কর্মপ্রার্থীরা বেশ কিছু সুযোগের সংবাদে আনন্দিত হবেন। বিদ্যার্থীরা পরিশ্রমের সুফল নিশ্চয় পাবে। ভুল সিদ্ধান্ত থেকে ... বিশদ
বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহের কারণে শৈশব অবস্থা থেকেই এদেশের মেয়েরা কী দুঃসহ জীবনের সম্মুখীন হতো তা এই বিবরণ থেকে পাওয়া যায়। বিদ্যাসাগরও তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বাল্যবিবাহ-বহুবিবাহ-কৌলিন্য প্রথা বজায় রাখার কারণে উদ্ভূত নারী জীবনের অনেক হৃদয়বিদারক কাহিনী বিবৃত করেছেন। যখন শিশু-কন্যাদের বাবা-মায়ের স্নেহে বাড়িতে প্রতিপালিত হওয়ার কথা, নারীত্ব-প্রেম-যৌনতা এসব কোন অনুভূতি সৃষ্টি হওয়ার কথা নয় তখনই তারা বাল্যবিবাহের শিকার হতো। কৌলিন্য প্রথার দৌলতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বর হতো বার্ধ্যক্যের দরজায় দাঁড়ানো পুরুষ, যার অবশ্যম্ভাবী ফল হতো শিশু-বধূটির অকাল বৈধব্য। সাদা থান পরিহিত বিধবা-বেশী, উৎসব-অনুষ্ঠানে যোগ দানের অধিকার বিবর্জিত, শ্বশুরালয় বা পিত্রালয়ের নানা গঞ্জনার শিকারে পরিণত হওয়া নারীর সংখ্যা ছিল সমাজে প্রচুর। একাদশী-পূর্ণিমাতে সারাদিন নির্জলা উপবাস করে কত বাল-বিধবার যে প্রাণ যেত! এই বালবিধবারা যখন যৌবনপ্রাপ্ত হতেন তখন কখনও স্বাভাবিক চাহিদা, অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিকট আত্মীয় পরিজন পুরুষের লালসার শিকার হয়ে গর্ভবতী হয়ে পড়তেন। তারপর পারিবারিক সম্মান রক্ষা কিংবা সমাজচ্যুত হওয়ার ভয়ে গোপনে ভ্রূণহত্যার চেষ্টা হতো। তাতে অনেক প্রসূতি মায়ের জীবন সংশয় হতো অথবা সূতিকাগারে সদ্যজাত সন্তানকে হত্যা করা হতো। দুঃসহ এই সামাজিক পরিস্থিতি বিদ্যাসাগরের মনকে অস্থির করে তুলেছিল। এর থেকে নারী সমাজের মুক্তিদানের আকাঙ্ক্ষায় তিনি ছটফট করতেন।
অন্যদিকে প্রণয়-ভালোবাসা ছাড়া যে বিবাহ সুখের
হয় না, অত্যন্ত কৈশোরে তা যে অসম্ভব,
সে সম্পর্কে তাঁর স্পষ্ট বক্তব্য ছিল।
তিনি লিখেছেন, “অস্মদেশে দাম্পত্যনিবন্ধন অকপট প্রায় দৃষ্টই হয় না, কেবল প্রনয়ী ভর্তাস্বরূপ এবং প্রনয়িনী গৃহপরিচারিকা স্বরূপ হইয়া সংসারযাত্রা নির্বাহ করে”। অত্যন্ত আধুনিক মানসিকতার এটা পরিচায়ক, যা ইউরোপীয় রেনেসাঁর উত্তরাধিকারে তাঁর পাওয়া। তিনি ছিলেন মাইকেল মদুসূদনের ভাষায় ‘‘এদেশে প্রথম আধুনিক মানুষ’’; সুকুমার সেনের কথায়, “তাঁর মতন ‘আধুনিক মানুষ’ আজ পর্যন্ত আমাদের দেশে জন্মায়নি”।
আরও একটি বিষয় তাঁকে পীড়া দিত। বিবাহই যদি কৈশোরে মেয়েদের ভবিতব্য হয় তাহলে স্কুলে আসবে কে? সমাজ প্রগতির জন্য তখন নারী শিক্ষার প্রয়োজন তিনি গভীরভাবে অনুভব করতেন। কী অক্লান্ত পরিশ্রম করে তিনি চারটি জেলায় ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন এবং ব্রিটিশরা প্রথমে প্রতিশ্রুতি দিয়ে পরে পিছিয়ে এলেও কীভাবে সেগুলি চালিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন তা ইতিহাস।
এই সমস্ত কারণে বিধবাবিবাহের প্রচলন এবং বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ রোধ তিনি জীবনের প্রধান কর্ম হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন। কিন্তু তথাকথিত শাস্ত্রকার নিয়ন্ত্রিত ধর্মীয় কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজে তা যে কত দুরূহ সে সম্পর্কে তাঁর সম্যক ধারণা ছিল। তিনি বুঝেছিলেন শাস্ত্রের বিধানে বিধবাবিবাহ যে সিদ্ধ তা যদি প্রমাণ না করতে পারেন তাহলে সমাজপতিদের দুর্লঙ্ঘ বাধা তিনি অতিক্রম করতে পারবেন না।
তিনি শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত ছিলেন, জ্ঞান চর্চা করতেন সৃষ্টিশীল মানসিকতা থেকে, পাণ্ডিত্য জাহির করার উদ্দেশ্যে নয়। উদ্দেশ্যমুখীনতা থেকে মনুসংহিতা, গৌতমসংহিতা, শঙ্করসংহিতা ও পরাশরসংহিতা তন্নিষ্ঠভাবে অনুসন্ধান করে তিনি দেখলেন পরাশরসংহিতা বিধবাবিবাহ অনুমোদন করে। শোভাবাজার রাজবাড়ি তখন ছিল সমাজপতিদের প্রায় হেডকোয়ার্টার। সেখানেই প্রথম সারির শাস্ত্র বিশারদদের সঙ্গে বৈঠক হয়। শাস্ত্র আলোচনায় তাঁরা পরাস্ত হন। তাঁর সামনে থেকে বাধার পাহাড় অপসারিত হয়। কিন্তু পণ্ডিতবর্গ লোকাচারের দোহাই দিয়ে বিধবা বিবাহ প্রবর্তনের বিরোধিতা করেন। তখন বিদ্যাসাগর তাঁদের মানবিক হতে আবেদন করেছিলেন।
ধর্ম-বিশ্বাসী না হয়েও কেন তিনি ধর্মশাস্ত্রের আশ্রয় নিয়েছিলেন তা না বুঝে কেউ কেউ তাঁকে সমালোচনা করেন। তাঁর নিজের কথায়, “যদি যুক্তিমাত্র অবলম্বন করিয়া ইহাকে কর্তব্যকর্ম বলিয়া প্রতিপন্ন কর, তাহা হইলে এতদ্দেশীয় লোকে কখনই ইহা কর্তব্যকর্ম বলিয়া স্বীকার করিবেন না। যদি শাস্ত্রে কর্তব্যকর্ম বলিয়া প্রতিপন্ন করা থাকে, তবেই তাহারা কর্তব্যকর্ম বলিয়া স্বীকার করিতে এবং তদনুসারে চলিতে পারেন”।
বিধবাবিবাহ কেন আইনসিদ্ধ হওয়া উচিত সে সম্পর্কে তিনি দুইটি বই লেখেন। সমাজে প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি হয়। গোঁড়া হিন্দুদের কাছ থেকে বাধা আসে প্রচুর। এমনকী বঙ্কিমচন্দ্রের মত সাহিত্যিকও কলম ধরেন। তাঁর ‘বিষবৃক্ষ’ উপন্যাসের সূর্যমুখী একখানা চিঠিতে লিখেছে, “ঈশ্বর বিদ্যাসাগর নামে কলিকাতায় কে না কি বড় পণ্ডিত আছেন, তিনি আবার একখানি বিধবাবিবাহের বহি বাহির করিয়াছেন। যে বিধবার বিবাহের ব্যবস্থা দেয়, সে যদি পণ্ডিত, তবে মুর্খ কে”? বহুবিবাহ কেন বন্ধ হওয়া উচিত সে সম্পর্কে লেখা বিদ্যাসাগরের পুস্তক নিয়েও বঙ্কিমচন্দ্র ব্যঙ্গ করেছিলেন। সমাজপতিদের ষড়যন্ত্রে বিদ্যাসাগরের প্রাণনাশেরও চেষ্টা হয়। যাই হোক, প্রবল সামাজিক আন্দোলনের চাপে বিধবাবিবাহের আইন গৃহীত হয়।
আইন তো হল, কিন্তু এমন বিবাহ করবে কে? বর, কনে কোথায় পাওয়া যাবে? এখানেও বিদ্যাসাগরের অক্লান্ত পরিশ্রম। অবশেষে এসেছিল সেইদিন-- ১৮৫৬ সালের ৭ ডিসেম্বর, শ্রীশচন্দ্র ও কালীমতীর বিয়ে। প্রথম বিধবাবিবাহ। আনন্দের বন্যা বয়ে গিয়েছিল বিদ্যাসাগরের হৃদয়ে। তার বর্ণনা পাওয়া যায় সে সময়ের সংবাদপত্রের পাতায়। কিন্তু যে বন্ধুরা তাঁকে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেলেন তাঁদের অনেকে সমাজচ্যুত হওয়ার ভয়ে পিছিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁকেও একঘরে করা হয়েছিল। কোনও কিছুতেই তিনি পিছিয়ে আসেননি। এমনকী তাঁর বন্ধু রামমোহন পুত্র রমাপ্রসাদ রায় প্রথম বিধবাবিবাহের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়ে পিছিয়ে এসেছিলেন। এই ভীরুতায় দুঃখ পেয়ে দেওয়ালে রামমোহনের ছবির দিকে ইঙ্গিত করে রমাপ্রসাদকে বলেছিলেন, ‘ওটা ফেলে দাও’।
এরপর তাঁর জীবদ্দশায় বহু বিধবাবিবাহের ব্যবস্থা তিনি করেছিলেন। কিন্তু কথা উঠছিল, ‘পরের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে বিদ্যাসাগর নাম কিনছেন। নিজের ছেলের বিয়ে দিচ্ছেন না’। অবশেষে একমাত্র পুত্র নারায়ণচন্দ্র বিধবাবিবাহ করেন। আত্মীয়-স্বজনের প্রবল আপত্তি, এমনকী ভাই শম্ভুচন্দ্র প্রথমদিকে সম্মতি দিলেও পরে সাবধানতার নামে বাধা দেন। কিন্তু কোনও বাধাই নারায়ণচন্দ্রের পিতাকে নিরস্ত করতে পারেনি।
এই হচ্ছে বিদ্যাসাগর। আদর্শের প্রতি অনড়, সংকল্পে অটল, আপসহীন এক রেনেসাঁ ব্যক্তিত্ব। তাঁর প্রতি রবীন্দ্রনাথের শ্রদ্ধার্ঘ্যটি ছিল অত্যন্ত যথার্থ – “দয়া নহে, বিদ্যা নহে, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের চরিত্রের প্রধান গৌরব তাঁহার অজেয় পৌরুষ, তাঁহার অক্ষয় মনুষ্যত্ব”।