কর্মপ্রার্থীরা বেশ কিছু সুযোগের সংবাদে আনন্দিত হবেন। বিদ্যার্থীরা পরিশ্রমের সুফল নিশ্চয় পাবে। ভুল সিদ্ধান্ত থেকে ... বিশদ
আল কায়েদা জঙ্গি মডিউলের খোঁজ মিলতেই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু পশ্চিমবঙ্গ ও কেরল। এই দুই রাজ্য থেকে ন’জনকে জঙ্গি সন্দেহে গ্রেপ্তার করেছে এনআইএ। ধৃতদের সঙ্গে পুলওয়ামার হত্যাকারীদের যোগসূত্র খুঁজে পেয়েছে এই কেন্দ্রীয় সংস্থাটি। আল কায়েদার নামডাকের সঙ্গে উদ্ধার হওয়া মালপত্রের সামঞ্জস্য খুঁজে পাচ্ছেন না অনেকেই। তা নিয়েই শুরু হয়েছে বিতর্ক। তবে, সেই বিতর্কে না গিয়েও স্পষ্ট করে বলা যায়, জঙ্গি গ্রেপ্তারের ঘটনাকে ঘিরে শুরু হয়েছে রাজনৈতিক তরজা। আর সেটাই জঙ্গি দমনের পথে প্রধান অন্তরায়।
জঙ্গি জন্মায় না, তৈরি করা হয়। বঞ্চনার অভিমানকে উস্কে দিয়ে জাগিয়ে তোলা হয় প্রতিহিংসার নেশা। লাগাতার মগজ ধোলাইয়ে মাথায় গেঁথে দেওয়া হয়, সে বঞ্চিত। তার জন্য দায়ী সরকারি সিস্টেম। তাই তাকেই আঘাতে আঘাতে জর্জরিত করতে হবে। দুর্ভাগ্য, সেই লক্ষ্য পূরণে পবিত্র ধর্মকে নির্লজ্জভাবে কাজে লাগানো হয়।
ইসলাম ধর্মকে হাতিয়ার করে আল কায়েদা, আইএস এর মতো জঙ্গি সংগঠনগুলি বিশ্বজুড়ে সন্ত্রাসের আবহ তৈরি করতে চাইছে। আইএস ২০২০ সালের মধ্যে ভারত সহ পৃথিবীর বিস্তীর্ণ অংশকে ইসলামিক স্টেটের অধীনে আনার কথা ঘোষণা করেছে। মানুষকে আতঙ্কিত করতে তারা নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ভিডিও ছড়িয়ে দিচ্ছে। তাতে জঙ্গিরা সাহস পায়। ক্ষমতালোভী কিছু লোক ইসলামকে রক্ষার নামে ‘জেহাদি’ তৈরি করে। ধ্বংসই লক্ষ্য। তাদের পাতা ফাঁদে পা দিচ্ছে হতদরিদ্র ও শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত মানুষজন। অথচ যে ধর্মের দোহাই দিয়ে সন্ত্রাস চালাচ্ছে, সেই ইসলাম শান্তি, সহনশীলতা ও উদারতার কথাই বলে। স্বয়ং হজরত মহম্মদ বলেছেন, ‘ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করো না। এই বাড়াবাড়ির ফলে অতীতে বহু জাতি ধ্বংস হয়ে গিয়েছে।’
আসলে ধর্ম অনেকটা ছুরির মতো। ডাক্তারের হাতের ছুরি মানুষের জীবন বাঁচায়। আবার দুষ্কৃতীর হাতে সেই ছুরিই মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়। ধর্মও ঠিক তেমনটাই। ধর্মীয় ভাব জাগলে মানুষ হয় দয়ালু। আর্তের পাশে দাঁড়ায়। আবার সেই ধর্মকে কাজে লাগিয়েই মৌলবাদীরা ‘ভালো’ মানুষকে খারাপ কাজের দিকে ঠেলে দেয়। নাশকতায় লিপ্ত করে।
এনআইএ-র অনুমান, পশ্চিমবঙ্গ ও কেরল থেকে ধৃত জঙ্গিরা খারাপ কাজে উৎসাহিত হয়েছিল। নাশকতার দক্ষ কারিগর হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলছিল লোকচক্ষুর আড়ালে। নীরবে।
ধ্বংসাত্মক আন্দোলনের ভয়ঙ্কর রূপ দেখেছে বাংলা। দার্জিলিংয়ে জঙ্গি আন্দোলনের ভয়াবহ স্মৃতি ফিকে হলেও মুছে যায়নি। বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সশস্ত্র আন্দোলনে শান্ত দার্জিলিং হয়ে উঠেছিল আগ্নেয়গিরি। ব্যক্তিগত ফায়দার জন্য সুবাস ঘিসিং শান্তিপ্রিয় গোর্খাদের জাত্যভিমানকে উস্কে দিয়েছিলেন। আর কৌশলী সিপিএম সেই বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনকে বানিয়েছিল রাজনীতির উপাদান। ‘এক কোলিজা রক্ত দেব, বাংলা ভাগ হতে দেব না’ এমনই দেওয়াল লিখনে ভরে গিয়েছিল রাজ্য। দার্জিলিংকে সামনে রেখে বামফ্রন্ট জিতেছিল একের পর এক নির্বাচন।
সেই দার্জিলিং এখন শান্ত। কারণ সমস্যা সমাধানে শাসকের সদিচ্ছা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দার্জিলিংকে ভোটে জেতার ইস্যু বানাতে চাননি, চেয়েছিলেন সমাধান। তাই শান্তি ফিরেছে। যারা বাংলা থেকে দার্জিলিংকে আলাদা করতে চেয়েছিল, আজ তারাই পাহাড় থেকে বিচ্ছিন্ন। গোর্খাল্যান্ড সমর্থন না করায় তৃণমূল দার্জিলিংয়ে বারবার হেরেছে, তাও মমতা সমঝোতার রাস্তায় হাঁটেননি। তাই আজও দার্জিলিং পশ্চিমবঙ্গের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।
সদিচ্ছা ও আন্তরিকতায় অনেক জটিল সমস্যাও সহজ হয়। তার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত, এ রাজ্যের মাওবাদী সমস্যা। বাম জমানার শেষদিকে মাওবাদী আতঙ্কে কাঁপত জঙ্গলমহল। গুলি, বারুদের দাপটে ভরসন্ধেতেই নামত গভীর রাতের নিস্তব্ধতা। ঝুপ ঝুপ করে দোকানের ঝাঁপ পড়ত। শুনশান হয়ে যেত রাস্তাঘাট। বনপার্টির দল বাড়ি থেকে সিপিএমের নেতাদের তুলে নিয়ে গিয়ে খুন করত। সেই সব দেহ উদ্ধারের জন্য পুলিস থাকত ভোরের আলো ফোটার অপেক্ষায়। আনাচেকানাচে কেন্দ্রীয় বাহিনীর ক্যাম্প, হার্মাদ ক্যাম্প বসিয়েও জঙ্গলমহলকে বাগে আনা যায়নি। কারণ মাওবাদী দমন অপেক্ষা তাকে ভোটের ইস্যু বানানোর দিকেই বামেদের নজর ছিল বেশি। খাল কেটে কুমির ডাকলে তার পেটে যাওয়াটাই ভবিতব্য!
জঙ্গলমহলে শান্তি ফেরানো ছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্বাচনী প্রতিশ্রতি। তাই প্রথম থেকেই তিনি সমস্যা মেটানোয় ছিলেন আন্তরিক। ইস্যু জিইয়ে রাখতে চাননি বলেই সমস্যার গভীরে ঢুকেছিলেন। জঙ্গলমহলে জঙ্গি থাকলেও তিনি গোটা জঙ্গলমহলকে মাওবাদী ভাবেননি। তিনি বুঝেছিলেন, শুধু অস্ত্র দিয়ে হবে না। মাওবাদী দমন করতে গেলে মানুষকে তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন করতে হবে। তার জন্য দরকার গরিব মানুষের ভাতের ব্যবস্থা করা। সেই মতো সাজিয়ে ছিলেন রণকৌশল।
নিখুঁত পরিকল্পনা ও সদিচ্ছায় সফল হয়েছিল উদ্দেশ্য। গুলির লড়াইয়ে মরেছিলেন কিষেণজি। ক্ষুধার্ত মানুষের জন্য করেছিলেন ভাতের ব্যবস্থা। শান্তি ফিরেছিল জঙ্গলমহলে। জঙ্গলমহল জঙ্গিমুক্ত। প্রায় ১০ বছর ঘটেনি রক্ত ঝরার কোনও ঘটনা। অন্য রাজ্যে দাপট দেখালেও বঙ্গে ঢোকার সাহস দেখায়নি মাওবাদীরা। একইভাবে আল কায়েদা জঙ্গিদেরও মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে হবে। তবেই আসবে সাফল্য। তা না করে ধর্মের দিকে আঙুল তুললে, তা হবে মারাত্মক ভুল।
মুর্শিদাবাদ থেকে ছ’জন গ্রেপ্তার হতেই বিজেপি নেতৃত্ব পশ্চিমবঙ্গকে ‘জঙ্গি হাব’ বলে প্রচার শুরু করেছে। মহামহিম এব্যাপারে সর্বদাই এগিয়ে। তাঁর কথায়, ‘রাজ্য তো জঙ্গি, বোমা, অপরাধী তৈরির স্বর্গোদ্যান।’ পিছিয়ে নেই কংগ্রেস-সিপিএম। তবে, কেরল থেকে আল কায়েদার তিনজন গ্রেপ্তার হওয়ায় সিপিএম কিঞ্চিৎ বিব্রত।
গোয়েন্দাদের মতে, কেরল থেকে গ্রেপ্তার হওয়া মুর্শিদই এই মডিউলের মাস্টার মাইন্ড। সে কেরল থেকেই দিল্লি, কাশ্মীর ঘুরে ঘুরে নানা তথ্য সংগ্রহ করত। জন্মস্থান বাংলায় হলেও জঙ্গি কার্যকলাপ চালাত কেরলে বসেই। তার উপর কেরলের সিপিএম সরকারের বিপদ বাড়িয়েছেন বাম সরকারের উচ্চ শিক্ষামন্ত্রী কে টি জলিল। তাঁর বিরুদ্ধে আবার বিদেশ থেকে অর্থ সাহায্য নেওয়া ও ধর্মীয় প্রচার-পুস্তিকা আনানোর অভিযোগ। এনআইএ-র জেরার মুখে পড়তে হয়েছে তাঁকেও।
বিজেপির কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ভি মুরলীধরণ সরাসরি কেরলের মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়নকে আক্রমণ করেছেন। মুরলীধরণ বলেছেন, বিজয়নের আমলেই কেরল সন্ত্রাসবাদী ও দেশ-বিরোধী শক্তির নিরাপদ আশ্রয় হয়ে উঠেছে।
এসব থেকে স্পষ্ট, জঙ্গি এখন রাজনীতির মস্ত বড় ইস্যু। রাজনীতির কারবারিরা ঘোলা জলে মাছ ধরার জন্য রীতিমতো কোমর বেঁধে নেমে পড়েছেন। অনেকেই মনে করছেন, জঙ্গি গ্রেপ্তারের ঘটনাকে সামনে রেখে চলছে মেরুকরণের জোরদার চেষ্টা। বালাকোটের সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের কথা স্মরণ করে অনেকেই আশঙ্কা করছেন, বিধানসভা ভোট যত কাছে আসবে, এই ধরনের ঘটনা আরও ঘটবে। তাতে মূল সমস্যা থেকে নজর ঘুরে যাবে। জীবন-জীবিকা, অর্থনীতি, পেট্রল, ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি, চাষির উপর কৃষিবিলের ভয়ঙ্কর প্রভাবের আলোচনা চাপা পড়ে যাবে। ঝোড়ো ইনিংস শুরু করে দেবে ধর্মীয় বিভাজন ও মেরুকরণের চর্চা। এসব করে হয়তো ভোটের বাজারে ফায়দা আসবে, কিন্তু জঙ্গির শিকড় উপড়ে ফেলা অসম্ভব। তার জন্য দরকার মানসিকতা।
সমস্যার সমাধান হয় সদিচ্ছা ও নিখুঁত পরিকল্পনায়। তার জোরে জটিল সমস্যাও হয়ে যায় জলবৎ তরলং। দৃষ্টান্ত আছে চোখের সামনেই। দার্জিলিং
আর জঙ্গলমহল।