কর্মে শুভ। নতুন কর্মপ্রাপ্তি বা কর্মসূত্রে দূররাজ্য বা বিদেশ গমন হতে পারে। আনন্দানুষ্ঠানে যোগদান ও ... বিশদ
গোর্খাল্যান্ডের দাবিকে সমর্থন করেনি কংগ্রেস। সিপিএমও বাংলা ভাগের বিরোধী। আর তৃণমূল সুপ্রিমোর সাফ কথা, পৃথক রাজ্য কিছুতেই নয়। তাই গোর্খাল্যান্ডই যাঁদের একমাত্র দাবি, তাঁদের কাছে এই তিনটি দলই অচ্ছ্যুৎ। বিজেপিই তাঁদের ‘আপনজন’। কারণ পৃথক রাজ্যের দাবিকে তারাই প্রশ্রয় দেয়। সমর্থনও করে। তাই লোকসভা নির্বাচনে পাহাড়ের গোর্খাল্যান্ড-পন্থী মানুষজন বিজেপিকে ঢেলে ভোট দিয়েছিলেন। ফের একটা নির্বাচনের মুখে দাঁড়িয়ে বাংলা। তাই আবার ভোট দরকার। সেই কারণেই অমিত শাহের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক খুঁচিয়ে তুলেছে গোর্খাল্যান্ড ইস্যু। কেন্দ্র গোর্খাল্যান্ড নিয়ে বৈঠক ডাকতেই গুরুং শিবির ঝাঁপিয়ে পড়ে। কারণ গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার সামনে পাহাড় দখলের হাতছানি। তৎক্ষণাৎ গুরুং ঘনিষ্ঠ রোশন গিরি দিল্লির বৈঠকের জন্য পাহাড়ের বিভিন্ন দলকে চিঠি দেয়। উদ্দেশ্য, গোর্খাল্যান্ড ইস্যুতে পাহাড়কে এককাট্টা করা।
কিন্তু, ২৪ ঘণ্টা কাটতে না কাটতেই বদলে যায় ছবিটা। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সংশোধনী দিয়ে জানায়, গোর্খাল্যান্ড নয়, আলোচনার বিষয় গোর্খা টেরিটোরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন(জিটিএ)। স্বপ্নভঙ্গের হতাশায় মোর্চার কেউ কেউ বলছেন, বিশ্বাসঘাতক!
বাঘের পিঠে চড়াটা অধিকাংশ রাজনৈতিক নেতারই নেশা। বাঘের পিঠে চাপলে তাকে কেউ ছোঁয়ার সাহস দেখায় না। তবে, বিপদও কম নয়। বাঘের পিঠে চড়লে নামাও যায় না। নামলেই যেতে হয় সেই বাঘের পেটেই। এটাই ভবিতব্য।
পুলওয়ামা ও বালাকোট কাণ্ডের আগে বিজেপির অবস্থা খুব একটা ভালো ছিল না। বিজেপির দখলে থাকা একের পর এক রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে হারছিল গেরুয়া শিবির। তাই লোকসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রয়োজনীয় আসন জোগাড়ের হিসেব মেলাতে পারছিল না। সেই কারণেই অবিজেপি রাজ্যগুলি থেকে যথাসম্ভব আসন দখলই ছিল গেরুয়া শিবিরের লক্ষ্য। তারমধ্যে ছিল পশ্চিমবঙ্গও।
বিজেপির দিল্লির নেতারা বুঝেছিলেন, পাহাড়ের মানুষ যার দিকে, দার্জিলিং আসন তার। শুধু দার্জিলিংয়েই নয়, আশপাশের জেলাতেও নেপালি মানুষের সংখ্যা প্রচুর। তাই যে কোনও মূল্যে তাঁদের পাশে পেতেই হবে। সেই কারণে লোকসভা ভোটের আগে শিলিগুড়িতে নির্বাচনী জনসভায় নরেন্দ্র মোদি গোর্খাদের স্বপ্নপূরণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। আর তাতেই বিজেপি ফায়দা তুলেছিল ষোলো আনা। পৃথক রাজ্যের দাবি পূরণের আশ্বাস দিয়ে দিল্লির বিজেপি নেতৃত্ব সেই বাঘের পিঠেই চেপে বসেছে।
বিভাজন যত, শাসন করা ততই সহজ। শিখিয়ে গিয়েছে ইংরেজ শাসকরা, ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’। ইংরেজরা দেশ ছাড়লেও তাদের শিক্ষা জনপ্রিয় হচ্ছে দিন দিন। তাই বিভেদ সৃষ্টির লক্ষ্যে রাজনীতিতে ছড়ানো হচ্ছে বিদ্বেষের বীজ। দেওয়া হচ্ছে বিচ্ছিন্নতায় মদত। পাহাড়, সমতল, জঙ্গলমহল-সর্বত্র।
এগিয়ে আসছে এরাজ্যের বিধানসভা ভোট। তাই আবার দরকার বিমল গুরুংদের সমর্থন। তবে, এবার প্রয়োজনটা আরও বেশি। কারণ ভারত দখলের চেয়েও বঙ্গজয় কঠিন। লোকসভা ভোটে বিরোধী শিবির ছিল বহুধাবিভক্ত। ছিল না গ্রহণযোগ্য মুখ। তার পুরো বেনিফিট পেয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদি। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা ভোটে বিজেপির লড়াই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে। যাঁর মজ্জায় রুখে দাঁড়ানোর জেদ, আর রক্তে রয়েছে লড়াই। তাই গিমিক বা চটকদারিতে কিস্তিমাত অসম্ভব।
লড়াই এবার ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে। প্রতিটি আসনই বিজেপির জন্য ভীষণ মূল্যবান। গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার পাশে পাহাড়ের তিনটি আসন নিশ্চিত। আশপাশের জেলার আরও পাঁচ সাতটি আসনেও থাকবে অ্যাডভান্টেজ। লড়াই কাঠে কপাটে হলে ক্ষমতা দখলের জন্য এই সংখ্যাটাই অনেক। তাই গোর্খাল্যান্ড ইস্যুকে ফের জাগিয়ে তোলার চেষ্টা।
এই মুহূর্তে বিমল গুরুং প্রবল চাপে আছেন। একটা সময় তাঁর কথায় ওঠবস করত পাহাড়। এখন তিনিই পাহাড়ে ঢুকতে পারছেন না। মাথার উপর ঝুলছে দেশদ্রোহিতার মামলা। বিজেপিই তাঁর একমাত্র বন্ধু এবং রক্ষাকর্তা। তাও তিনি বিজেপির উপর গোর্খাল্যান্ডের দাবিতে চাপ বাড়াচ্ছেন। কারণ গুরুং খুব ভালো করেই জানেন, দর কষাকষির এটাই মোক্ষম সময়। পৃথক রাজ্য গঠনের সরকারি আশ্বাস জোগাড় করতে না পারলে তিনি আরও গাড্ডায় পড়বেন। তাই তিনিও মরিয়া। আবার বিজেপিরও আসন দরকার।
সেই কারণেই ত্রিপাক্ষিক বৈঠক ডেকে গোর্খাল্যান্ড ইস্যুটা ফের চাগিয়ে তোলার চেষ্টা। তবে, গাড়ি সামনের দিকে গড়ানোর আগেই ‘ব্যাক গিয়ারে’। ত্রিপাক্ষিক বৈঠক ডাকার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই এজেন্ডা সংশোধন। গোর্খাল্যান্ড এর বদলে জিটিএ। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক বলছে, ভুল করে নাকি ‘গোর্খাল্যান্ড’ লেখা হয়েছিল। এই যদি দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের হাল হয় তাহলে যথেষ্ট চিন্তার বিষয়।
গোর্খাল্যান্ড ইস্যুতে বৈঠক ডাকলে রাজ্য যে যোগ দেবে না, সেটা বিজেপি নেতারা জানতেন। রাজ্য না গেলে ত্রিপাক্ষিক বৈঠক মূল্যহীন। বিজেপি নেতৃত্ব বিমল গুরুংকে বোঝাতে পারত, তারা পাশে আছে, কিন্তু তৃণমূল চাইছে না। বিজেপি নেতৃত্ব তখন বোঝাতে পারত, পৃথক গোর্খাল্যান্ড রাজ্যের জন্য বাংলা দখল প্রয়োজন। তাতে সাপও মরত লাঠিও ভাঙত না।
তবে, দিল্লির বিজেপি নেতৃত্বের সেই ‘গেম প্ল্যান’ সফল হয়নি। কারণ বৈঠক নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ খোলেননি। উল্টে বঙ্গ বিজেপিই প্রতিবাদ জানিয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে। রাজ্য নেতৃত্ব নাকি দিল্লিকে বুঝিয়েছে, নির্বাচনের আগে গোর্খাল্যান্ড ইস্যুতে বৈঠক ডাকলে ফের পাহাড়ে অস্থিরতা তৈরি হবে। তাতে সমতলে দলের ভোট হারানোর আশঙ্কা প্রবল। কারণ রাজ্যের অধিকাংশ মানুষই বাংলা ভাগের বিরোধী। আর সেই কারণেই নাকি এই ডিগবাজি!
এখন একটা বিষয় দেখার, অমিত শাহের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক এবং বিজেপি নেতৃত্বের রাতারাতি ভোল বদলের বিষয়টি গোর্খাল্যান্ডপন্থীরা কীভাবে নেন। তাঁরা যদি বোঝেন, বিজেপি ছাড়া উপায় নেই। তাহলে রামকৃষ্ণদেবের পরামর্শ মেনে চলবে। ফোঁস করবে কিন্তু ছোবল মারবে না। আর যদি মনে করে, বিজেপি ফের ‘গাজর’ ঝুলিয়ে ভোট নিতে চাইছে, তাহলে ২০২১ সালের ভোটে সব চেয়ে বড় চমকটা দেবে পাহাড়ই।
ময়দানে নেমে পড়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। করোনার জন্য মিছিল মিটিং না করলেও ফাঁকফোকর মেরামতের চেষ্টা চালাচ্ছেন। গরিব মানুষকে চাল আর মাওবাদীদের প্যাকেজ দিয়ে জঙ্গলমহলে শান্তি ফেরানোয় ২০১৬ সালে মানুষ উজার করে ভোট দিয়েছিল। তারপরেও লোকসভা ভোটে জঙ্গলমহলে বিপর্যয় ঘটেছে। তার কারণও ছিল। সরকারি প্রকল্পের সুবিধা দেওয়ার জন্য কাটমানি খাওয়া, বেআইনি বালি খাদানের টাকায় শাসক দলের নেতাদের ফুলেফেঁপে ওঠা সাধারণ মানুষ মেনে নিতে পারেনি। এছাড়াও মাওবাদীদের স্পেশাল প্যাকেজ দেওয়ার বিষয়টিকেও বিরোধীরা সুকৌশলে কাজে লাগিয়েছিল। বলেছিল, সরকার খুনিদের স্পেশাল প্যাকেজ দিচ্ছে, কিন্তু মৃতের পরিবারের প্রাপ্তি শূন্য।
তৃণমূল নেতৃত্ব বিরোধীদের এই প্রচারের মোকাবিলায় করতে পারেনি। জঙ্গলমহলে শান্তির জন্য মাওবাদীদের আত্মসমর্পণ করানোটাই ছিল সবচেয়ে জরুরি, সেটা তারা বোঝাতে পারেনি। তাই ক্ষোভ থেকেই গিয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী সেই ক্ষোভ দূর করতেই উদ্যোগী হয়েছেন। তিনি মাওবাদী হানায় মৃত ও নিখোঁজদের পরিবারকে আর্থিক ক্ষতিপূরণ ও চাকরি দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন। বেআইনি বালি বন্ধের কড়া বার্তা দিয়েছেন। জঙ্গলমহলের আস্থা অর্জনই তাঁর লক্ষ্য। কারণ সিঙ্গুর, নন্দীগ্রামের মতোই জঙ্গলমহল ও পাহাড় তাঁর কাছে আবেগ। তাই এবারও ঝাড়গ্রামে গিয়ে বলেছেন, অপনাদের কী চাই বলুন। আমি দেব। কিন্তু, দয়া করে দূরে সরে যাবে না।
কথায় আছে, ‘লেট ইস বেটার দ্যান নেভার’। দেরিতে হলেও মানুষের ক্ষোভ দূর করার জন্য মুখ্যমন্ত্রী এক এক করে পদক্ষেপ নিচ্ছেন। অনেকে বলছেন, তাঁর সংশোধনের ভাবনা ও পদক্ষেপ হতে পারে জঙ্গলমহলের ‘গেম চেঞ্জার’।