পুরনো রোগ চাগাড় দেওয়ায় দেহকষ্ট ভোগ করতে হতে পারে। তীর্থ ভ্রমণ ও ধর্মকর্মে আত্মিক তৃপ্তিলাভ। ... বিশদ
সদস্যদের উপস্থিতি যদি সন্তোষজনকও হয়, আবহটা কিন্তু স্বাভাবিক হবে না। আমার মনে হয়, কক্ষ দু’টি সংসদীয় গণতন্ত্রের এমন একটি রূপের প্রতিফলন ঘটাবে যেখানে তার মেজাজটা অনুপস্থিত এবং আত্মাটা বেপাত্তা হয়ে গিয়েছে।
এক জাতি, সবকিছু এক
সংসদের দুই কক্ষের মূল কার্যসূচিতে থাকবে বকেয়া বিলগুলি এবং সংসদের দুই অধিবেশনের মধ্যবর্তীকালে ঘোষিত এগারোটি অর্ডিন্যান্স। অর্থনীতি ভেঙে পড়েছে। মহামারী ভয়ঙ্কর আকার নিয়েছে। রয়েছে চীনের হুমকি। জাতি আজ এমনসব সঙ্কটের মুখোমুখি। কিছুতেই বোধগম্য হচ্ছে না যে এমন এক কঠিন মুহূর্তেও সরকার কেন গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলিতে কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক পাল্টে দেওয়ার জন্য ছলনাপূর্ণ প্রচেষ্টা করছে। প্রধানমন্ত্রীর ‘পেট থিয়োরি’ বা পছন্দের বিষয় হল—‘ওয়ান নেশন, ওয়ান এভরিথিং’—অর্থাৎ ‘এক জাতি, সবকিছুই এক’! এই অর্ডিন্যান্সগুলিও তাঁর পেট থিয়োরিরই অংশ। রাজ্যগুলি এবং কেন্দ্রের মধ্যে একটি সাংবিধানিক মৈত্রীর সম্পর্ক রয়েছে যে ভারত হবে রাজ্যগুলির একটি ‘ইউনিয়ন’ এবং ‘লেজিসলেটিভ’ ও ‘এগজিকিউটিভ’ ক্ষমতার অংশীদারিত্ব হবে ফেডারালিজমের মূল নীতি। প্রধানমন্ত্রীর পছন্দের এই তত্ত্ব ভারত নামক ইউনিয়ন এবং ফেডারালিজমের মূলে কুঠারাঘাত করছে।
বিগত বছরগুলিতে রাজ্যগুলি অনেক অনেক ক্ষমতা কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। সব দলই ভারত শাসন করেছে। অতএব, এই ব্যাপারে সব দলকেই দায়ী করতে হবে। রাজ্যগুলির ক্ষমতা অন্যায়ভাবে দখলের ব্যাপারটিকে নরেন্দ্র মোদি বস্তুত অন্য এক উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছেন। আর এই আঘাত বহাল রয়েছে কেন্দ্রের প্রশাসনিক এবং সংসদীয় তৎপরতার মাধ্যমে। নতুন কয়েকটি অর্ডিন্যান্সের দিকে তাকানো যাক।
ব্যাঙ্কিং (নিয়ন্ত্রণ) আইন
আজ ব্যাঙ্কগুলি, কিছু নন-ব্যাঙ্কিং ফিনান্স কোম্পানি (এনবিএফসি) এবং আর্থিক ক্ষেত্রে মধ্যবর্তী অন্য সমস্ত প্রধান প্রতিষ্ঠানগুলিকে (ফিনান্সিয়াল ইন্টারমিডিয়ারি) এই ব্যাঙ্কিং (নিয়ন্ত্রণ) আইনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এই ব্যাপারে নিয়ন্ত্রক হল রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। আরবিআই ইতিমধ্যেই দায়িত্বের চাপে কাহিল হয়ে রয়েছে। নিয়ন্ত্রক হিসেবে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের রেকর্ডটা পাঁচ মিশেলি: এহেন নজরদারির ভিতর দিয়েই কিন্তু যাবতীয় বড় আর্থিক কেলেঙ্কারিগুলি ঘটে গিয়েছে। সমবায় ব্যাঙ্কই হল একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ ফিনান্সিয়াল ইন্টারমিডিয়ারি যেটি রাজ্য সরকারের নিয়ন্ত্রণ ও তত্ত্বাবধানে রয়েছে। অধিকাংশ রাজ্যে রয়েছে জেলা কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্ক (ডিসিসিবি) এবং শহরাঞ্চল সমবায় ব্যাঙ্ক (ইউসিবি)। জেলা ভিত্তিক এই ‘অ্যাপেক্স’ ব্যাঙ্কগুলি তাদের সদস্য ব্যাঙ্কগুলিকে অর্থ জোগানের ব্যাপারটি দেখে। কিছু ডিসিসিবি এবং ইউসিবি তো উপকথার চরিত্রের মতো হয়ে উঠেছে! কিছু হয়ে উঠেছে এই ক্ষেত্রে লড়াই-সংগ্রামের শক্তি। আবার কিছু একেবারে যা তা! এই ধরনের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলি ভালোই হোক আর মন্দই হোক—তাদের নিয়ন্ত্রণের জন্য যথেষ্ট ক্ষমতাবান একটি রাজ্য সরকার তো রয়েছে। সেই অবস্থানটিকে কেন বদলে দেওয়া হবে? অর্ডিন্যান্স বলে মোদি সরকার সমস্ত ডিসিসিবি এবং ইউসিবি-কে কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিয়েছে এবং নিয়ন্ত্রকের সরকারি তকমা দিয়ে রেখেছে রিজার্ভ ব্যাঙ্কটিকে। সমবায় ব্যাঙ্কের ‘সদস্যপদ কাঠামো’ এবং ‘আর্থিক কাঠামো’ পাল্টে দেওয়ার জন্য ক্ষমতা নিয়ে নেওয়া হয়েছে। এর পরিণাম যেটা হতে পারে তা হল—সমবায় ব্যাঙ্কের নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনা কিছু আগন্তুক ব্যক্তি এবং সুযোগসন্ধানীর হাতে চলে যেতে পারে। এই অর্ডিন্যান্সের মতলবটা হল—সমস্ত বড় ফিনান্সিয়াল ইন্টারমিডিয়ারি কেন্দ্রীয় সরকারের তাঁবে চলে যাবে এবং ডিসিসিবি ও ইউসিবি-র ম্যানেজমেন্ট বা নির্বাচিত ডিরেক্টগণ কেন্দ্রীয় সরকারের আজ্ঞাবহ হয়ে যাবেন। এই অর্ডিন্যান্স হল রাজ্যগুলির অধিকারের উপর একটি নগ্ন আগ্রাসন।
নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য আইন
আমি মনে করি যে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য আইনটি (ইসি অ্যাক্ট) সঙ্কট এবং নিয়ন্ত্রণের কালের জন্য তৈরি। ভারত যখন খাদ্যশস্যে উদ্বৃত্ত এবং চাহিদামতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য উৎপাদনে সক্ষম তখন এই আইনের বাস্তবিকই কোনও ভূমিকা থাকে না। তবুও একটি ব্যাপার অস্বীকার করা যাবে না যে মরশুমি স্বল্পতা এবং বন্যা ও খরার মওকায় মজুতদারি ও কালো বাজারি হয়ে থাকে। এই কারণেই ইসি অ্যাক্ট সংবিধি বইতে টিকে রয়েছে এবং এর মাধ্যমে রাজ্য সরকারগুলিকে পর্যাপ্ত ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এই ক্ষমতা রাজ্যগুলিকে দেওয়া হয়েছে এই সংক্রান্ত ট্রেড বা কেনাবেচা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। মধ্যবর্তী প্রতিষ্ঠানগুলি কতটা নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য সংগ্রহ বা মজুত করতে পারবে তার ঊর্ধ্বসীমা এই আইন বলেই রাজ্যগুলি ঠিক করে দেয়। এর পর যদি কেন্দ্রীয় সরকার আইনটিকে আরও উদার করতে চায় তবে একটি পলিসি পেপার প্রকাশ করতে পারে অথবা একটি আদর্শ আইন তৈরি করতে পারে এবং সেটা কার্যকর করার ভার রাজ্যগুলিকে অর্পণ করতে পারে। মোদি সরকারের মতলব এসব দিয়ে মিটবে না। অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে রাজ্য সরকারগুলির নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতাটিকে গণ্ডিবদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে এবং মজুত করার ঊর্ধ্ব সীমা (স্টক লিমিট) নির্ধারণের ক্ষমতাটিকেও অলীক করে ফেলা হয়েছে। একটি শর্ত ও একটি ব্যাখ্যামূলক ধারা সংযুক্তির মাধ্যমে এই অর্ডিন্যান্স ‘স্টক লিমিট’-এর ধারণাটিকে অলীক এবং অর্থহীন করে তুলেছে। এই অর্ডিন্যান্স যদি শেষমেশ আইনে পরিণত হয় তবে মজুতদাররা আনন্দে ফেটে পড়বে।
এপিএমসি আইন এবং চুক্তির স্বাধীনতা
আমার মনে হয় যে কৃষিপণ্য বিপণন কমিটি (এপিএমসি) আইন কিছু সময় অন্তর অবশ্যই সংশোধন করা প্রয়োজন এবং কৃষিপণ্যের বিপণনও ধীরে ধীরে অবশ্যই উদার করে দেওয়া দরকার। আদর্শ আইন প্রণয়ন এবং মানুষের বিশ্বাস উৎপাদনই হল এই লক্ষ্য পূরণের উপায়—সংসদীয় নির্দেশ জারি কোনও সমাধান নয়। রাজ্য বিধানসভায় পাশ হওয়া এপিএমসি আইন অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকার বাতিল করে দিল। এর ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পাঞ্জাব, হরিয়ানা, মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তিশগড় রাজ্য। অন্য যেসব রাজ্য সরকারিভাবে শস্য সংগ্রহে বিপুল পরিমাণ পুঁজি বিনিয়োগ করেছে তারাও। এবং, যারা কৃষকদের জন্য ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের (এমএসপি) নিশ্চয়তা দিয়েছে। সন্দেহ হচ্ছে যে, মোদি সরকার শান্তা কুমার কমিটির বিতর্কিত সুপারিশগুলি কার্যকর করার চেষ্টা করছে। সেটি হলে কিন্তু সরকারিভাবে শস্য সংগ্রহ ব্যবস্থা, গণবণ্টন ব্যবস্থা (পিডিএস/রেশন), এমএসপি নীতি এবং খাদ্যের নিরাপত্তা ব্যবস্থা—সবই লঘু হয়ে যাবে। চুক্তির স্বাধীনতার উপর যে সহযোগী অর্ডিন্যান্স জারি হয়েছে—তাতে ক্রেতা এমএসপি নীতি মানতে বাধ্য নন। এমএসপি-র কম দাম দেবেন না—এরকমটা মানতে তাঁকে বাধ্য করা যাবে না। এই সন্দেহই গভীর হচ্ছে যে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য ব্যাপারটি তুলে দেওয়া হচ্ছে। পাঞ্জাবের কৃষকরা রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করছেন। পাঞ্জাব রাজ্য বিধানসভা ঐকমত্যের ভিত্তিতে দু’টি অর্ডিন্যান্সই প্রত্যাখ্যান করেছে। অকালি দল রেজোল্যুশন বা প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছে। অর্ডিন্যান্সগুলি প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে ছত্তিশগড়। হরিয়ানা এবং মধ্যপ্রদেশ অজ্ঞাত কারণে নীরব। এটা পরিষ্কার যে মোদি সরকার এবার তার বিপুল গরিষ্ঠতাকে ব্যবহার করবে। রাজ্যগুলির মতামতের কোনও তোয়াক্কা করবে না। ইচ্ছেমতো সংশোধনী পাশ করিয়ে নেবে। ফেডারালজিমকে আরেকটি ধাক্কা দেবে।
‘এক জাতি, এক সবকিছু’ পরিণামে ‘এক জাতি’কে ধ্বংস করে ছাড়বে।
লেখক সংসদ সদস্য ও কেন্দ্রের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী। মতামত ব্যক্তিগত