কর্মপ্রার্থীদের কোনও সুখবর আসতে পারে। কর্মক্ষেত্রে পদোন্নতির সূচনা। গুপ্ত শত্রু থেকে সাবধান। নতুন কোনও প্রকল্পের ... বিশদ
আজ মোদি সরকারের ব্যর্থতায় দেশের মানুষ ক্লান্ত। কিন্তু দেশের মানুষের হাতে গণতন্ত্রের হাতকড়া। গণতন্ত্রই মোদিজিকে দিয়েছে পাঁচ বছরের জন্য দেশ শাসনের অধিকার। মনে পড়ে যাচ্ছে ২০১৪ সালে তৈরি সলমন খানের মশলা সিনেমা ‘জয় হো’র একটি সংলাপ। সেখানে মন্ত্রীর ভূমিকায় অভিনেতা ড্যানির মুখে সংলাপটা বসানো হয়েছিল। তিনি বলছেন, ‘আমি যখন প্রতিরক্ষামন্ত্রী ছিলাম, তখন আমার কুর্সি হঠাৎ নড়বড়ে হয়ে গেল। সেই সময় আমি গদি বাঁচাতে একটা সাজানো আতঙ্কবাদী হামলা করিয়ে দিলাম। সেই অ্যাটাকে আমাদের কিছু সেনা শহিদ হয়ে গেল। সেটাকে ইস্যু করে সারাদেশে দেশভক্তির ঝড় তুলে দিলাম। ব্যস আমার গদিও বেঁচে গেল।’ এইটুকই সংলাপ। সেটা কতটা তাৎপর্যপূর্ণ,বোঝা গেল ঠিক ৫ বছর পরে। ২০১৯ সালে পুলওয়ামার ঘটনা মনে করলে সেই একই ছকের কথা মনে পড়ে যায় না কি? ভোটের আগে সেই সন্ত্রাসবাদী আতঙ্ক, বীর সেনাকর্মীদের শহিদ হয়ে যাওয়া, দেশজুড়ে দেশভক্তির সুনামি এবং সেই আবেগের দোলায় চড়ে নরেন্দ্র মোদির বিপুল ভোটে ফিরে আসা। এরপর উত্তরপ্রদেশের ঘটনা দেখুন, সেখানে হাতরাসের নৃশংসতম ঘটনাকে কেন্দ্র করে যোগী সরকারের ভূমিকা নিয়ে সারা দেশে যেই একটা সমালোচনার ঝড় উঠল, তাঁর পদত্যাগের দাবিতে সারাদেশ যেই উত্তাল হয়ে উঠল, অমনি যোগী সরকার একটা বিদেশি ফান্ডিং আবিষ্কার করে হাওয়া ঘোরাতে চাইল। বিদেশ থেকে নাকি একশো কোটি টাকা ঢালা হয়েছে উত্তরপ্রদেশে দাঙ্গা করার জন্য। কী বড় চক্রান্ত রে বাবা! মৃত দলিত মেয়েটাকে জন্তুর মতো পুড়িয়ে উত্তেজনায় ইন্ধন দিয়েছে তো যোগী প্রশাসনই।
সেই অন্যায় নিয়ে মুখ বন্ধ কেন? প্রশাসন কোনও অন্যায় করেনি। হাতরাসের ঘটনার পর সেখানে উচ্চবর্ণের যে উল্লাস ও হুমকি দেখা গিয়েছে, তাতে তারাও কোনও অন্যায় করেনি। আর সাংবাদিকরা সত্য উন্মোচনের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়লেই সরকার সাজিশের গন্ধ পেয়ে যায়। হতভাগ্য মেয়েটির মা তাঁর মৃত মেয়েকে সৎকার করার অধিকার দাবি করলে বিদেশি ফান্ডিং সংক্রান্ত ষড়যন্ত্রের গালগপ্পো এসে হাজির হয়। বিদেশি ফান্ডিংয়ের সাজানো গল্প এনে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার এও তো এক রদ্দি ছক। প্রশাসন হাতে থাকলে সব কাল্পনিক গল্পকেই বাস্তবের চিত্রনাট্যে সাজিয়ে নেওয়া যায়।
এভাবেই সুশান্ত সিংয়ের আত্মহত্যা, শাহিনবাগ, সিএএ, এমনকী করোনা ছড়িয়ে পড়ার মধ্যেও কেন্দ্রীয় সরকার চক্রান্তের গন্ধ পায়। সুশান্ত সিংয়ের আত্মহত্যা নিয়ে সরকারই রাজনীতি করল। খুন বলে চালানোর চেষ্টা করল, রিয়া চক্রবর্তী গ্রেপ্তার হলেন, কঙ্গনা রানাওয়াত সেই চক্রান্তের গন্ধে একটু ঘৃতাহুতি দিয়ে ওয়াই প্লাস ক্যাটিগরির নিরাপত্তা নিয়ে চলে গেলেন। শেষ পর্যন্ত নিশানা ঘুরে তদন্তের অভিমুখ হল বলিউডে মাদক যোগ। তার মানে পর্বতের মূষিক প্রসব হল। মনোমতো কিছু না হলেই সরকারের আচরণের মধ্যে প্রকাশ্যে একটা উষ্মা দেখা যাচ্ছে। সহনশীলতার অভাব দেখা যাচ্ছে। ঠিক এই কথাটাই দিন কয়েক আগে সুপ্রিম কোর্ট কেন্দ্রকে বলেছে। তবলিগি মামলায় সুপ্রিম কোর্ট অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেছে, সাম্প্রতিক সময়ে মানুষের বাক স্বাধীনতা সবথেকে নিষ্পেষিত।
মানুষের বাক স্বাধীনতাও দেশের জিডিপির মতো তলানিতে ঠেকেছে। মানুষ প্রতিবাদী হলে বা মুখ খুললে তাকে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এ ব্যাপারে সরকারের সবথেকে বড় অস্ত্র হল রাষ্ট্রদ্রোহ এবং ইউএপিএ মামলা। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে, গত বছরে রাষ্ট্রদ্রোহ সংক্রান্ত মামলার সংখ্যা বেড়ে গিয়েছে ১৬৫ শতাংশ এবং ইউএপিএ সংক্রান্ত মামলা বেড়েছে ৩৩ শতাংশ। কাউকে এই মামলায় সরকার বিনা বিচারে ১৮০ দিন পর্যন্ত আটকে রাখতে পারে। অর্থাৎ এখন এমন একটা সময়, যখন সরকারের ধামাধরা হলে দেশপ্রেমী এবং সমালোচনা করলে রাষ্ট্রদ্রোহী। তার গায়ে সেঁটে দেওয়া হয় চক্রান্তের তকমা।
দেশপ্রেম নিয়ে সুন্দর একটা কথা বলেছেন ইংল্যান্ডের লেখক জুলিয়ান বার্নস। তিনি স্পেনের সাহিত্যিক গুস্তাভ ফ্লবেয়ারের জীবনী নিয়ে একটি উপন্যাস লেখেন। তার নাম ‘ফ্লবেয়ার’স প্যারট’। সেই উপন্যাসে বার্নস অসাধারণ একটি মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘দেশ যখন ক্রমেই অন্যায়ের দিকে, ভয়ঙ্কর পরিণতির দিকে কিংবা অসম্মানজনক পরিস্থিতির দিকে গড়িয়ে চলে, তখন মাথা তুলে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করাটাই সাচ্চা দেশপ্রেম।’ কিন্তু আজ মোদি সরকারের কাছে দেশপ্রেমের অর্থ অন্যতর।
দেশ যখন আজ ঠিক এইরকম পরিস্থিতির সামনে দাঁড়িয়ে, তখন মনে পড়ে ৯২ বছরের মানুষটির কথা। তিনি হলেন লালকৃষ্ণ আদবানি। একদিন রামরাজ্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তাঁর যে রথযাত্রা, তারই ডিভিডেন্ড পাচ্ছে বিজেপি। কিন্তু আজ ঘরে বসে সেই নবতিপর মানুষটির কি একবারও মনে হচ্ছে না, যে রামরাজ্য তিনি চেয়েছিলেন, তার স্বরূপ এমনটা ছিল না? হিংসায়, বিভেদকামী মানসিকতায়, নিত্য ব্যর্থতায়, ধর্মবিদ্বেষে এবং দরিদ্র-বিরোধী পদক্ষেপে সরকারের যে দীনতা প্রকাশ পাচ্ছে, তা নিশ্চয়ই আদবানিজির কাঙ্ক্ষিত ছিল না। বাজপেয়ি-আদবানির আদর্শ থেকে আজ দল অনেক দূরে সরে গিয়েছে। মোদি সরকারের একের পর এক ভুল সিদ্ধান্তে মানুষের ক্ষোভ বাড়ছে। এখন সত্যের খাতিরে কি আদবানি মুখ খুলবেন না? সত্যের থেকেও কি তবে দলের প্রতি তাঁর আনুগত্য অনেক বেশি? মনে রাখা দরকার, জীবনের শেষ প্রান্তে এসে ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকে সুশাসনের অনেক পরামর্শ দিয়েছিলেন। আজ সেই ভূমিকাতেই আদবাদিজিকে দেখতে চান দেশের মানুষ। ইন্দিরার অপশাসনের বিরুদ্ধে একদিন এই ভূমিকাই পালন করেছিলেন জয়প্রকাশ নারায়ণ। জীবনে আদবানিজি অনেকগুলি যাত্রা করেছেন। রথযাত্রা, জনাদেশ যাত্রা, স্বর্ণজয়ন্তী রথযাত্রা, ভারত উদয় যাত্রা, ভারত সুরক্ষা যাত্রা ইত্যাদি। আজ তাঁর আরও একটি যাত্রা করা উচিত, সেটা হল জনস্বার্থ সুরক্ষা যাত্রা। আজ আমাদের কোনওকিছুই যে সুরক্ষিত নয়।