কর্মে অগ্রগতি ও নতুন কাজের বরাত প্রাপ্তি। আইটি কর্মীদের শুভ। মানসিক চঞ্চলতার জন্য বিদ্যাচর্চায় বাধা। ... বিশদ
এইসময়ে শুধুমাত্র হোয়াটসআপ ব্যবহারকারীর সংখ্যা ভারতে প্রায় ৫০ কোটি। এটা আবার ফেসবুকেরই সহযোগী সংস্থা। গত লোকসভা ভোটে ভারতে প্রায় ৯০ কোটি মানুষ ভোট দিয়েছিলেন। তাহলে নির্বাচকমণ্ডলীর প্রায় অর্ধেকের বেশি মানুষ এই মাধ্যম ব্যবহার করেন। সুতরাং যদি কোনও দল চায় যে এই মাধ্যমকে তারা তাদের মতো করে ব্যবহার করবে এবং সত্যি মিথ্যে মেশানো খবর প্রচার করবে, তাহলে তারা কী করবে? ইদানীং শোনা যাচ্ছে, বাংলায় দুর্গাপুজোতে লকডাউন থাকবে! এমন একটি গুজব হোয়াটসআপে বিতরণ করা চলছে। এসব কি শুধু প্রশাসনিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব? যারা এই মাধ্যমগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করেন তাঁরা তো এই গুজব ছড়ানোর চেষ্টা করবেন। এতে সমাজেও কি ক্ষতি হয় না? বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি ঘোষণা করলেন যে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হিন্দু-বিরোধী, এবার কোনও মানুষ দুটো বার্তাই তাঁর হোয়াটসআপে পেলেন, তিনি তো বিশ্বাস করে ফেলতেও পারেন যে এই বার্তার মূল নির্যাসটি সত্যি।
উল্টোদিক থেকে দেখলে এই সামাজিক মাধ্যমগুলোর কী লাভ? মানে তাঁরা এই রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলতে চাইবে কেন? একটাই কারণে, ভারত বা পিছিয়ে পড়া কিছু দেশে এখনও বেশিরভাগ মানুষের কাছে ইন্টারনেটের মানে এই সামাজিক মাধ্যম বা খুব বেশি হলে একটু আধটু মেইল দেখা বা করা। সেখানে এরকম একটি সামাজিক মাধ্যমকে যদি দেখানো যায় এই প্রক্রিয়াকেই ইন্টারনেট বলে তাহলে লাভই লাভ। অথচ সত্যিটা কী? যদি গুগল করা যায় ‘ভারত’ শব্দটি লিখে, তাহলে যতটা ভারতের চেহারা দেখতে পাওয়া যায়, ততটাই ভারত গুগলের বাইরে পড়ে থাকে। কেউ মনে করতেই পারে যে ইন্টারনেট তাঁদের অধিকার, অথচ এই ভারতেই সবচেয়ে বেশিদিন ইন্টারনেট বন্ধ থেকেছে। তা নিয়ে কিন্তু ভারতবাসী খুব বেশি সোচ্চার হয়নি। ইন্টারনেটের স্পিড বেশিরভাগ স্থানেই ধীর এবং পরিবর্তনশীল। অথচ ভারতবাসীর স্মার্টফোন কেনার প্রবণতা ঊর্ধ্বমুখী, হয়তো-বা বিশ্বে প্রথম। ভারতে এখনও মহিলাদের মধ্যে মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ২১ শতাংশ মাত্র—পুরুষদের অর্ধেক। সামাজিক কারণেই মহিলারা পুরুষদের তুলনায় অনেক কম ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। দেখা গেছে, গ্রামীণ ভারত যেখানে দেশের তিনভাগের দু’ভাগ মানুষ বসবাস করেন। তার চারভাগের একভাগের কাছে ইন্টারনেট আছে।
অনেকে ভাবতে পারেন, ফেসবুক তো একটা বন্ধুত্বের মাধ্যম, এর মধ্যে ব্যবসা কোথায়? এ তো শুধু পরিচিতদের সঙ্গে আরও বেশি জুড়ে থাকার মাধ্যম। এতে কী করে ব্যবসা হবে? খেয়াল করলে দেখা যাবে, বেশকিছু পোস্টে একটা কথা লেখা থাকে—‘স্পনসর্ড’ অর্থাৎ পয়সা দিয়ে সামনে আনা হয়েছে। কিন্তু শুরুটা কি এরকম ছিল? ফেসবুক যখন প্রথম আসে তখন কিন্তু কর্ণধার জুকেরবার্গ দেখেছিলেন, ব্যবসা বাড়াতে হলে তাঁকে ভারতেই বাড়াতে হবে। ২০১৪। একটি হেলিকপ্টার চড়ে রাজস্থানের প্রত্যন্ত গ্রাম চান্দৌলিতে পৌঁছন। তখনও জানতে পারেননি, কত বড় বাজার ওঁর জন্য অপেক্ষা করছে। জুকেরবার্গ খুব ভালো করে জানতেন, কী করে একজন ফেসবুক ব্যবহারকারীকে প্রথমে ক্রেতা, তারপর বিক্রেতা বানিয়ে ফেলা সম্ভব। ভারতের মতো দেশে যদি বিনামূল্যে ফোন এবং ইন্টারনেট দেওয়ার লোভ দেখানো যায় তাহলেই অর্ধেক কাজ শেষ। একজন ফেসবুক ব্যবহারকারী ইন্টারনেটে যদি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের খোঁজ করেন, তাহলে প্রতিটি পোস্টের আশেপাশে কীভাবে ওই জিনিসগুলোর অনলাইন সরবরাহ পেতে পারেন তার বিজ্ঞাপন আসতে থাকে মুহুর্মুহু। কীভাবে একজন মানুষের পছন্দ-অপছন্দকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, কীভাবে পাড়ার দোকান থেকে না কেনাটাকেই নিয়মে পরিণত করে ফেলা যায় সেটাও এই নিয়ন্ত্রণের অঙ্গ। আর একটি কথা—এই যে অনেকে বলছেন, প্রধানমন্ত্রী ‘অপরিকল্পিত’ লকডাউন ঘোষণা করেছেন, আদপেই তা নয়, উনি খুব জেনে বুঝে এই লকডাউন ঘোষণা করেছেন যাতে মানুষ আরও ডিজিটাল হয়, মানুষ আরও সোশ্যাল মিডিয়ামুখী হয়ে ওঠে এবং বেশি অনলাইন কেনাকাটা করে। আর সেখানেই প্রতিটি বিজ্ঞাপনে ফেসবুকের লাভ হবে। ঘটনাচক্রে তাই হয়েছে।
এই বড় টেকনোলজিক্যাল কোম্পানি এবং ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল একে অন্যের পরিপূরক। ফেসবুক এমন একটা শক্তিশালী মাধ্যম সেটাতে যদি কোনও ঘৃণা বিদ্বেষপূর্ণ ভিডিও বা মেসেজ কিছুক্ষণ ছড়ানো যায় তাহলে তারপর সেটা হোয়াটসআপ মারফত মুহূর্তে কোটি কোটি মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব। ঠিক এই বিতর্কটি সম্প্রতি সামনে এনেছে আমেরিকার একটি সংবাদপত্র। তাঁরা বলেছে, ভারতে যিনি এই সংক্রান্ত বিষয়ে দায়িত্বশীল, তিনি ক্ষমতাসীন দলের মুখপাত্রদের ঘৃণা ও উস্কানিমূলক বক্তব্যকে ফেসবুকে প্রচারিত হতে দিয়েছেন। শোনা যাচ্ছে, দিল্লির দাঙ্গা এবং অন্যান্য কিছু ছোটখাটো দাঙ্গার ক্ষেত্রে আভ্যন্তরীণ কর্মীদের বিরোধিতা সত্ত্বেও এই ধরনের প্রচারকে আটকানো হয়নি। তা হলে প্রশ্ন ওঠে, ফেসবুকের কি আরও দায়িত্বশীল হওয়া উচিত ছিল না?
প্রচলিত সংবাদমাধ্যমগুলোর নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম আছে, সম্পাদকমণ্ডলী আছে, পাঠকসমাজের কাছে দায়বদ্ধতা থাকে, কিন্তু এই ফেক খবর উৎপাদনকারী সামাজিক মাধ্যমগুলোর কোনও দায়-দায়িত্ব নেই। সেজন্য বারে বারেই দেখা গেছে, বিভিন্ন দেশে ফেসবুক এই ধরনের কাজকে ঘুরিয়ে সমর্থন করে। কেন? তা হলে কি ফেসবুক নিজে এই ঘৃণা-বিদ্বেষের রাজনীতিকে সমর্থন করে? এখানেই আসে মনস্তত্ত্ব। মানুষের মনকে খুব সহজে তাঁরা পড়তে পারে। মানুষ বিশ্বাস করতে চায় না অনেক কিছু। দেখা গেছে, তাও সে সাম্প্রদায়িক হিংসা ও ঘৃণা সঞ্চারক ভিডিও দেখে। কেন? অত্যাচারী তো বটেই, অত্যাচারিত সম্প্রদায়ের মানুষও কেন দেখে? কারণ তাঁরা মনে করে, এটা সত্যি হতে পারে না, কোনও জনপ্রতিনিধি এই ধরনের কথা বলতে পারেন না। যত এই ভিডিওগুলো মানুষ দেখে, যত বেশি করে পছন্দ করা, মন্তব্য করা বা শেয়ার করা বা এড়িয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটে, তত তথ্য ফেসবুকের হাতে আসে, তত আচরণগতভাবে মানুষকে তারা চিহ্নিত করতে পারে। সেই অনুযায়ী মানুষকে চালনা করতে পারে সেইদিকে। এই ব্যবসায়িক উৎসাহদান শুধু ফেসবুকের নয়, সমস্ত সামাজিক মাধ্যম দিয়ে করা হয়। আর সেটাই ভারতীয় গণতন্ত্রের এই মুহূর্তের ধ্বংসের মূলে। তা হলে যার হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা, যার কাছে প্রযুক্তিকে ব্যবহার করার অর্থ এবং লোকবল আছে সেই কি তবে জয়ী হবে?
১৯৩৩। ৩০ জানুয়ারি। জার্মানিতে ক্ষমতায় আসেন অ্যাডলফ হিটলার। তাঁর প্রচারসচিব ছিলেন জোসেফ গোয়েবেলস। তিনি বলতেন, একটা মিথ্যেকে বারংবার বলা গেলে মিথ্যেটাও সত্যি বলে প্রতিভাত হয়। আজকের সময়ে সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলো এই কাজটাই করছে না কি? যাঁদের কথা আমরা অক্ষরে অক্ষরে বিশ্বাস করছি? ওই ৩০ জানুয়ারি, ১৯৪৮। খুন হন মহাত্মা গান্ধী। সেদিনই কি সত্যের হত্যা হয়েছিল? ভারতের বিরোধী দলের কিন্তু দায়িত্ব বর্তায় মানুষের সামনে সত্যটা উন্মোচন করার। বড় টেকনোলজিক্যাল কোম্পানিগুলো ব্যবসা সম্প্রসারণের নামে এই ঘৃণ্য কাজটি করতে পারে না। এই সত্যিটা দেশের নাগরিকের সামনে তুলে ধরার মুখ্য দায়িত্বটা বিরোধীদেরই নিতে হবে। যাঁরা নিজেরা রাজনীতি করেন না বলে সত্যিটা জেনে-বুঝেও মিথ্যেটা মুখ বুজে মেনে নিচ্ছেন বা পাশ কাটিয়ে যাচ্ছেন, সেই অগণন জনতাও দেশের সর্বনাশের জন্য দায়ী থাকবেন। বহু সংস্কৃতি, ভাষা এবং ধর্মের এই ভারতে এটা করা শুধু ভুল নয়, অন্যায়ও বটে। এক্ষেত্রে কেউই দায়বদ্ধতা এড়াতে পারেন না।