উচ্চবিদ্যার ক্ষেত্রে মধ্যম ফল আশা করা যায়। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সাফল্য আসবে। প্রেম-প্রণয়ে নতুনত্ব আছে। কর্মরতদের ... বিশদ
প্রথম প্রশ্নই হল, এতদিন ঝুলিয়ে রাখার খুব কি দরকার ছিল? করোনা মোকাবিলায় যে নামতে হবে, তার বিন্দুমাত্র আভাস বা প্রস্তুতি ছিল না রাজ্যের। বাংলার আবার একটা বিষফোঁড়াও ছিল—উম-পুন। তারপরও টালবাহানা কম করেনি কেন্দ্র! আর রাজ্যগুলি চেয়েছিল তো প্রাপ্যটাই। মানে, জিএসটি আদায়ে লোকসানটুকু। পশ্চিমবঙ্গের না হয় বাড়তি বেশ কয়েক হাজার কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। সেই প্রাপ্য ফেরাতেই অনীহা কেন্দ্রের। সবচেয়ে বড় কথা, ঋণ যদি কেন্দ্র নেয়, তাহলে নিশ্চিতভাবে সুদের হার অনেক কম হবে। আর প্রত্যেক রাজ্যই একটি নির্দিষ্ট হারে সুদ কেন্দ্রকে ফেরাতে পারবে। অথচ রাজ্যগুলি ঋণ করতে বাজারে নামলে এক এক রাজ্যের জন্য এক এক রকম সুদ হবে। এবং বিলক্ষণ সেই হার বেশ চড়া।
দ্বিতীয়ত, কেন এক লক্ষ কোটি টাকাই ঋণ নিচ্ছে কেন্দ্র? জিএসটি সংগ্রহে লোকসান তো প্রায় তিন লক্ষ কোটি টাকা! এমনও নয়, এই ঋণের জন্য ব্যাপক আর্থিক ঘাটতি হবে। কেন্দ্রীয় সরকারই জানিয়েছে, তেমন কোনও প্রভাব এই লোনের জন্য পড়বে না। তাহলে কেন পুরো টাকাটাই কেন্দ্র ধার করল না? নাকি কেন্দ্র লোন করে দিলে, রাজ্যগুলি লোকসানের টাকাটা ভবিষ্যতে আর দাবি করবে না? এই পরিমাণ অর্থে বাটিতে সামান্য জল হয়তো পড়বে, কিন্তু চিঁড়ে ভিজবে না। অদূর ভবিষ্যতে দাবি-দাওয়া নিয়ে আবার রাজ্যগুলি হাতা গুটিয়ে নেমে পড়বে আসরে।
এর পরের প্রশ্ন, টাকাটা রাজ্যগুলির হাতে কীভাবে তুলে দেওয়া হবে? পাবলিক অ্যাকাউন্ট অব ইন্ডিয়ার মাধ্যমে? সংবিধানের ২৬৬(২) ধারা অনুযায়ী গঠন করা হয়েছিল পাবলিক অ্যাকাউন্ট। রাজ্যের পিএফের টাকা, রিজার্ভ ফান্ড, আয়কর সংক্রান্ত অর্থ... এই সবই পাবলিক অ্যাকাউন্ট অব ইন্ডিয়ার অন্তর্গত। এই অ্যাকাউন্টের টাকা সরকারের নয়। কাজেই ফেরত করা বাধ্যতামূলক। আবার এই অ্যাকাউন্ট থেকে খরচ করলে সংসদের অনুমতিও নিতে হয় না। কাজেই কেন্দ্র যে ঋণ করতে চলেছে, তা রাজ্যগুলির কাছে পৌঁছে দেওয়ার এটা একটা পছন্দসই মাধ্যম হতে পারে। যদিও তেমন কিছু করা হচ্ছে কি না, তা কেন্দ্র এখনও খোলসা করেনি।
এই প্রশ্নগুলির উত্তর যত দ্রুত মিলবে, ততই ভালো। তা না হলে কেন্দ্রের সঙ্গে রাজ্যগুলির অন্তর্কলহ কিন্তু নিত্য বাড়বে। রাজ্যগুলির ক্ষেত্রে এই মুহূর্তে সুবিধা একটাই—সামনে বেশ কিছু বিধানসভা ভোট। প্রথমেই বিহার, আর পরের বছর বাংলা। ২০১৪ সালে দিল্লির কুর্সি দখলের পর থেকেই বঙ্গবিজয়ের স্বপ্ন দেখে চলেছে বিজেপি। তার জন্য যদি কিছু নেতা, কিছু আদর্শ ত্যাগ করতে হয়, তাও সই। বাংলার ভোটারদের কাছে কিন্তু বঞ্চনার থিওরিটা রীতিমতো বিশ্বাসযোগ্য। প্রাপ্য টাকা দিচ্ছে না কেন্দ্র—এই অভিযোগ বারবার করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আর তার প্রমাণও মিলেছে। অঙ্কটা ৬০ হাজার কোটির উপর। তাই কেন্দ্র বিরোধী প্রচারে এই ইস্যুতেই বেশ গতি পাবে তৃণমূল কংগ্রেস। এর উপর জিএসটি সংক্রান্ত বঞ্চনার সম্ভাবনা তৈরি হলে নিশ্চিতভাবে তা ফের প্রচারের হাতিয়ার করবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। যা ভোটের আগে মোটেও বিজেপিকে খুব একটা ডিভিডেন্ড দেবে না। এমনিতেই গত কয়েক বছরের প্রবল প্রতাপের কাঠিন্যে খানিকটা হলেও জং ধরতে শুরু করেছে। নোট বাতিল কিংবা জিএসটির ক্ষেত্রে যে ডোন্ট কেয়ার দাপট মোদি সরকার দেখিয়েছিল, তা আপাতত উধাও। সব ইস্যুতেই এখন বিরোধীদের চরম বাধার মুখে পড়তে হচ্ছে কেন্দ্রকে। যা তাদের ‘একচ্ছত্র’ ইমেজে বড়সড় একটা দাগ! সংখ্যার জোর দেখিয়ে একের পর এক বিল সংসদে পাশ হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু রাজপথের বিরোধ তাতে এড়ানো যাচ্ছে না। আর সবচেয়ে বড় কথা, নজর ঘোরানোর নানা পন্থা অবলম্বন সত্ত্বেও এবার আর একটি রোগ ফিরে ফিরে আসছে। যার নাম নিরাপত্তাহীনতা। একটি বালাকোট বা পাকিস্তান বিরোধী গরম গরম কথাবার্তা এতদিন ভোটযন্ত্রে ভালোরকম সুবিধা দিয়েছিল বিজেপিকে। এবার হাওয়া ঘুরছে। চীনের সঙ্গে সীমান্ত সংঘাত কিংবা করোনা মহামারীও মোদি সরকারের নড়বড়ে ভাবটা আড়াল করতে পারছে না। মাঝে আরও দু’টি ইস্যু উঠে এল... একটি বলিউডে মাদক কাণ্ড এবং দ্বিতীয় হাতরাস। তা সত্ত্বেও এই মুহূর্তের সবচেয়ে বড় ইস্যু থেকে মানুষের নজর ঘোরেনি। আর তা হল, কৃষি আইন।
চাষবাস চিরকালই দেশের অর্থনীতির ভিত্তি। এর কর্পোরেটাইজেশন যে কখনওই আমাদের সুদূরপ্রসারী লাভের মুখ দেখাবে না, সে ব্যাপারে কোনও সংশয় নেই। কাজেই ন্যূনতম যা প্রয়োজন, তার উল্লেখ এই আইনে রাখতেই হবে। এটাই বিরোধীদের তথা আম আদমির একমাত্র দাবি। জিএসটি আদায় সংক্রান্ত লোকসানে কিন্তু ‘অ্যাক্ট অব গড’ তত্ত্বে অনড় থাকতে পারেনি কেন্দ্র। ঈশ্বরের ঘাড়ে সবটা চাপিয়ে দিয়ে দায়মুক্তির স্বপ্ন দেখেছিল মোদি সরকার। সেই অলীক স্বপ্ন ভেঙেছে। এবং এই পদক্ষেপ দেখিয়ে দিয়েছে, চাপ বাড়ালে কাজ হয়। সঠিক এবং যুক্তিসঙ্গত প্রতিবাদের সামনে মাথা নোয়াবে সরকার। অহং এবং একগুঁয়েমির খোলস ছেড়েও বেরতে বাধ্য হবে। এই সরকারের দৌলতে এখনই চাল-ডাল আর নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের তালিকায় নেই। অর্থাৎ যে যেমন চাইবে, তেমনই দাম হাঁকতে পারবে। সরকার যদি দাবি করে, এর ফলে কৃষকের লাভ হবে... ব্যাপারটা মোটেও তেমন নয়। ন্যায্য দাম তাঁরা পাবেন না। বরং এতে লাভ হবে কর্পোরেট জগতের। লকডাউনের বাজারে কৃষিজাত পণ্য এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যের চাহিদা-সরবরাহের অনুপাতই একমাত্র ধাক্কা খায়নি। শুধু তাই নয়, কৃষিপণ্যের রপ্তানিও গত কয়েক মাসে উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে।
এই পরিস্থিতিতে সরকারি নিয়ন্ত্রণ যথাযথভাবে থাকলে তা মানুষের ঘরে খাবারের অভাব যেমন তৈরি করবে না, ঠিক তেমনই বাজারের সামঞ্জস্যও বজায় থাকবে। সংসদে সংখ্যা থাকলেই বিরোধিতা সম্ভব, নতুবা নয়... এই ফর্মুলা আঁকড়ে কান্নাকাটির সময় এটা নয়। ভোটাররা ভরসা করেছিলেন। তাই মোদি সরকার একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় এসেছে। নিশ্চিতভাবেই এর ফলে শরিক সমস্যা সরকারে থাকে না। মানে, ভালো কিছু করার ইচ্ছে থাকলে তাতে বাগড়া দেওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়। কিন্তু উল্টোটাও যে হয়! এবং হচ্ছে। একের পর এক জনবিরোধী কর্মসূচিকে সংস্কারের তকমা দিয়ে কার্যকর করতে উঠেপড়ে লেগেছে কেন্দ্র। অথচ বিরোধীরা সরব হয়েও কিছু করতে পারছে না। লক্ষ লক্ষ কৃষক রাস্তায় নেমেছেন... রাজনৈতিক দল, ব্যানার নির্বিশেষে। তাঁদের কথা ভেবেও কি সরকার কিছু করছে? বলছে, মানুষকে বোঝাতে হবে। সেটা কে বোঝাবে? নিশ্চয়ই কেন্দ্র! এতকিছুর পরও যখন মানুষ, বা আরও স্পষ্টভাবে বললে কৃষক সমাজ বুঝছে না, তাহলে গলদ তো কোথাও আছেই।
শাসক এবং বিরোধী—সুযোগ দু’পক্ষেরই আছে। মানুষের পাশে আসলে কে রয়েছে, সেটা বোঝানোর। যদি বিরোধীরা সঠিক হয়, তাদের লড়াই জনস্বার্থে হয়... মানুষ সঙ্গে থাকবেই। কারণ এই আন্দোলন যতটা রাজনীতির জন্য, তার থেকে অনেক বেশি ভবিষ্যৎ ভারতের স্বার্থে।