ব দিচ্ছেন লালুপুত্র তেজস্বী। দুই জোটের বাইরে তৃতীয় শক্তি হিসেবে প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক জোটে আছে আরএলএসপি, বিএসপি, এমনকী ইন্ডিয়ান মজলিজের মতো দলগুলো। বিহার ভোটে মোদিকে নিয়ে চলছে কাড়াকাড়ি। একদিকে, জেডিইউ এবং বিহার বিজেপি মোদির নাম ব্যবহার করে জিততে চাইছে। অন্যদিকে, চিরাগ নিজেকে মোদিভক্ত হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন। বোঝাতে চাইছেন এলজেপির সমর্থন নিয়ে বিজেপি সরকার হবে। অমিত শাহ থেকে জেপি নাড্ডা সবাই বলছেন, ফলাফল যাই হোক, মুখ্যমন্ত্রী নীতীশই হবেন। কিন্তু মুখের কথা আর মনের কথা এক কি না, সে বোঝা যাবে রেজাল্টের পর।
জাতিগত সমীকরণ ও দলীয় সমীকরণের বাইরে করোনা আবহে এবারের নির্বাচনে পরিযায়ী শ্রমিক ইস্যুটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তেজস্বী পরিযায়ী শ্রমিকদের দুরবস্থার জন্য বিজেপি-নীতীশকে কাঠগড়ায় তুলেছেন। বিরোধীরা সামগ্রিকভাবে বেকারত্ব, শিল্পায়ন না-হওয়া, স্পেশাল বিহার প্যাকেজ না-পাওয়াকে ইস্যু করেছে। কেন্দ্র, রাজ্য উভয়কেই দায়ী করছে। অন্যদিকে, লালুর জঙ্গলরাজ নিয়ে ব্যাপক প্রচার চালাচ্ছে বিজেপি এবং জেডিইউ। সেই তুলনায় নীতীশ কতটুকু সুশাসন দিতে পেরেছেন তা প্রচারের কেন্দ্রে রয়েছে। পাশাপাশি সুশান্ত সিং রাজপুতের মৃত্যু ও তদন্তের ইস্যু, ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল, সিএএ কার্যকর করা ইত্যাদি প্রচারে গুরুত্ব পেয়েছে। তবে বিহারে আলো, সড়ক, বিপিএল-মুক্ত বিহার, বছরে দশ লক্ষ বেকারকে কর্মসংস্থান দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন তেজস্বী।
ইস্যু এবং প্রচার যাই হোক, এবারেও জাতিগত সমীকরণ যেমন একদিকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, অন্যদিকে জাতিগত বিভাজন থেকে হিন্দু ভোটারদের সরিয়ে আনতে বিজেপির তরফ থেকে কাশ্মীরের মতো ইস্যুকে প্রচারের আলোকে নিয়ে আসা হয়েছে। ধর্মকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে জাতিগত বিভাজন আটকাতে চাইছে বিজেপি। এখন দেখার বিগত কয়েকটি ভোটের মতো এবারও বিজেপি তার সফল প্রয়োগ করতে সক্ষম হয় কি না। ইতিমধ্যেই বিজেপি নেতা গিরিরাজ সিং জিন্না প্রসঙ্গ তুলে এনেছেন নির্বাচনী প্রচারে। মোদির মন্ত্রিসভার সদস্য নিত্যানন্দ রায় তাঁর মতো করে কাশ্মীর প্রসঙ্গ এবং সন্ত্রাসবাদ ইস্যু ধর্মের মোড়কে নির্বাচনী জনসভাগুলোতে প্রয়োগ করছেন। তবে, নির্বাচনে মোদিই যে প্রধান মুখ তাতে সংশয় নেই। ‘হামারে মোদি’ এই স্লোগান করোনা পরিস্থিতিতে আজও গুরুত্বপূর্ণ কি না তা ১০ নভেম্বর রেজাল্ট বেরলেই স্পষ্ট হবে।
বিহার ভোট বিজেপির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ২০১৯-এর লোকসভা ভোটের আগে এবং পরে যেখানেই বিধানসভার ভোট হয়েছে বিজেপি প্রায় কোথাও এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। বরং মহারাষ্ট্র, ঝাড়খণ্ড রাজ্য বিজেপির হাতছাড়া হয়েছে। কোভিড মোকাবিলায় মোদি কতটুকু সফল হলেন সেই বিষয়ে জনরায় বিহার ভোটের রেজাল্ট থেকে পাওয়া সম্ভব। একইভাবে সাধারণভাবে সুশাসন এবং কোভিড মোকাবিলায় নীতীশ কতটুকু সফল তার ইঙ্গিতও মিলবে। একই সঙ্গে আগামী বছর পশ্চিমবঙ্গ, কেরল, অসম, পন্ডিচেরি এবং তামিলনাড়ুতে বিধানসভা ভোট রয়েছে। বিহার ভোটের ফলাফল অবশ্যই বিজেপির আগামী দিনের উত্থান-পতনের সঙ্গে সম্পর্কিত। বিশেষ করে পড়শি পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা ভোটের ফলাফল বিহারের এই ফলাফলের দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকবে।