উচ্চবিদ্যার ক্ষেত্রে মধ্যম ফল আশা করা যায়। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সাফল্য আসবে। প্রেম-প্রণয়ে নতুনত্ব আছে। কর্মরতদের ... বিশদ
অন্যবার মহালয়া মানেই বেশিরভাগ বাড়ির কেনাকাটা সারা। স্কুলে স্কুলে পুজোর ছুটি পড়ার অপেক্ষা। কার ক’টা জামা-প্যান্ট-জুতো হয়েছে—ছোটদের সেসব গোনাগুনতির পালা। মামা, পিসি, দাদু-দিদার তরফে কী গিফট পাওয়া গেল। মাসির ছেলে, কাকুর মেয়ের জন্য কোনটা যেন কেনা হল। কার যেন সাজের কোন জিনিসটা কেনা বাকি রয়ে গেছে! চলে এসব খুঁটিয়ে খোঁজ নেওয়া। কারও প্ল্যান, পুজোর ছুটিতে দার্জিলিং বা ডুয়ার্স বেড়াতে যাবার। কেউ-বা লাগেজ গুছিয়ে ফেলে ঝাড়গ্রাম, বিষ্ণুপুর, মুর্শিদাবাদ কিংবা ধান্যকুড়িয়ার গ্রামের বাড়িতে গিয়ে পুজোর দিনক’টা নিরিবিলি কাটাবে বলে।
পাড়ার প্যান্ডেলে অষ্টমী ও নবমীতে পাত পেড়ে ভোগ খাওয়া এবং দশমীতে নাটকে অংশগ্রহণের জন্যই নাকি একটা করে বছর বেঁচে থাকেন মাঝবয়সি সমরেশবাবু! কোনও বাড়ির মেয়ে মধুজার সাফ কথা—পুজোয় কলকাতা ছেড়ে বেরনো? অসম্ভব। হাউজিংয়ের পুজোয় দিনভর আড্ডা আর গানের প্রতিযোগিতার জন্য সারা বছর অপেক্ষা করে থাকি। দৈনিক কাগজের ক্রোড়পত্র থেকে পুজো প্যান্ডেলের ম্যাপ কেটে রাখার ব্যস্ততা নতুন নয়—গুগল নামক সর্বরোগহরা হাতের মুঠোয় থাকতেও। বাবার অফিস কলিগের মাধ্যমে কিংবা বন্ধুর আইপিএস বাবাকে ধরে ভিআইপি পাস জোগাড়ের সে কী প্রতিযোগিতা। বন্ধুর বাবা পুলিসকর্তা, এই অধিকারে গোগোল তো হাউজিংয়ের দু’জন সিকিউরিটি গার্ডকে সেরা পুজোগুলোর পাস জোগাড় করে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়ে বসে আছে। তারা সুভাষগ্রাম আর কানাইপুরের বাড়িতে দিয়ে আসবে, পঞ্চমীর আগেই। গার্ড দু’জন এজন্য ওই পুচকেটাকে বিশেষ খাতিরও করে।
লিস্টি তৈরি হয়ে যায় উত্তরের কোন কোন পুজো কোন কোন দিন দেখতে যাওয়া হবে। দক্ষিণের জন্যও অনুরূপ প্ল্যান। পরিক্রমার শুরুটা উত্তর দিয়ে হবে নাকি দক্ষিণ দিয়ে—তা নিয়ে তর্কবিতর্কে শুধু ছোটরা কেন, বাড়ির মা জ্যাঠাইমা দিদারাও কি ঢুকে পড়েন না? মায়ের সর্বক্ষণের অ্যাসিস্ট্যান্ট ললিতা কিংবা শ্যামলীর মুহুর্মুহু ফোড়ন—সেও তো রয়েছে।
মাঝখানে কোন রেস্তরাঁয় ডিনার হবে তা নিয়ে একমত হওয়াটাও সবদিন সম্ভব হয় না। প্ল্যান হয়ে যায়, নিউ আলিপুরে আমরা সৃজনদের টিমের সঙ্গে মিট করব। ডিনারটা হবে ওদেরই সঙ্গে। মেনু সিলেকশনে পিসির ছেলে সৃজনের জুড়ি নেই। কথায় কথায় চলে আসে, কোন বছর ডিনার শেষে গাড়ি খুঁজে পেতে কতটা হয়রানি হয়েছিল। অতএব পার্কিং নিয়ে বিশেষজ্ঞের মতামত দিতে পারে না—এমন একজনকেও খুঁজে পাওয়া যায় না। আগামী বছর যে-ছেলে প্রথম বোর্ড এগজাম দেবে, ‘বড়’ হয়ে যাওয়ার অধিকারে সে এগিয়ে আসে বিশেষ দায়িত্ব নিতে—ড্রাইভার কাকুর মোবাইল নম্বরটা কিন্তু আমার কাছে থাকবে। ব্যাপারটা আমাকে বুঝে নিতে দিও। জ্যাঠামণি, বড়পিসির মুচকি হাসি দেখে সেই লায়েক ছেলে লজ্জা লুকতে ব্যস্ত—এই কারণেই না তোমাদের জন্যে কিছু করতে নেই। সঙ্গে সঙ্গে দিদির বাঁকা প্রশ্ন ছুটে আসে—বাবা, গাড়ির চাকা দু’পা গড়াতেই কে যেন ঘুমোতেই জানে না? এই কথার লক্ষ্য যে, সে ঠিক বুঝে যায়। অমনি দিদিকে সারা বাড়ি তাড়া করে ফেরে পুজো পরিক্রমার সেই হবু গার্জেন। একজনের তো কয়েক বছরের পুরনো রাগ পুজো এলেই ফিরে আসে—ড্রাইভারটাকে কে জোগাড় করেছিল? জীবনে কলকাতা দেখেনি যে, তাকেই দিয়েছে পুজো দেখানোর দায়িত্ব! ফের যদি ওরকম কিছু হয়, আমি কিন্তু যাচ্ছি না। হুমকি দেন হাফ অ্যাডভোকেট সিন্থলবাবু। কেউ একজন মনে করিয়ে দেয়, এবার ভিকিরা আসছে মনে আছে তো? পুজোর পরেই ভিকি স্টেটসে চলে যাবে। ইউসিএলএ-তে পিএইচ-ডি অ্যাডমিশন হয়ে গেছে। এরপর কবে আর পুজোর কলকাতায় আসতে পারবে কে জানে। আরও আছে। সল্টলেকের মাঠে কিংবা শ্রীভূমিতে ঢুকে হারিয়ে যাওয়া। সেলফি তোলা নিয়ে কোন কোন প্যান্ডেলে স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে কী ঝামেলা হয়েছিল। কারও মনে পড়ে যায়—গুগল লোকাল গাইডস-এ কোন কোন পুজোর ছবি পোস্ট করে কত হাজার পয়েন্টস জোগাড় হয়েছিল। ইনস্টাগ্রাম, ফেসবুক পোস্ট থেকে কতটা খ্যাতিবৃদ্ধি হয়েছে।
যাই হোক, এইভাবেই সবার জন্য উত্তর ও মধ্য কলকাতায় সেজে ওঠে কুমোরটুলি পার্ক, বাগবাজার সর্বজনীন, কলেজ স্কয়্যার, সন্তোষ মিত্র স্কয়্যার, নলীন সরকার স্ট্রিট সর্বজনীন, মহম্মদ আলি পার্ক প্রভৃতি। ভিআইপি রোডকে মাঝখানে রেখে তৈরি থাকে সল্টলেক এবি, জিডি, এফডি ব্লক, শ্রীভূমি, দমদম পার্ক তরুণ সংঘ। একডালিয়া এভারগ্রিন, বালিগঞ্জ কালচারাল অ্যাসোসিয়েশন, দেশপ্রিয় পার্ক, যোধপুর পার্ক, বোসপুকুর শীতলামন্দির, সিংহী পার্ক সর্বজনীন, মুদিয়ালি ক্লাব, সুরুচি সংঘ, ত্রিধারা সম্মিলনী, নাকতলা উদয়ন সংঘ, বাবু বাগান সর্বজনীন, বাদামতলা আষাঢ় সংঘ প্রভৃতি জমিয়ে রাখে দক্ষিণকে।
সর্বক্ষণ এসব নিয়ে আলোচনায় কোন বাড়ি না ‘পাখিরালয়’ হয়ে ওঠে! কিন্তু এবার সে অবকাশ আর কোথায় পাওয়া গেল? স্কুলপড়ুয়াদের টানা ছুটির ক্লান্তিটাই যে কাটছে না। আলাদাভাবে পুজোর ছুটির জন্য মন কেমন করা আসবে কী করে। এবার ক’জন আর পুজোর কেনাকাটা করতে যাওয়ার সাহস পেয়েছে? সবার পকেটে যে টাকাও নেই। কেমন যেন স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে, কলকাতায় নানান স্বাদের ও থিমের কয়েকশো পুজো হয়। পৃথিবীর বৃহত্তম উৎসবগুলোর একটা। কলকাতার দুর্গোৎসব ‘ইউনেস্কো ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ’-এর স্বীকৃতি লাভের প্রতীক্ষা করছে। কিন্তু এবার মহালয়ায় পুজো পুজো ভাবটাই ছিল না। আজ যদি কাউকে জিগ্যেস করা হয়, মহালয়া কত তারিখ গেছে? ক্যালেন্ডারে চোখ না বুলিয়ে বেশিরভাগই বলতে পারবেন না। মাসাধিককাল আগের ইভেন্ট বলেই নয়, ১৭ সেপ্টেম্বর দিনটা এবার আমাদের নাড়া দিতেই পারেনি।
তবু এবার পুজো। পাঁজি বলছে, ২২-২৬ অক্টোবর (ষষ্ঠী-দশমী)। বাংলাকে বিষাদের পরিবেশ থেকে বের করে আনার জন্য বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ৩৭ হাজার পুজো কমিটিকে ৫০ হাজার টাকা করে সহায়তা দিয়েছে সরকার। নাগরিক সমাজ এর মধ্যে সস্তা ভোটের রাজনীতি দেখলেও মুখ্যমন্ত্রী তা গায়ে মাখেননি। তিনি মোদ্দা কথা মাথায় রেখেছেন: এবার পুজো হওয়াটা জরুরি। নিয়মরক্ষার হলেও। অন্যথায়, বাঙালি আরও বিষাদে ডুবে যাবে। উৎসব হলে মানুষের কেনাকাটা কিছুটা বাড়বে। যার ভিতরে অর্থনীতির জন্য সুখবর লুকিয়ে থাকে। আর উৎসবের আলো, সুরের অন্তরে যে প্রাণ—তার নীরব শক্তি কতটা, প্রমাণ নতুন করে নেওয়ার কী আছে।
তবে, ব্যাপারটা দাঁড়িয়েছে শাঁখের করাতের মতো। পুজোর ভিড় থেকে সংক্রমণ বহুগুণ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা যে থাকছেই। তাই আয়োজনের গোড়াতেই ডাক্তারদের একটা সংগঠন সরকারকে সতর্ক করেছে: অসতর্ক হলে ‘কোভিড সুনামি’ অনিবার্য! এই প্রসঙ্গে কেরল ও কর্ণাটকে ওনাম এবং মহারাষ্ট্রে গণেশ চতুর্থী মহাসমারোহে উদযাপনের পরিণাম স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে। নিশ্চয় ভুলিনি, কোভিড মোকাবিলায় এই কেরলই কিন্তু ‘হু’-র প্রশংসা কুড়িয়েছিল। আর সেই রাজ্যই এখন হিমশিম খাচ্ছে। চিকিৎসক সংগঠনের বক্তব্য, অন্যদের ভুলগুলো থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। কোনও ক্ষেত্রেই যেন মান্য স্বাস্থ্যবিধির সঙ্গে আমরা আপস না করি। সেটা হবে আত্মঘাতী পদক্ষেপ।
রেকর্ড সংখ্যক আমন্ত্রণপত্র পেয়েও মুখ্যমন্ত্রী অনেক প্যান্ডেলে পুজো উদ্বোধনে যাননি। বাছাই কয়েকটির উদ্বোধন করেছেন ভার্চুয়ালি। প্রশংসনীয় সিদ্ধান্ত। একসঙ্গে বেশি মানুষের ভিড় যাতে না-হয় তার জন্য ঠাকুর দেখার দিনও বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। মানতে বলা হয়েছে একগুচ্ছ সরকারি নির্দেশিকা। ওইসঙ্গে যোগ হয়েছে আদালতের কিছু বিধিনিষেধ। সব মিলিয়ে এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। দুর্গোৎসব আমাদের বহুদিনের এক অভ্যাস। একটা করে বছর বেঁচে থাকার মন্ত্র। বাৎসরিক আয়ু ক্রয়ের হাট। এবার এসব রক্ষা করতে হবে নতুনভাবে। অভিযোজনের এও এক প্রকরণ। এই বাংলা বহু সঙ্কটের সাক্ষী। জয়ী হয়েছে অতীতের সব যুদ্ধে। আসুন, আমরা সবাই মিলে জয়ের সেই ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ণ রাখি। শুধু মনে রাখতে হবে, দিনের শেষে জয় প্রতীক্ষা করে শুধু কুশলী যোদ্ধার জন্যে।