উচ্চবিদ্যার ক্ষেত্রে মধ্যম ফল আশা করা যায়। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সাফল্য আসবে। প্রেম-প্রণয়ে নতুনত্ব আছে। কর্মরতদের ... বিশদ
সত্যিই তাই। ‘‘বাজল তোমার আলোর বেণু ...’’ বলে মাকে আবাহন করার দিন কয়েকের ভিতরেই নবমীনিশি পোহানোর ব্যস্ততা, তাঁর বিদায়ের তোড়জোড় আমাদের পীড়া দেয়। দিকে দিকে বিজয়ার বাজনা বেজে ওঠে। মায়ের শ্মশানবাসী পাগল স্বামীটার যেন উমাকে ফিরিয়ে নেওয়ার তর সয় না। আর তিনি একবার চাইলে মাকে ফিরিয়ে না-দেওয়ার জো কোথায় মর্ত্যবাসীর! মেনকাও প্রতিবার প্রার্থনা করেন গিরিরাজপ্রাসাদ যেন আরও কিছুক্ষণ আলোকিত থাকে। দেবী উষার কাছে মেনকা করজোড়ে প্রার্থনা করেছিলেন, নবমীনিশি যেন এত তাড়াতাড়ি না-পোহায়, কন্যার বিদায়বেলা যেন আর একটু পিছিয়ে যায়। কিন্তু উষাও আশাহত করেন মেনকাকে—যথাসময়ে দশমীর ভোর উঁকি দেয়। তবুও মায়ের চেষ্টার অন্ত থাকে না। সখী বিজয়াকে মেনকা নির্দেশ দেন, হরকে সাফ বলে দাও, উমাকে এখনই পাঠানো যাবে না—‘‘জয়া বলো গো, পাঠানো হবে না,/ হর মায়ের বেদন কেমন জানে না।’’
আমরা জানি, মেনকার ভিতর দিয়ে আমাদের মতো কোটি কোটি সন্তানের এমন প্রার্থনা কখনওই মঞ্জুর হয় না। মাদুর্গা তিথি নক্ষত্র মেনেই পতিগৃহে ফিরে যান। নীলকণ্ঠ পাখিটাও পাগলা শিবের এমন ন্যাওটা যে শত শত মাইল পাড়ি দেয় উমার ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি সংবাদ নিয়ে। হরও তিথি নক্ষত্র মেনে গিরিরাজপ্রাসাদে হাজির হন দেবীকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে।
অন্যদিকে, মায়ের বিদায়ের অনুভব আমাদের দুঃখিত, ব্যথিত করে। কিন্তু আমরা ভুলে যাই, এই দিনেই মাদুর্গা অশুভশক্তির বিরুদ্ধে বিজয়িনী হয়েছিলেন। মহিষাসুরের সঙ্গে ন’দিন ন’রাত্রি যুদ্ধ করে মাদুর্গা বিজয় লাভ করেছিলেন। মাটির পৃথিবীতে শুভশক্তির প্রতিষ্ঠা করে দেওয়ার পর তাঁর আপাতত কীই-বা করার থাকে। তাঁকে তো ফিরে যেতেই হয় শিবলোকে, তিনি যে সময়মতো ফিরে যাওয়ারই কথা দিয়ে এসেছেন কৈলাসপতিকে।
মহাকবি দেখেছেন—‘‘হাসির চন্দ্রকলা তার ললাটে লাগিয়া আছে, কিন্তু তার জটায় জটায় কান্নার মন্দাকিনী। ... আমাদের শরতে আগমনীটাই ধুয়া। সেই ধুয়াতেই বিজয়ার গানের মধ্যেও উৎসবের তান লাগিল।’’
বিচ্ছেদ-বেদনার ভিতরেও আমরা সান্ত্বনা খুঁজে নিই—‘‘বারে বারে নূতন করিয়া ফিরিয়া আসিবে বলিয়াই চলিয়া যায়, তাই ধরার আঙিনায় আগমনী-গানের অন্ত নাই। যে লইয়া যায় সেই আবার ফিরাইয়া আনে। তাই সকল উৎসবের মধ্যে বড়ো উৎসব এই হারাইয়া পাওয়ার উৎসব।’’
অন্যদিকে, ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ব্যাখ্যা করেছেন, মাটির পৃথিবীর সঙ্গে, এখানকার সন্তানদের সঙ্গে মাদুর্গার বাস্তবে কোনও বিচ্ছেদই হয় না। তিনি সাকার রূপে পুজো নিয়ে নিরাকার রূপে কৈলাসে ফিরে যান। তাঁর সাবেক সাকার মূর্তিটাই আমাদের ঘিরে থাকে, আচ্ছন্ন করে রাখে।
মা আসলে আমাদের মধ্যে রয়ে যান সর্বক্ষণের জন্যে। আমাদের সুখ-দুঃখের সাথী হিসেবে। বিশেষ করে দুঃখের ভার সমানভাবে গ্রহণের জন্য। এই যে দুঃসহ দু’হাজার বিশ সাল। আমাদের বিশ্বাস রাখতে হবে, এই সালের বিষবৎ ভার মায়ের জন্যেও সমান। তিনি স্বয়ংপ্রকাশিতা হয়ে, আমাদের সঙ্গে থেকে, আমাদের সবার যন্ত্রণা প্রত্যক্ষ করলেন। এই অপরিমেয় দুঃখনিবারণের উপায় তিনিই সাজাচ্ছেন নিজের হাতে।
ফের মায়েরই উপর ভরসা রাখি। তাঁকে পুরো একটা বছর আমরা সময় দেব। তিনি আমাদের সংবৎসরের প্রয়োজন গোছাতে থাকুন। চাল ডাল তেল নুন বস্ত্র ওষুধপথ্য-সহ সবকিছু। আশা করি, সেসব দিয়ে আগামী পুজোর আগেই আমাদের পুরো পৃথিবী গুছিয়ে নিতে পারবে। আমরা প্রস্তুত হয়ে যাব অন্যবারের মতো। সাকার মাকে মণ্ডপে মণ্ডপে সাজাব মহাসমারোহে। আগামীবারের উৎসব হবে সত্যিকারের উৎসব যেমন হয়, কোনওভাবেই এবারের মতো নয়। কাছে পেয়েও সন্তানরা মাকে কাছে পাইনি। অদ্ভুত এক দূরত্ব রেখে দিতে বাধ্য হয়েছি আমরা। মাও কোনওরকম প্ররোচনা দেননি। পাছে আমাদের স্বাস্থ্যবিধির আগল খুলে যায়, আমরা বড় কোনও ভুল করে বসি। পুজোর আয়োজন থেকে অংশগ্রহণের ধারাবাহিকতাই বজায় রয়ে গেল বিজয়ার শুভেচ্ছা বিনিময়ে।
আলিঙ্গন বা কোলাকুলি থেকে দূরে রইলাম সকল বন্ধু প্রিয়জন। দূর থেকে নমস্কার সারলাম কিংবা সমস্ত প্রীতি শুভেচ্ছা ভালোবাসা নিয়ে প্রবেশ করলাম ভার্চুয়াল দুনিয়ায়। চিঠি লেখার সংস্কৃতিকে আগেই বিদায় জানিয়েছি আমরা। গুরুজনদের পা ছুঁয়ে প্রণাম এবং প্রিয়জনদের আলিঙ্গন করার যে রীতিটা বাঁচাতে পেরেছিলাম, সেটাকেও এবার মুলতুবি রাখতে বাধ্য হয়েছি আমরা। না-মরে বেঁচে থাকা কাকে বলে—আমাদের দেখে জেনে গেছ মা নিশ্চয়। তেমনি পুজো করেও পুজো না-করার বছর গেল যে এবার আমাদের! এই দুঃস্বপ্নের কালের চিরনির্বাসন হোক পশ্চাতের করাল গর্ভে।
মাদুর্গার কাছে আমাদের প্রার্থনা—আগামীবার তোমার চিরকালীন আটপৌরে রূপেই ফিরে এসো মা। তোমার কোলে, তোমার আঁচলতলে মাথা রাখার মতো করে পেতে চাই তোমাকে, ফের। তোমাকে এইভাবে না-পেলে যে আমাদের কোনও সুখই সুখ বলে অনুভব হয় না। শত সুখও বিষাদের চাদের ঢাকা পড়ে যায়। চেনা রূপেই এসো মা, আমরা তার ভিতরেই আমাদের ষড়ঋতুর, সারা বছরের আলো, অপার সুখ খুঁজে নেব। তোমার আসা-যাওয়ার নিয়মে এবারের মতো অবাঞ্ছিত বৈচিত্র চাই না মা। এবার বিষাদময় যে ঘর নিজের চর্মচক্ষে দেখে গেলে, আমাদের, তাতে সবচেয়ে মজবুত তালাটা তুমি নিজের হাতে দিয়ো, চিরতরের জন্যে।
আমাদের পাশে থেকো মা। তোমাকে কথা দিচ্ছি, আগামীবার এসে দেখবে—আমাদের এই পৃথিবীর সমস্ত অসুখ সেরে গেছে। আমাদের কারও মধ্যে ছোঁয়াছুঁয়ির ভয় নেই, কোনওরকম ছুঁৎমার্গ নেই। আমরা সবাই আগের মতো চঞ্চল, কর্মচঞ্চল। নদীর প্রবল স্রোত বা পাহাড়ি ঝরনাধারার সামনে যেমন কোনও বাঁধই যথেষ্ট নয়, তেমনি আমাদেরকেও কেউ রুখতে পারছে না। শিক্ষায়-গবেষণায়, ব্যবসায়-বাণিজ্যে, অর্থে-সম্পদে, খেলাধুলোয়, শিল্পে-কলায়, সাহিত্যে-সঙ্গীতে, রাজনীতিতে-রাষ্ট্রপরিচালনায়, জনচেতনায়-জনকল্যাণে, প্রেমে-ভালোবাসায়—সব সবদিকে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনে অগ্রণী। এখন থেকেই ভাবো তো মা, তাহলে আগামীবার তোমাকে আমরা আরও কত সুন্দরভাবে বরণ করে নিতে পারব। তোমাকে নিয়ে আমাদের আনন্দ উচ্ছ্বাস হবে সমস্তরকমে বাঁধন ছেঁড়া। তোমার জন্য আগমনি গান লেখা হবে নতুন উৎসাহে। দেখে নিয়ো মাদুগ্গা, আগামীবার পাগলা শিবের হাজার জোরাজুরি সত্ত্বেও পতিগৃহে ফিরে যেতে মন চাইবে না তোমার। একটুও না। এই মাটির পৃথিবী কৈলাসের অধিক মায়া ফেলে দেবে তোমার মনের আনাচে-কানাচে।