পুরনো রোগ চাগাড় দেওয়ায় দেহকষ্ট ভোগ করতে হতে পারে। তীর্থ ভ্রমণ ও ধর্মকর্মে আত্মিক তৃপ্তিলাভ। ... বিশদ
যদি তিনি কৃষকদের শক্তিকে উপেক্ষা করার চেষ্টা করেন, তবে তাঁর পড়ে নেওয়া উচিত হবে সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামের আন্দোলনের ইতিহাস। চাষির জমি কেড়ে তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে শিল্প গড়ার দম্ভ প্রকাশ করতে গিয়ে পতন হয়েছিল ৩৪ বছরের শক্তপোক্ত বাম শাসনের। সেদিন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের লড়াই ইতিহাস তৈরি করেছিল। সেই দেওয়াল লিখনটুকু না পড়ে একই রকমভাবে শাসকের দম্ভ প্রকাশ পেলে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। আজ মোদির কৃষিবিল সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামেরই এক বৃহৎ প্রেক্ষিত সৃষ্টি করতে চলেছে। এই বাংলায় নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের কাহিনি সকলেরই জানা। জোর করে কৃষকদের নীলচাষে বাধ্য করা হয়েছিল। সেই অত্যাচারের বিরুদ্ধে কৃষকরা আন্দোলনে সংগঠিত হয়েছিলেন, তারই ইতিহাস ’নীলদর্পণ’। আজ মোদিজির এই কৃষিবিল চাষিকে তাঁর নিজের জমিতেই বড় বড় কর্পোরেট সংস্থার ভূমিদাসে পরিণত করতে চাইছে। নিজের জমিতেই চাষিকে করতে চাইছে ক্রীতদাস। মোদিজির এই বিল অনেকটাই আধুনিক নীলকর সাহেবের মতো। সারাদেশে চাষিদের এই আন্দোলন আরও একটি ‘নীলদর্পণ’ রচনার প্রেক্ষাপট তৈরি করে দিচ্ছে।
এমনিতেই এনডিএ জোটের পলেস্তরা একে একে খসে পড়ছে। ডিসটেম্পার করা জোটশক্তির রং চটে বেরিয়ে পড়ছে এনডিএতে বিজেপির দাদাগিরির ছবি। মোদিজির কৃষিনীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে জোট ত্যাগ করে বেরিয়ে গিয়েছে এনডিএ’র সব থেকে পুরনো সঙ্গী শিরোমণি অকালি দল। এনডিএ’র প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে ছিলেন পদত্যাগ করা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হরসিমরত কাউরের শ্বশুর তথা দলের বর্তমান সভাপতি সুখবীর সিং বাদলের বাবা প্রকাশ সিং বাদল। জোটত্যাগের পর সুখবীর বলেছেন, সরকারের আমলে কোনওদিনই এনডিএ’র বৈঠক হয়নি। অর্থাৎ জোটে ছোট শরিকদলকে কোনও পাত্তাই দেওয়া হতো না। মর্যাদাই ছিল না জোটসঙ্গীদের। এই পরিপ্রেক্ষিতে বিজেপি প্রমাদ গোনে আবার শিবসেনার মানভঞ্জন করতে নেমে পড়েছে। মহারাষ্ট্রে তাদের নতুন গোপন খেলা শুরু করেছে। অর্থ ঢেলে মহারাষ্ট্র সরকার ভাঙার চেষ্টা করেও বিজেপি ব্যর্থ হয়েছিল। এখন তাই শিবসেনার সঙ্গে প্রেম প্রেম খেলা শুরু করেছে। তাকে কাছে টানার চেষ্টা করছে। লক্ষ্য হল, এতে কংগ্রেস এবং শারদ পাওয়ারের এনসিপি সরে গেলে বিজেপি তাদের সমর্থন দিয়ে সরকার টিকিয়ে রাখবে এবং কেন্দ্রে শিবসেনাকে শরিক হিসেবেও পাওয়া যাবে। এক ঢিলে দুই পাখি মারার কৌশল নিয়ে বিজেপি এগচ্ছে।
পরিস্থিতি এখন মোটেই বিজেপির পক্ষে অনুকূল নয়। দিন দিন পরিস্থিতি মোদিজির পক্ষে সত্যিই বিড়ম্বনাময় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। অভ্যন্তরীণ এই বিপাক দশার পাশাপাশি একের পর এক ঘোটালা সামনে এসে সরকারকে বেআব্রু করে দিচ্ছে। আর আটকানো যাচ্ছে না। ক্যাগ রিপোর্ট দিয়েছে, রাজ্যগুলির প্রাপ্য জিএসটির ৪৭ হাজার কোটি টাকা বেআইনিভাবে সরিয়েছে মোদি সরকার। আর্থিক ঘাটতি কম দেখাতেই এই চালাকি করা হয়েছে। কেন সেই টাকা সরানো হল কেন্দ্রীয় তহবিলে, এসব দেশের মানুষ জানতে চায়। কেননা টাকাটা দেশের মানুষের। সেটা নিয়ে ঘোটালার অধিকার কোনও শাসকেরই নেই। ঠিক এই কারণেই পিএম কেয়ার্স ফান্ডকে ক্যাগের পরীক্ষার বাইরে রাখা হয়েছে। সেখানে কোনও ঘোটালা যাতে কেউ কোনওদিন ধরতে না পারে। এসব নিয়ে মোদিজি মুখ খোলেন না। মানুষের প্রশ্ন এড়িয়ে যান। মন কি বাতে আগড়ুম বাগড়ুম অবান্তর প্রসঙ্গে বকে যান।
অন্য রাজ্যের মতো এরাজ্যেও কৃষিবিলের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়েছে। মোদির অপশাসন দিনের পর দিন যেভাবে মানুষের ক্ষোভের আঁচে ঘৃতাহুতি দিচ্ছে, তাতে অদূর ভবিষ্যতে এই অসন্তোষ দাবানলের আকার নিতে পারে। কৃষিবিল নিয়ে সত্যিই দেশ যদি অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে, তার জন্য দায়ী থাকবে মোদি সরকার নিজেই। এত বড় সংখ্যায় জয় পেয়ে তিনি মানুষের পরিবর্তে বৃহৎ শিল্পপতিদের স্বার্থে কাজ শুরু করছেন বলে যেসব অভিযোগ উঠছে, তা যে ভুল সেটা তাঁকে কাজের মধ্য দিয়ে প্রমাণ করতে হবে। তাঁর একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত মানুষকে বিশ্বাস করতে বাধ্য করছে যে, এই সরকার যে গরিব মানুষের স্বার্থে কাজ করে না। এই বিশ্বাস যত বাড়বে, ততই দেশে আন্দোলন আরও বড় আকার ধারণ করবে। এই আন্দোলনের আবহে নির্বাচন হতে চলেছে বিহারে। আগামী বছরে ভোট হবে এরাজ্যে। মানুষের বিশ্বাসকে মর্যাদা না দিলে কিংবা তার বেঁচে থাকার পথটাকে বেহাল করে দিলে, গণতন্ত্রে মানুষের প্রতিবাদের জায়গা একটাই। ভোটবাক্স। সেখানে সে জবাব দেবেই।
যে আত্মবিশ্বাস আর শক্তি নিয়ে একদিন মোদি ক্ষমতায় বসেছিলেন, আজ তার অনেকটাই খসে পড়েছে। শিবসেনা সরে গিয়েছে, শিরোমণি অকালি দল সরে গেল। বাকি রামবিলাস পাসোয়ানের লোক জনশক্তি পার্টি। সেও খসে পড়ার অপেক্ষায়। ভিতরের এই ভাঙনে বিজেপি ভয় পেতে শুরু করেছে। শুধু ভিতরে নয়, ভাঙন ধরেছে বাইরেও। বিজেপির স্ট্র্যাটেজি ছিল, দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু ভোটকে এককাট্টা করে বাজিমাত করা। কেননা মোদিজির ভোটশক্তির আসল কাঠামো মূলত মধ্যবিত্ত হিন্দু ভোটারদের সমর্থন। বিজেপি-আরএসএস এদেশে হিন্দুত্বের একটা সিন্ডিকেট গড়ে বিভেদের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাকে একচেটিয়া করে তুলতে চেয়েছিল। এই সিন্ডিকেটের সবথেকে বড় শক্তি মধ্যবিত্তই। আজ সেই মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উপর সবথেকে বড় আঘাত পড়েছে। নতুন চাকরির নিশ্চয়তা তো দূরস্থান। লক্ষ লক্ষ মধ্যবিত্ত আজ চাকরি হারিয়ে দুর্দশার মধ্যে রয়েছে। এই কৃষিবিল শুধু কৃষকদেরই সর্বনাশ ডেকে আনবে না। এই কৃষিবিল দেশের প্রতিটি মানুষের খাদ্যনিরাপত্তাকে বিঘ্নিত করে তুলবে। যে বিশ্বাস নিয়ে মানুষ ইভিএমে মোদিজির প্রতি সব আস্থাটুকু ঢেলে দিয়েছিল, এই সরকার তার মর্যাদা রাখতে যে অক্ষম, সেটা প্রমাণিত হয়েছে। সেই মধ্যবিত্ত হিন্দু ভোটে বিরাট ভাঙন ধরেছে। তার প্রমাণ দিয়েছে রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, ঝাড়খণ্ড।
সামনে আরও বিধানসভার ভোট। সংসদে বিরাট জয় সত্ত্বেও আজ সরকারকে ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকতে হচ্ছে। মুখে যতই সাহসী বার্তা দিক না কেন, নৈতিকভাবে মোদি সরকার আজ ভীত। এত বিরাট সংখ্যক এমপি নিয়ে সংসদ আলো করে বসে থাকলেও ভিতরে ভিতরে সে ভয়ের কাঁটায় বিদ্ধ। কবিগুরুর গানটা মনে পড়ে গেল। ‘জয় করে তবু ভয় কেন তোর যায় না?’ প্রশ্নের উত্তরটাও সোজা। সেটা মাইকেলের ‘মেঘনাদ বধ কাব্য’ থেকে দেওয়া যেতে পারে। ‘নিজ কর্মদোষে, হায়, মজাইলা / এ কনক-লঙ্কা রাজা মজিলা আপনি।’