কর্মে শুভ। নতুন কর্মপ্রাপ্তি বা কর্মসূত্রে দূররাজ্য বা বিদেশ গমন হতে পারে। আনন্দানুষ্ঠানে যোগদান ও ... বিশদ
প্রথমত, স্কুলে ১০+২ ব্যবস্থার পরিবর্তে ৫+৩+৩+৪ ব্যবস্থা চালু করা হবে। (অনুচ্ছেদ ৪.১) এর মধ্যে প্রথম তিন বছরকে বলা হচ্ছে প্রাক-প্রাথমিক স্তর। এর সঙ্গে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীকে যুক্ত করে প্রথম ৫ বছরকে বলা হচ্ছে ফাউন্ডেশনাল স্তর। এই স্তরে নমনীয় বহুমুখী, খেলাধুলাভিত্তিক, হাতের কাজ ও উদ্ভাবনা-কেন্দ্রিক শিক্ষা দেওয়া হবে। (অনুচ্ছেদ ৪.২) এই স্তরের শিক্ষার দায়িত্ব তুলে দেওয়া হচ্ছে অঙ্গনওয়াড়িদের হাতে। অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলির কী শোচনীয় অবস্থা তা অনেকেরই জানা। ফাউন্ডেশনাল স্তরে যেভাবে শিক্ষা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে তার জন্য উপযুক্ত পরিকাঠামো কোনও অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রেই নেই। তাছাড়া শিক্ষাদান করার কোনও ট্রেনিং অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের থাকে না। যদিও শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছে, তাঁদের অনলাইন ট্রেনিং দেওয়া হবে। কিন্তু অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রেগুলির ২৭ শতাংশ চলে ভাড়া বাড়িতে। ২৬ শতাংশের শৌচাগার নেই। প্রায় ১২ শতাংশে পানীয় জলের ব্যবস্থা নেই। গত ডিসেম্বরে লোকসভায় মন্ত্রী স্মৃতি ইরানির বিবৃতিতেই এসব স্বীকারোক্তি রয়েছে। অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদেরও অত্যন্ত স্বল্প ভাতায় কাজ করতে হয়। তাঁদের ওপর শিক্ষার ভার চাপালে শিশুরা কেমন শিক্ষা পাবে তা সহজেই অনুমেয়। এখন কোনও কোনও সরকারি স্কুলে ১ বছরের প্রাক-প্রাথমিক স্তর থাকলেও ৩ বছরের প্রাক-প্রাথমিক স্তর চালানোর মতো পরিকাঠামো কোথাও নেই। আর এখন অধিকাংশ প্রাথমিক স্কুলে চারটি শ্রেণীর পঠনপাঠন চালানোর মতো পর্যাপ্ত শ্রেণীকক্ষ ও শিক্ষক নেই। তাই প্রাথমিক স্কুলগুলিতে প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণী অন্তর্ভুক্ত করতে হলে পরিকাঠামো অনেকটাই উন্নত করতে হবে, যার জন্য প্রচুর অর্থ বরাদ্দ করা প্রয়োজন।
এবিষয়ে শিক্ষানীতি নীরব। তাই সরকারি স্কুলের ওপর ভরসা না করে অভিভাবকরা বেসরকারি প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তাঁদের সন্তানদের ভর্তি করবেন। এভাবে সরকার কি শিক্ষার বেসরকারিকরণ করতে চাইছে? দ্বিতীয়ত, প্রাক-প্রাথমিকে প্রাতরাশ দেবার যে প্রস্তাব করা হয়েছে সেটা সাধুবাদযোগ্য হলেও তার জন্য অর্থ বরাদ্দের কোনও কথা বলা নেই। তৃতীয়ত, মাধ্যমিক স্কুলগুলিকে উচ্চমাধ্যমিক স্তরে উন্নত করার জন্যও প্রচুর অর্থ প্রয়োজন এবং নতুন শিক্ষক নিয়োগ প্রয়োজন। এসব বিষয়ে শিক্ষানীতি নীরব। চতুর্থত, তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত, যাকে বলা হচ্ছে প্রস্তুতি ধাপ, সেখানে অল্প কিছু পাঠ্য বই থাকলেও (অনুচ্ছেদ ৪.২) বিষয় শিক্ষা শুরু হবে ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে। এর অর্থ পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত ছাত্ররা খুব কম শিখবে। অথচ বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলির ছাত্রদের তুলনায় সরকারি স্কুলের ছাত্ররা অনেকটাই পিছিয়ে থাকবে। বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলিতে যেহেতু বিত্তবানদের সন্তানরাই পড়তে পারে তাই শিক্ষা ক্ষেত্রে ধনী-দরিদ্র বিভাজন হবেই। পঞ্চমত, ২.৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, স্কুলশিক্ষায় সমাজকর্মী, স্বেচ্ছাসেবক ও কাউন্সিলারদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
এর দ্বারা শিক্ষকদের ওপর অনাস্থা প্রকাশ করা হল না কি? তাছাড়া সমাজকর্মী ও স্বেচ্ছাসেবকের নামে সঙ্ঘ পরিবারের ভাবাদর্শে বিশ্বাসীদের স্কুলে অনুপ্রবেশের সুযোগ করে দিয়ে ছাত্রদের মধ্যে সঙ্ঘ পরিবারের ভাবাদর্শ প্রচারের সুযোগ করে দেওয়া হবে এমন সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ আছে। কেন্দ্রীয় সরকার যে নানাভাবে শিক্ষার গৈরিকীকরণ করতে সচেষ্ট তার বহু দৃষ্টান্ত আছে। এটিও তার অঙ্গ। ষষ্ঠত, সামাজিক ও আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য উন্নত বিদ্যালয় পরিকাঠামো গড়ে নিয়মিত ও প্রথাগত শিক্ষার আঙ্গিনায় না এনে, তাদের জন্য দূরশিক্ষা ও মুক্ত বিদ্যালয়ের সুপারিশ করেছে এই নীতি (অনুচ্ছেদ ৩.৫), যা অচিরেই এই বিরাট অংশের শিক্ষার্থীদের শিক্ষা থেকে দূরে ঠেলে দেবে। সপ্তমত, শিক্ষাবিদ ও শিক্ষকরা দীর্ঘদিন ধরে প্রথম শ্রেণী থেকে পাশ-ফেল চালুর দাবি জানালেও এই শিক্ষানীতি এ বিষয়ে নীরব। পরিবর্তে তৃতীয়, পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণীতে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ কর্তৃক পরীক্ষা নেবার কথা বলা হয়েছে (অনুচ্ছেদ ৪.৪০)। উপরন্তু নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত প্রতি বছর দু’টি করে সেমেস্টার পদ্ধতিতে পরীক্ষা দিতে হবে। এই বয়সের ছাত্রদের যা ম্যাচিওরিটি তাতে বিষয়বস্তুর গভীরে প্রবেশ করতে হলে তা সময় নিয়ে করতে হয়। তাই সেমেস্টার পদ্ধতিতে ছাত্রদের জ্ঞানের গভীরতা তৈরি হবে না। অষ্টমত, ৪.৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ছাত্রদের বিষয় নির্বাচনে স্বাধীনতা দেওয়া হবে এবং ক্যারিকুলার, এক্সট্রা-ক্যারিকুলার, কো-ক্যারিকুলার বা কলা, বিজ্ঞান বা ভোকেশনাল ও অ্যাকাডেমিক বিষয়ের মধ্যে কোনও বিভেদ থাকবে না। ফলে একজন ছাত্র যেসব বিষয়
নির্বাচন করবে তা তার সামগ্রিক জ্ঞান অর্জনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
নবমত, ষষ্ঠ শ্রেণী থেকেই কর্মমুখী শিক্ষা দেওয়ার ওপর এই শিক্ষানীতিতে জোর দেওয়া হয়েছে (অনুচ্ছেদ ৪.২৬)। স্কুল থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত কর্মমুখী শিক্ষা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে এই শিক্ষানীতিতে। যেখানে দেশে বেকার সমস্যা ক্রমবর্ধমান, উচ্চশিক্ষিতরাও, এমনকী ইঞ্জিনিয়ার ও প্রযুক্তিবিদরাও চাকরি পাচ্ছেন না, পিয়ন পদের জন্যও উচ্চশিক্ষিতরা, এমনকী পিএইচ-ডি ডিগ্রিধারীরাও আবেদন করছেন, সেখানে কর্মমুখী শিক্ষা ছাত্রদের কতটুকু কাজে লাগবে? আসলে সরকারের উদ্দেশ্য হল, শিক্ষা শেষে চাকরি দেওয়ার দায়িত্ব অস্বীকার করা। দশমত, ৫.১২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে শিক্ষকরা শিক্ষাদান সংক্রান্ত বিষয় ছাড়া প্রশাসনিক কাজ করবেন না। সাধু প্রস্তাব। কিন্তু কাজগুলি করবে কে? স্কুলগুলিতে তো কোনও শিক্ষাসহায়ক কর্মী দেবার কথা বলা হয়নি।
দেখা যাচ্ছে, সরকারি স্কুলগুলির পরিকাঠামো উন্নত করে শিক্ষাকে সব মানুষের নাগালের মধ্যে নিয়ে আসার জন্য যে অর্থের প্রয়োজন তা বরাদ্দের কোনও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা এই শিক্ষানীতিতে নেই। বরং এই শিক্ষানীতি শিক্ষার বেসরকারিকরণের পথকেই প্রশস্ত করবে। শিক্ষা ক্ষেত্রে ধনী-দরিদ্র বৈষম্য আরও বাড়বে। দরিদ্র ও মধ্যবিত্তের সন্তানরা শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে। ইউনেস্কো তার সাম্প্রতিক রিপোর্টে বলেছে, এদেশে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী শিক্ষাক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ছে। যেখানে কেরল ও ওড়িশার ধনীদের সন্তানরা যথাক্রমে ৮৭ শতাংশ এবং ৭৪ শতাংশ উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সম্পূর্ণ করে, সেখানে দুই রাজ্যেই দরিদ্রদের মাত্র ৫-৬ শতাংশ হাই স্কুলের গণ্ডি পেরতে পারে। তাছাড়া সামগ্রিক জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রেও শিক্ষানীতি প্রতিবন্ধক হবে। এক কথায় এই শিক্ষানীতি শিক্ষার সর্বনাশ ডেকে আনবে।