কর্মপ্রার্থীদের কোনও সুখবর আসতে পারে। কর্মক্ষেত্রে পদোন্নতির সূচনা। গুপ্ত শত্রু থেকে সাবধান। নতুন কোনও প্রকল্পের ... বিশদ
স্বপন লোকাল ট্রেনে বাদাম আর ঝুরিভাজা বেচত। গত দশ বছর সকাল থেকে সন্ধ্যা তার একটাই ঠিকানা। নৈহাটি থেকে উল্টোডাঙা লোকাল ট্রেনের কামরা। চলন্ত ট্রেন থেকে লাফ মেরে নিমেষে কীভাবে পাশের প্ল্যাটফর্মের ভিড়ে হারিয়ে যেত, সে এক অদ্ভুত বিস্ময়। গলায় ঝোলানো ছোট ছোট বাদামের প্যাকেট। মালার মতো পেঁচিয়ে এক ট্রেন থেকে অন্য ট্রেনে ঘেমে নেয়ে অক্লান্ত ছোটাছুটিই ছিল ওর নিত্যদিনের জীবন যুদ্ধ। গত সাত মাস ট্রেন বন্ধ। স্বপনের সংসারে যেন আচমকা বাজ পড়েছে। রোজগার নেই। থমকে গিয়েছে সবকিছু। আধপেটা খেয়ে চলছে কোনওরকমে। সেদিন দমদম স্টেশনের বাইরে দেখা হতেই অঝোরে কান্না। ‘দাদা যাব কোথায় বলতে পারেন, ট্রেন বন্ধ। সিনেমা হল খুলছে না। পার্কেও আজকাল আর তেমন লোক আসে না। বয়স্করা তো নয়ই। সেদিন রাস্তায় একটা বাচ্চা হাত বাড়াতেই তার মা বলল, ওসব বাইরের জিনিস খেতে নেই বাবা, করোনা হবে! অথচ শপিং মল থেকে তো দিব্যি দামি চিপসের প্যাকেট বিক্রি হচ্ছে। করোনা কি শুধু গরিব মানুষের থেকে ছড়ায়!’ ওর প্রশ্নের কোনও উত্তর আমি দিতে পারিনি।
সান্ত্বনা দিতে পারিনি রতনকেও। আগমার্কা স্বার্থপর ভদ্রলোকের মতো এ কথা সে কথার ফাঁকে পালিয়ে এসেছি নিজের নিরাপদ চৌহদ্দিতে। দমদম থেকে শিয়ালদহ ট্রেনে দশ টাকায় পাঁচটা ডট পেন বিক্রি করত রতন। কেউ একসঙ্গে কুড়ি টাকার কিনলে আরও একটা পেন বাড়তি। তাতেই কোনওরকমে চলত মা, স্ত্রী আর তিন ছেলেমেয়েকে নিয়ে রতনের কষ্টের সংসার। ট্রেন বন্ধ দুশো দিনের ওপর।
বন্ধ স্কুলও। কোথায় যাবে রতনরা? তার ওপর পড়াশোনা তো সব অনলাইনে। পরীক্ষাও ট্যাবে-ল্যাপটপে। পেনের প্রয়োজন ফুরোচ্ছে। শশা আর পেয়ারা কেটে নুন মাখিয়ে উল্টোডাঙা প্ল্যাটফর্মের সাবওয়ে দিয়ে নামার মুখে বসত হরিসাধন। এখন
বসে স্টেশনের বাইরে রাস্তায় এককোণে। দিনে বার কয়েক লাঠির ঘা আর তাড়া খেতে হয় পুলিসের। স্টেডিয়ামে খেলা থাকলে ছুটত সেখানে বাড়তি লাভের আশায়। সঙ্গে ছোট ছেলেকে নিত চা বিক্রি করতে। সীমাহীন দারিদ্র্য ওই একরত্তি ছেলেটাকেও কত তাড়াতাড়ি কাজে ঢুকিয়ে দিয়েছে। স্কুল, সিনেমা হল, লোকাল ট্রেনের মতো স্টেডিয়ামের খেলাও
তো বন্ধ। চেনা জীবনের ছন্দটাই কখন যেন হারিয়ে গিয়েছে। জিজ্ঞেস করেছিলাম, বিক্রি কিছু হচ্ছে
তো? ফ্যাকাসে মুখটা কোনওরকমে তুলে বলেছিল, বাইশ বছরের অভ্যাস তাই রোজ এসে বসি।
ট্রেন নেই, লোক কোথায়। যা হচ্ছে তা দিয়ে পেট
চলে না দাদা। আর বাড়িতে থেকেই বা কী করব,
তাই সব ভুলে থাকতে এসে বসে থাকি অনেকদিনের চেনা জায়গাটায়!
আগস্টে আবার ট্রেন চলবে শুনে মনের কোণে এক চিলতে আশার আলো জ্বলেছিল বটে। মনে হয়েছিল, পুজোর আগে আবার সব বুঝি ঠিক হয়ে যাবে। আবার গমগম করবে স্টেশন, প্ল্যাটফর্ম। মানুষের পায়ে পায়ে বিকোবে বাদাম, ডট পেন, লজেন্স, কাটা শসা, পেয়ারা। জীবন আবার চলবে পুরনো গতিতে। এখন ওই আশাটুকুও ক্ষীণ হতে হতে মিলিয়ে গিয়েছে। সবাই বুঝে গিয়েছে এবার পুজোয় লোকাল চলার আশা নেই। তাই শিয়ালদহ থেকে কৃষ্ণনগর, হাওড়া থেকে তারকেশ্বর, উল্টোডাঙা থেকে বনগাঁ একের পর এক স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম ঘিরে যে অভাবী মুখগুলো লড়াই করে বেঁচে ছিল, তাদের স্পন্দনটাই কখন যেন থমকে রয়েছে। কে না জানে লোকাল ট্রেন আর প্ল্যাটফর্মগুলিকে আশ্রয় করে যত মানুষ এই বাংলায় বেঁচে থাকেন তা হার মানাতে পারে কয়েকশো বড় কারখানাকেও। ওদের কাছে এবারের পুজোটা তাই অনেক আগেই হারিয়ে গিয়েছে।
ছোটবেলায় আমাদের স্কুলের ঠিক বাইরে সদানন্দ বসত হজমি গুলি আর লাঠি লজেন্স নিয়ে। সঙ্গে ছোট ছোট কুল আর আচার। বিক্রিবাটার ফাঁকে অনেক মজার মজার গল্পও বলত। টিফিনের সময় সে কী ভিড়। সদানন্দকে শেষ দেখেছি কাঠি আইসক্রিম বিক্রি করতে। তারপর ওর ছেলেও কাঠের গাড়ি ঠেলে আইসক্রিম নিয়ে স্কুলের বাইরে বসত। ফুচকা বেচত সজল। অনেক দিন আর ওদের খোঁজ পাইনি। আসা যাওয়ার পথে দেখাও হয়নি। কে জানে এই আকালের সময়ে কেমন রয়েছে ওরা!
যাদের অনেক আছে পুজো মানেই তাদের কাছে নতুন জামা কাপড় জুতো আর রংবাহারি নানা কিসিমের শাড়ি কেনার গল্প। তবু সেই সম্পন্ন ঘরেও ষষ্ঠীতে তাঁত, সপ্তমীতে জামদানি আর অষ্টমীতে বালুচরীর হিসেবনিকেশেও এবার যেন অদ্ভুত ভাটা। বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসবের একশো ঘণ্টাও আর বাকি নেই। কিন্তু মনটা আগের মতো আর আনচান
করছে না। খুশির ঝিলিকে উদ্বেল হচ্ছে না। পুজোটা কেমন করে কাটাব, তার বদলে বিজয়া দশমী পর্যন্ত সুস্থ থাকব তো, আলোচনা তা নিয়েই। মন কেমন করা এক আশ্চর্য বিষণ্ণতা বাসা বেঁধেছে মনের কোণে। বদলে যাওয়া সময়ে নিজেকে সাজিয়ে তোলার ইচ্ছেটাকেই কখন যেন মেরে ফেলেছে করোনা! মুখ ঢেকেছে মাস্কে। মহামারী মোকাবিলার অস্ত্র বলতে তো ওই মাস্ক আর স্যানিটাইজার। পুজোয় আদৌ ঠাকুর দেখতে বেরবে কি না, বেরনো উচিত কি না, সেই দোলাচলে আজ বাঙালি। তবে এবার বাৎসরিক ঠাকুর দেখার মিছিলে হাঁটা থেকে বিরত থাকাটাই বিবেচকের কাজ হবে। বেঁচে থাকলে আসছে বছর আবার হবে, এই স্লোগানে ভর করেই আপাতত পরের বছর আশ্বিনের শারদ প্রাতের অপেক্ষায় কাটুক দিন। ততদিনে সবার শরীরে ভ্যাকসিনও ঢুকে যাবে। পরাজিত হবে করোনাসুর। আবার আগমনি সুর বাজবে, মা আসবেন ভুবন ভোলানো রূপে। মলো মাসের ভ্রূকুটি নয়, মহালয়ার সঙ্গে সঙ্গেই রটে যাবে মহাশক্তির আগমন বার্তা।
মন্মথ গত দশবছর হকারি করে গড়িয়াহাটে। বলছিল, লকডাউনের ঠেলায় গত ৬ মাস বাজারটা শ্মশান হয়ে গিয়েছিল। অভ্যাসবশত এসে বসতাম। চা মুড়ির পয়সাও উঠত না। গত দু’সপ্তাহ একটু লোকের মুখ দেখতে পাচ্ছি। তবু তা বলার মতো নয়। তাতেই আপনারা বলছেন, ভিড় একদম নয়, করোনা ছড়াবে। তা পেটটা তো মানবে না। ওইটুকু বিক্রিতে গত সাতমাসের লোকসানই মিটবে না। আর তো বাকি কয়েকটা দিন। তারপরই উৎসব মিটে গেলে আবার মুখ থুবড়ে পড়বে কেনাকাটা। মন্মথর আক্ষেপ, করোনা থেকে বাঁচলেও এরকম চললে অনাহার যে মেরে ফেলবে আমাদের!
পুজোর বেশ একমাস আগে থেকে যাঁরা নিত্যনতুন জায়গায় বেড়াতে যাওয়ার প্ল্যান করেন। বড় মামার বয়স হয়েছে, কোমরে ব্যথা। তাঁর জন্য একটা লোয়ার বার্থ চাই। হলিডে হোমটা সমুদ্রের কাছে তো। হোটেলের ঘর থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা......? এবার সেইসব অন্তহীন কলকাকলি কবেই যেন থামিয়ে দিয়েছে নিষ্ঠুর করোনা দৈত্য। গাড়িতে চেপে ছোটখাটো ট্যুর কিছু হলেও পর্যটন শিল্পটাই ঘুমিয়ে পড়েছে। সেখানেও আয় হারিয়েছে শতশত মানুষ। সংক্রমণ কমছে না বাড়ছে, ভ্যাকসিন কবে আসছে সেই দিকেই তাকিয়ে ওরা।
আর আমি সামান্য কলমচি এই পুজোর ৬ মাস আগেই হারিয়েছি জীবনের শ্রেষ্ঠ আশ্রয় মাকে। লকডাউনের শুরুতে। যত রাতই হোক অফিস থেকে আমার বাড়ি ফেরা পর্যন্ত জেগে থাকত যে দুটো স্নেহভরা সজাগ চোখ, তাঁকে হারানোর চেয়ে বড় ক্ষতি মানবজীবনে আর হয় নাকি? এই পুজো তাই ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে অপূরণীয় ক্ষতির। নিজের শিকড় হারানোর।