উচ্চবিদ্যার ক্ষেত্রে মধ্যম ফল আশা করা যায়। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সাফল্য আসবে। প্রেম-প্রণয়ে নতুনত্ব আছে। কর্মরতদের ... বিশদ
এই খাদ্য সমস্যা অর্থাৎ কৃষি উৎপাদনের ঘাটতির সুযোগ নিয়ে বিরোধী বামপন্থীরা প্রচার আন্দোলন তুঙ্গে নিয়ে যায়। রাজনৈতিক সুফলও পায়। সেই কথাটি মনে রেখেই ১৯৭৭ সালে ক্ষমতায় আসার পর জ্যোতি বসু সর্বাগ্রে জোর দিয়েছিলেন কৃষিতে। তাঁর সরকার ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ভূমি সংস্কার ও কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির উপর। সেই সুফলকেই সঙ্গে নিয়ে ৩৪ বছর ধরে পথ হেঁটেছিল সিপিএম। আর কী আশ্চর্য ঘটনা! ঠিক সেই কৃষির ইস্যুতেই তাদের পতন ঘটল। দুর্নীতি, দাদাগিরি, সিন্ডিকেট, রিগিং, প্রোমোটার-রাজ, শিক্ষা-স্বাস্থ্যকে অবহেলা ইত্যাদি তাবৎ বিরুদ্ধ-ইস্যুকে হারিয়ে বারংবার জয়ী হয়েছিল বামফ্রন্ট সরকার। কারণ, কৃষি ও ভূমি সংস্কারে গুরুত্ব। কিন্তু দক্ষিণবঙ্গের কলকাতা লাগোয়া একটি ক্ষুদ্র জনপদ সিঙ্গুর আর মেদিনীপুরের নন্দীগ্রামে প্রধানত কৃষিজমি দখল করা হচ্ছে এই প্রচারটিকেই পাখির চোখ করে এগিয়ে গেলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিস্ময়করভাবে ২০১১ সালে সেই কৃষি ও খাদ্যশস্য ইস্যুতেই সিপিএম হেরে গেল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। কংগ্রেসের থেকে বামপন্থীদের ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া, ক্ষমতায় থেকে যাওয়া এবং আবার বামপন্থীদের ক্ষমতা থেকে চলে যাওয়ার ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেছে কৃষি ও খাদ্যশস্যের মতো স্পর্শকাতর একটি ইস্যু।
এই প্রসঙ্গ উত্থাপন করার কারণ, ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার লক্ষ্যে বিজেপি বহু প্ল্যান প্রোগ্রাম করেও এখনও এমন কোনও পাখির চোখ করার মতো জ্বলন্ত ইস্যু ধরতে পারেনি। একটি নিশ্চিত কোনও ইস্যুতে রাজনৈতিক ডিসকোর্স তৈরি করতে পারেনি। কোনও একটি ইস্যুতে সরকার বিরোধিতাকে চরম পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার মুন্সিয়ানা বঙ্গবিজেপি দেখাতে পারেনি। হিন্দুত্ব, সংখ্যালঘু তোষণ, দুর্নীতি ইত্যাদি নানাবিধ বিক্ষিপ্ত ইস্যুতে তারা আটকে রয়েছে। কিন্তু কৃষি, শিল্প, খাদ্য, কর্মসংস্থান ইত্যাদি নিয়ে এখনও ফোকাসড কোনও ইস্যু নেই। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো রাজনৈতিকভাবে তীক্ষ্ণ ব্যক্তিত্বকে পরাস্ত করার জন্য যে সুতীব্র গেমপ্ল্যান দরকার, সেটা এখনও চোখে পড়ছে না বিজেপির রাজনীতিতে। অথচ বিজেপির জনসমর্থন রয়েছে এবং হয়তো বাড়ছেও। সিপিএম সমর্থকদের বড় অংশের ভোট তো থাকবেই তাদের কাছে। কিন্তু ধারাবাহিক জনস্বার্থের রাজনৈতিক ইস্যু ও কর্মসূচি নেই। শুধু নবান্ন অভিযানের রঙিন জলসিক্ত ছবি ভোটে প্রতিফলিত হয় না।
এই সঙ্কটের অন্যতম কারণ হল, বঙ্গবিজেপি সম্পূর্ণভাবে কেন্দ্রীয় বিজেপি এবং নরেন্দ্র মোদি নির্ভর একটি সংগঠনে পরিণত করে রেখেছে নিজেকে। বস্তুত অতিরিক্ত মোদি নির্ভরতাই বঙ্গবিজেপির অন্যতম প্রধান দুর্বলতা। বুথ স্তরের সংগঠন, বিধানসভা কেন্দ্রের প্রার্থী নির্বাচন, ব্লকে ব্লকে একাধিক মুখকে পরিচিত নেতা হিসেবে তুলে আনা ইত্যাদি কাজ কিন্তু মোদি করবেন না। এটা করতে হয় রাজ্যের দলটিকেই। কিন্তু সেটা করার মতো রাজনৈতিক প্রাজ্ঞতাই নেই বঙ্গবিজেপির। তাদের সমস্যা হল, তারা মুখে অভিযোগ করে যে, কংগ্রেস একটি হাইকমান্ড নির্ভর দল, অথচ নিজেরাও সেই হাইকমান্ড নির্ভরই হয়ে গিয়েছে। বিজেপির তরফে বাংলার জন্য যে কোনও রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় দিল্লি থেকে। রাজনৈতিক অবস্থান গ্রহণের জন্য এ রাজ্যে মাঝেমধ্যেই আসেন দিল্লির পাঠানো নেতারা। বস্তুত বাংলার দলটির নীতি নির্ধারণ করেন নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহ। সেটা হতেই পারে। সর্বভারতীয় দলের নিয়ম। কিন্তু সেই নীতি ও সিদ্ধান্তগুলি প্রয়োগ করতেও পাঠানো হয় কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষকদেরই। অর্থাৎ মমতা বন্দোপাধ্যায়ের সঙ্গে বঙ্গবিজেপিকে কীভাবে লড়াই করতে হবে, বাংলায় কোন কোন ইস্যুকে টার্গেট করতে হবে এটা যে বিজেপি নেতারা সারাবছর বাংলায় বাস করছেন, তাঁদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার একক অধিকার নেই। হয়তো তাঁরা প্রস্তাব দেন, সুপারিশ করেন, ইস্যুকে আইডেন্টিফাই করেন বিভিন্ন বৈঠকে। কিন্তু চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে আসেন কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক ও শীর্ষ নেতারা।
অতিরিক্ত কেন্দ্রীয় দলনির্ভরতার কুফল হল, একটি কমিউনিকেশন গ্যাপ তৈরি হয়। অর্থাৎ বাংলার সংস্কৃতি, সমাজ, রাজনীতির যে দৈনন্দিন আটপৌরে একটা ছন্দ আছে, সেটা কখনও বহিরাগত রাজনীতিকদের পক্ষে আত্মস্থ করা সম্ভব হয় না। তাঁরা একটা ফর্মুলা মেনে হয়তো অগ্রসর হন। কিন্তু যে মডেল অসমে সফল হয়েছে, সেই একই মডেল বাংলায় চলবে তার নিশ্চয়তা নেই। আর এভাবে দুটি ক্ষতি হচ্ছে। প্রথমত, বঙ্গবিজেপি নেতাদের নিজস্ব একক ভাবমূর্তি তৈরি হতে পারছে না। আর দ্বিতীয়ত, মোদি বা অমিত শাহদের যে কোনও ব্যর্থতার বোঝাও বহন করতে হচ্ছে। সর্বভারতীয় দলের হয়ে রাজ্যে রাজনীতি করার এটা একটা প্রধান সমস্যা। উত্তরপ্রদেশে দলিত কন্যার ধর্ষণ হয়েছে, সে ব্যাপারে তীব্র নিন্দা না করে সাফাই গাইতে হচ্ছে। কারণ ওই রাজ্যে বিজেপি ক্ষমতাসীন। দেশে অর্থনীতি ডুবে যাচ্ছে। সেটা বুঝতে পেরেও কেন্দ্রের স্বপক্ষে অবান্তর যুক্তি দিতে হচ্ছে রাজ্য বিজেপিকে। এসব থেকে বাঁচার উপায় ছিল। যদি বঙ্গবিজেপির নেতৃত্ব নিজেরাই একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ইস্যুর নির্মাণ করতে সক্ষম হতেন। সেটাতেই ফোকাস করতেন। রাজ্যবাসী সেই ইস্যুকে আগ্রহ নিয়ে দেখত। কিন্তু সেটা তাঁরা পারছেন না।
কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের বহু স্লোগান, বহু বিবৃতি, বহু চাপিয়ে দেওয়া সংস্কৃতি যে বাংলার মানুষের কাছে অতটা পরিচিত নয়, সেটা বুঝতে পেরেও বঙ্গবিজেপিকে বাধ্য হয়ে সেই প্রচারই করতে হচ্ছে। একইসঙ্গে বিজেপির অন্যতম সমস্যা হল, নিচুতলায় দলে দলে সিপিএমের আগ্রাসী ক্যাডারবাহিনী চলে এসেছে। তারা বিজেপির স্থানীয় নেতাকর্মীদের পাত্তাই দেয় না। সুতরাং প্রকৃত পুরনো বিজেপি নেতাকর্মীদের ক্ষোভ তৈরি হচ্ছে। আবার উল্টোদিকে উপরতলায় দেখা যাচ্ছে, গুরুত্ব দখল করে নিচ্ছেন তৃণমূল থেকে আসা নেতারা। তাঁদের অভিজ্ঞতাকেই কাজে লাগাতে সচেষ্ট কেন্দ্রীয় বিজেপি নেতৃত্ব। তার জেরে বিজেপির পুরনো নেতারা কোণঠাসা অনুভব করছেন। তৃতীয় সমস্যা হল, বিজেপি যখন শক্তিশালী হয়নি, তখন প্রধানত রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের অনুগামী, শাখায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদেরই বেশি ভিড় ছিল। কিন্তু যখন বিজেপি রাজ্যে শক্তিশালী হচ্ছে তখন নেতা ও কর্মী হিসেবে এমন একটি শ্রেণী প্রথম সারিতে চলে এসেছে, যাদের সঙ্গে আর এস এসের কোনও সম্পর্কই ছিল না কোনওদিন।
মমতা বন্দ্যোপাধায়ের এটা সুবিধা। তাঁর কোনও হাইকমান্ড নেই। সিদ্ধান্ত তিনিই গ্রহণ করেন। বিজেপি অথবা কংগ্রেসের এই সমস্যাটি প্রকট। কংগ্রেস আজ যতই বলুক বামেদের সঙ্গে জোট করবে, সেটা ততক্ষণ পর্যন্ত ১০০ শতাংশ নিশ্চিত নয়, যতক্ষণ তাদের হাইকমান্ড সবুজ সংকেত দেবে। কখন যে সোনিয়া গান্ধী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে ফোনে কথা বলে কোনও একটি রাজনৈতিক ইস্যুতে আবার বৈঠক ডাকবেন, সেটা বঙ্গ কংগ্রেস নেতৃত্ব জানে না। হয়তো দেখা যাবে অন্য রাজ্য থেকে আসা কোনও পর্যবেক্ষক বঙ্গ কংগ্রেসের প্রার্থী নির্বাচন কিংবা কর্মসূচি গ্রহণের অন্যতম সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী হয়ে যাবেন।
বঙ্গবিজেপিরও তাই। নির্বাচনে কোন কেন্দ্রে কে প্রার্থী হবেন তা বঙ্গবিজেপির হাতে পুরোপুরি নেই। সুতরাং বঙ্গবিজেপি এবং বঙ্গ কংগ্রেসের নেতৃত্বের সবথেকে বড় সঙ্কট হল, তারা পরাধীন। সিদ্ধান্তগ্রহণে স্বাধীন নয়। দিল্লি থেকে আসে তাঁদের ভবিষ্যৎ যে কোনও কর্মপন্থার কনফামের্শন। ফলে রাজ্যস্তরে যে কোনও ইস্যুতে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারছে না তারা। যেটা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পেরেছিলেন। কখনও ব্যর্থ হয়েছেন। কখনও সফল হয়েছেন। কিন্তু নিরন্তর একটা ট্রায়াল অ্যান্ড এররের মধ্যে দিয়েই তিনি এগিয়েছেন। সর্বোপরি তিনি এই রাজ্যের ভূগোলটি হাতের তালুর মতো চেনেন। প্রতিটি জেলা, ব্লক তাঁর মুখস্থ। এটা রাজনীতিতে প্রচণ্ড প্রয়োজন। গাড়িতে, বাইকে, পদযাত্রায়, মিছিলে গোটা রাজ্যে অবিরত দৌঁড়ে বেড়াচ্ছেন, এরকম বিরোধী নেতা আর দেখা যাচ্ছে না কেন? রাজনীতিতে একটা পরিভাষা আছে। ফেস রেকগনিশন। অর্থাৎ একজন নেতাকে যে কোনও প্রত্যন্ত প্রান্তের মানুষও চিনে গিয়েছেন। নামে ও চেহারায়। জওহরলাল নেহরু, ইন্দিরা গান্ধী, নরেন্দ্র মোদিরা সেই গোত্রের। এ রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার বহু বছর আগেই সেই শ্রেণীভুক্ত হয়ে গিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিরোধী নেতাদের কেউ সাড়ে ৯ কোটি বঙ্গবাসী তথা জাতীয় স্তরে ফেস রেকগনাইজড পার্সোনালিটি হতে পারছেন না। রাজনীতিতে সোশ্যাল মিডিয়া কিন্তু শেষ কথা নয়!