পুরনো রোগ চাগাড় দেওয়ায় দেহকষ্ট ভোগ করতে হতে পারে। তীর্থ ভ্রমণ ও ধর্মকর্মে আত্মিক তৃপ্তিলাভ। ... বিশদ
করোনা ভাইরাস সঙ্কট মোকাবিলায় ব্যর্থতা তাঁর পিছু নিয়েছিল অনেক আগে থেকেই। ফলে জনমত সমীক্ষাতেও তাঁর জনসমর্থন কিছুতেই ৪২ শতাংশের উপরে উঠছিল না। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে আয়কর ফাঁকি দেওয়ার ‘বোমা ফাটানো’ ঘটনা ও ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বী জো বিডেনের সঙ্গে প্রথম বিতর্কে গো-হার। এসব ছিল সেপ্টেম্বরের ঘটনা। অক্টোবরের প্রথম দিনই জানা গেল তিনি ও ফার্স্ট লেডি মেলানিয়া ট্রাম্প করোনায় আক্রান্ত। সঙ্গে দুই ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা, তিন সেনেটরসহ আরও ডজনখানেক ছায়াসঙ্গী। ঘটনার আকস্মিকতা ট্রাম্পের সব নির্বাচনী হিসাব-নিকাশ রীতিমতো ওলট-পালট করে দিচ্ছে। সিএনএন-র মতো মার্কিন মিডিয়াও বলতে বাধ্য হয়েছে, ট্রাম্পের জনসমর্থন আরও তলানিতে। সাময়িকভাবে হলেও তাঁর প্রচার শিবির যেন নাবিকবিহীন জাহাজ।
ট্রাম্পের জন্য প্রধান সমস্যা বিশ্বাসযোগ্যতা। গত সাত মাস করোনা ভাইরাসকে ‘হালকা ফ্লু’ বলে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। বারবার বলেছেন ‘ম্যাজিকের মতো’ এই ভাইরাস উধাও হবে। এই প্রশ্নে দেশের সেরা বিশেষজ্ঞদের মতামত উপেক্ষা করেছেন। তাঁদের লিখিত পরামর্শ তাঁর চাপে বদলে গিয়েছে। করোনার ভয়াবহতা খাটো করে দেখানোর জন্য তিনি প্রতিরোধক মাস্ক পরার ব্যাপারে অনীহা প্রকাশ করেছেন। জানা গিয়েছে, মাস্ক পরলে তাদের ‘দুর্বল’ দেখা যাবে—এই যুক্তিতে ট্রাম্প শুধু নিজে নন, হোয়াইট হাউসের কর্মচারীদেরও মাস্ক পরতে নিরুৎসাহিত করেছিলেন। ট্রাম্প এমন কথাও বলেছেন, বাইডেন যেভাবে নিজের মুখ কাপড়ে ঢেকে রাখেন, তাতে মনে হয় নিশ্চয় কোনও সমস্যা আছে। তাঁকে একজন মনোবিশারদকে দিয়ে দেখানো উচিত। এখন অবশ্য সব পরিহাসের লক্ষ্য ট্রাম্প নিজেই। একজন রিপাবলিকান নির্বাচনী কৌশলবিদ তো বলেই ফেলেছেন, নজর যত বেশি কোভিডের উপর পড়বে, ট্রাম্পের জন্য ততই বিপদ। তিনি চান আলোচনা হোক আগামীকাল নিয়ে। কিন্তু কোভিডের উপর নজর থাকা মানে সকলের দৃষ্টি থাকবে ট্রাম্প প্রশাসনের ব্যর্থতার উপর। স্বাভাবিকভাবেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ঘিরে এত আগ্রহ, ট্রল, পোস্ট ও মন্তব্য আগে কখনও দেখা যায়নি।
প্রেসিডেন্টের অসুস্থতা শেষ পর্যন্ত কত দূর গড়াবে, এই ভাইরাস ট্রাম্পের আর কোন কোন সহকর্মীর মধ্যে সংক্রামিত হবে, তার উপর নির্বাচনী প্রচারের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। এটা নিশ্চিত যে ট্রাম্প তাঁর এই করোনা রোগকে নিয়ে আসন্ন নির্বাচনে আরও অনেক নাটক করবেন। তাঁর হাসপাতালে থাকার দ্বিতীয় দিনে চিকিৎসকদের চরম উদ্বেগ সত্ত্বেও ট্রাম্প বেরিয়ে যান হাসপাতাল থেকে একটি ভ্যানে হাসপাতালের সামনে সমবেত অনুগ্রাহীদের অভিনন্দন জানানোর জন্য। তিনি দেখাতে চাইছেন তিনি এখন সুস্থ, তাঁকে নিয়ে সমর্থকদের কোনও চিন্তা করতে হবে না। শুধু তাই নয়, দু’দিনের মধ্যে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে হোয়াইট হাউসে চলে এসেছেন। হোয়াইট হাউসে ঢোকার আগে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছেন মুখের মাস্কও। তিনি দেখাতে চাচ্ছেন তিনি বীর, তাঁকে কোনও রোগই দাবিয়ে রাখতে পারবে না।
অনেকে মনে করেন, ট্রাম্প যদি করোনা থেকে সেরে ওঠেন, তাহলে তিনি নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে হয়তো বলবেন, এই ভাইরাসকে যতটা খারাপ বলে প্রচার করা হচ্ছে, আসলে ততটা নয়। প্রেসিডেন্ট যা কিছুই বলুন না কেন, তাঁর সেই বক্তব্য আমেরিকানদের মৃত স্বজনদের ফিরিয়ে আনতে বা কাজ হারানো ব্যক্তির কাজ ফিরিয়ে দিতে পারবে না। ট্রাম্প যদি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন, তাহলে হয়তো কট্টর ডানপন্থীদের পক্ষ থেকে নির্বাচন বাতিল কিংবা পিছিয়ে দেওয়ার দাবি উঠতে পারে। নির্বাচন পিছতে হলে কংগ্রেসের অনুমোদনের প্রয়োজন হবে এবং সেই অনুমোদন অসম্ভব। ট্রাম্পপন্থী সংবাদমাধ্যমগুলো ইতিমধ্যে ডাকযোগে ভোট দেওয়ার বিষয় নিয়ে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব প্রচার শুরু করে দিয়েছে এবং ট্রাম্প হারলে নির্বাচনের স্বচ্ছতা অস্বীকার করার জন্য জনমত গঠনের কাজও তারা চালিয়ে যাচ্ছে। যদি ট্রাম্প একটা বড় সময় ধরে নির্বাচনী প্রচার করতে না পারেন এবং শেষে হেরে যান, তাহলে তিনি নির্বাচনের ফলের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অজুহাত পাবেন। ভয়ের কথাটা শুনিয়ে রেখেছেন আমেরিকার লেইডেন ইউনিভার্সিটির ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক অধ্যাপক অ্যান্ড্রু গথোর্প। বলেছেন, যে প্রেসিডেন্ট অতিমাত্রায় আত্মপ্রেমে মগ্ন এবং মিথ্যাচারে আসক্ত, তিনি প্রতিকূল অবস্থায় পড়লে কী করে বসবেন, তা হয়তো আমরা এমন এক সময়ে টের পাব, যখন আর করার কিছু থাকবে না।
মার্কিন রাজনীতিতে ডোনাল্ড ট্রাম্পের আবির্ভাব হয়েছিল একজন সফল ব্যবসায়ী হিসেবে। দেশের অর্থনীতিকে ঠিক পথে ফেরাতে নিজেকেই সবচেয়ে যোগ্য লোক হিসেবে প্রচার করেন। প্রকাশ্যেই। আগের নির্বাচনে তিনি স্লোগান তুলেছিলেন ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’। সেই স্লোগানেই আটকে রয়েছেন এবারও। মার্কিন অর্থনীতির ক্ষত সারাতে তিনি যেসব রক্ষণশীল পদক্ষেপ নিয়েছেন, তার ভরকেন্দ্র ছিল ‘করদাতাদের অর্থের সফল ব্যবহারের’ বিষয়টি। কিন্তু নিউ ইয়র্ক টাইমসের সদ্য ফাঁস করা তথ্যে দেখা যাচ্ছে, অর্থনীতি পুনর্গঠন ও ব্যবসার কেন্দ্র হিসেবে আমেরিকাকে প্রতিষ্ঠা করার লড়াইয়ের স্বঘোষিত সেনাপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেই কর ফাঁকি দিয়েছেন। বছরের পর বছর।
প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সবচেয়ে বড় পরিচয় ছিল রিয়্যালিটি শো ‘দ্য অ্যাপ্রেনটিস’র বিচারক হিসেবে। আর পান থেকে চুন খসলেই বলে উঠতেন ‘ইউ আর ফায়ারড’। সেই অনুষ্ঠান নিঃসন্দেহে কঠোর প্রশাসক হিসেবে ট্রাম্পের একটি ভাবমূর্তি তৈরি করেছিল। সমর্থকদের কাছে নিজেকে একজন ‘লৌহমানব’ হিসেবেই তুলে ধরতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। যে কারণে বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন শহরে হিংসা ছড়িয়ে পড়লে ট্রাম্প অনায়াসে বলতে পারেন, সেনা মোতায়েনের কথা। নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে যেসব তথ্য উঠে এসেছে, তাতে সেই কঠোর প্রশাসকের মুখোশ এখন ট্রাম্পের মুখ থেকে খসে পড়েছে। দিনের পর দিন ‘কর দাতাদের অর্থের অপব্যয়’ বন্ধের দোহাই দিয়ে সকলের জন্য স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রকল্প বা ওবামাকেয়ার ও তরুণ অভিবাসীদের জন্য থাকা ‘ড্রিমারস’ প্রকল্প বন্ধের কথা বলে গিয়েছেন তিনি। আর সেই প্রেসিডেন্টই আবার অবাধে কর ফাঁকি দেন। এর চেয়ে লজ্জার আর কী হতে পারে?
ভোটের আগে নিউ ইয়র্ক টাইমস নিঃসন্দেহে একটি বড় অস্ত্র তুলে দিয়েছে ডেমোক্র্যাটদের হাতে। কর ফাঁকি দিতে ডোনাল্ড ট্রাম্প যে রাস্তায় হেঁটেছেন, তা চিরপরিচিত। নিজের ব্যবসায়িক ক্ষতি দেখিয়ে তিনি কর পরিশোধের হাত থেকে রেহাই পেয়েছেন বরাবর। এই অজুহাতটিকেই সত্যি হিসেবে মেনে নিলে বলতে হয়, সফল ব্যবসায়ী হিসেবে নিজের যে ভাবমূর্তি তিনি তৈরি করেছেন, তা এক বড় ভাঁওতা। ফলে তাঁর নিজেকে ‘গ্রেট ম্যানেজার’ দাবি করাটা ঠিক ধোপে টেকে না।
নিউ ইয়র্ক টাইমস যে তথ্য প্রকাশ্যে এনেছে, তাতে আঁতকে উঠতে হয়। তারা জানিয়েছে, গত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের বছর ও প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর প্রথম বছরে ডোনাল্ড ট্রাম্প মাত্র ৭৫০ ডলার করে আয়কর পরিশোধ করেছেন। পরের দু’বছরে তিনি কোনও করই পরিশোধ করেননি। আইনের মারপ্যাঁচে এই কর পরিশোধ না করার দায়টা হয়তো শেষ পর্যন্ত ট্রাম্প এড়াতে পারবেন। কিন্তু এর মাধ্যমে সেই বড় প্রশ্নটি সামনে চলে এসেছে তা হল, আমেরিকার কর পরিকাঠামোয় ধনীরাই সুবিধা পান বেশি। আর কাটা হচ্ছে পরিশ্রমী আমেরিকানদের পকেট। যার কথা বিরোধীরা বহুদিন ধরে বলে এসেছেন। ডেমোক্র্যাটরা এই ব্যবস্থার বদল চায়। শুনলে অবাক হবেন, এই কর ব্যবস্থা পাল্টানোর কথা ডোনাল্ড ট্রাম্পও বলছেন। এই বদলের কথা বলেই তিনি প্রত্যন্ত অঞ্চলের ভোটারদের নিজের দলে টেনেছেন। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে ধনীদের জন্য থাকা সব সুযোগ-সুবিধা নিয়ে কর ফাঁকি দেওয়ার কাজটিও করেছেন। আর সেই সব খেটে খাওয়া মানুষের পকেট কেটেছেন, যাদের ভোটে আজ তাঁর ঠিকানা হোয়াইট হাউস।
প্রশ্ন হচ্ছে, এই কর ফাঁকি দেওয়ার তথ্য আসন্ন নির্বাচনে কতটা প্রভাব ফেলবে? কিন্তু এর আগেও তো কম কেলেঙ্কারির সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নাম যুক্ত হয়নি। যৌন নির্যাতন, পর্নো তারকার সঙ্গে সম্পর্ক, গত নির্বাচনে রাশিয়া-যোগ... বহু অভিযোগ উঠেছে। যার জন্য গত চার বছর কম জলঘোলা হয়নি। একসময় ডোনাল্ড ট্রাম্পের ইমপিচমেন্ট হবে বলে শোরগোল উঠেছিল। কিন্তু এখনও তিনি বহাল তবিয়তেই রয়েছেন।
কর এড়িয়ে যাওয়ার অভিযোগ আমেরিকার মতো দেশে অনেক বড় অপরাধ। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থকরা ‘গোঁড়া সমর্থক’ হিসেবেই পরিচিত। যা কিছুই হোক, তাঁরা ট্রাম্পের সঙ্গেই রয়েছেন। বিভিন্ন জনমত সমীক্ষাতেও ট্রাম্প সমর্থকদের এমন প্রবণতাই উঠে আসছে। সঙ্গে উগ্র শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদীদের নিজের সঙ্গে লেপ্টে রাখতে এবং বিভিন্নভাবে তাদের উসকে দিতে, যেকোনও কিছু করতে প্রস্তুত ট্রাম্প। এমন অবস্থান তিনি স্পষ্ট করেছেন বিভিন্ন ঘটনায়। ট্রাম্প সেই চেনা পথেই হাঁটবেন সন্দেহ নেই।