কর্মে শুভ। নতুন কর্মপ্রাপ্তি বা কর্মসূত্রে দূররাজ্য বা বিদেশ গমন হতে পারে। আনন্দানুষ্ঠানে যোগদান ও ... বিশদ
শিক্ষানীতির রূপায়ণ অনেকটাই নির্ভর করবে রাজ্য সরকারগুলির সদিচ্ছার উপর। এই বিষয়ে আন্তরিকতা খুব জরুরি। ব্যাপারটা গণবণ্টন বা রেশন ব্যবস্থার বর্তমান মান ও পরিস্থিতির সঙ্গে মিলিয়ে পর্যালোচনা করা যেতে পারে। মিড ডে মিল স্কিমের দিকেও তাকানো যায়। জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা আইনের বাস্তবায়ন এবং শিশুর অধিকার সুরক্ষিত রাখার জন্য এই ব্যবস্থা। এটিও নানা রাজ্যে এক বড় দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। আলোচনা প্রসঙ্গে মিড ডে মিলের কথা যখন এলই, তখন নতুন শিক্ষানীতিতে মূল খাবারের আগে প্রাতঃরাশ দেওয়ার যে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে সেটার কথা বিবেচনা করা দরকার। এটি স্কুলগুলিতে ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিতির হার বাড়াতে সাহায্য করবে। তবে কোনও রাজ্য সরকার দুর্নীতিপরায়ণ হলে এই সমস্ত উদ্দেশ্য পূরণ হওয়া কঠিন হবে। তখন এই বাবদ কেন্দ্রের দেওয়া অর্থ সাহায্য কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক নেতার ব্যক্তিগত মুনাফা বাড়াতে সাহায্য করবে মাত্র।
স্কুলশিক্ষার আর একটি বড় সমস্যা হল স্কুলছুট। আমরা দেখতে পাই যে, প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তরে যাওয়ার আগে ৫০ শতাংশ ছাত্রছাত্রী পড়াশোনাই ছেড়ে দেয়। এই শিক্ষানীতিতে আগামী ১০ বছর স্কুলগুলিকে এরকম লক্ষ রাখতে বলা হচ্ছে, যাতে প্রাথমিক স্তরে ভর্তি হওয়ার পরে উচ্চতর স্তরের শেষধাপ অবধি প্রায় ১০০ ভাগ ছাত্রছাত্রীই স্কুলে যায়। এই নীতি রূপায়িত হলে এরকম একটি বিরাট সমস্যার সমাধান হওয়া সম্ভব। আর একটি সমস্যা হল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উপযুক্ত পরিকাঠামোর অভাব। স্কুলগুলি, বিশেষভাবে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের, অনেক সময়ই অপরিসর। বড় জায়গা নিয়ে পূর্ণাঙ্গ স্কুল ক্যাম্পাস নির্মাণের প্রয়োজন। যেখানে থাকবে উপযুক্ত খেলার মাঠ, শরীরচর্চা ও আনুষঙ্গিক মানসিক বিকাশের অন্যান্য মাধ্যমগুলি। এবারের শিক্ষানীতিতে, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বা উচ্চতর অংশের মধ্যে খেলার মাঠ, ল্যাবরেটরি ইত্যাদি পরিকাঠামো সর্বাপেক্ষা উপযুক্ত ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে। এটিও ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে সর্বস্তরের ছাত্রছাত্রীদের সার্বিক বিকাশের সহায়ক হবে।
পঞ্চম শ্রেণী অবধি আবশ্যিকভাবে মাতৃভাষায় পঠন পাঠনের ব্যবস্থা রাখা ব্যতিরেকে আরও উচ্চতর শ্রেণী পর্যন্ত তিনটি ভাষা পাঠ ছাত্রছাত্রীদের পক্ষে খুবই উপযোগী হবে। কারণ শিক্ষা শুধুমাত্র পাঠের প্রয়োজনে নয়, জীবিকা ও ব্যবহারিক কারণে ইংরেজি ও হিন্দি ভাষা শিক্ষা এদেশের সব রাজ্যেই প্রয়োজন। প্রাথমিক স্তরে মাতৃভাষায় পঠন-পাঠনের উৎকর্ষ বহুদিন যাবৎ সারা বিশ্বে স্বীকৃত। তাছাড়া এবারের শিক্ষানীতিতে ভারতের আদি ভাষা হিসেবে সংস্কৃত শিক্ষার উপর দৃষ্টি দিতে বলা হয়েছে। স্কুলশিক্ষা ব্যবস্থাকে ১০+২ থেকে (৩+২)+৩+৩ ব্যবস্থায় পরিবর্তিত করা সময়ের সঙ্গে প্রয়োজনীয় হয়েও পড়েছিল।
সুদীর্ঘ ৩৪ বছর কোনও নতুন শিক্ষানীতি না আসায় পুরনো ১০+২ ব্যবস্থায় শেষের দু’টি বছরে ছাত্রছাত্রীদের অতিরিক্ত পড়াশোনার চাপ রয়েছে। পরবর্তী স্তরে সুযোগ লাভের বিভিন্ন প্রবেশিকা পরীক্ষায়ও এটা ভারাক্রান্ত। দশম শ্রেণীর বোর্ডের সঙ্গে পরীক্ষা ব্যবস্থা তুলে দিয়ে নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত একটি অভিন্ন ৮ সেমিস্টারের ব্যবস্থা আসতে চলেছে। এতে ছাত্রছাত্রীদের উপর পড়াশোনার মাত্রাতিরিক্ত চাপ কিছুটা হলেও কমবে। শিক্ষানীতির অন্যতম আধুনিক সংযোজন হল আবশ্যিকভাবে উচ্চতর স্কুলশিক্ষায় গণিত ও বিজ্ঞানের পঠনপাঠন। এছাড়া সেকেন্ডারি স্তরে কলা, বিজ্ঞান বা বাণিজ্যের মতো কোনও আলাদা বিভাগ থাকছে না। ফলে, ভবিষ্যতে একটি মাল্টি ডিসিপ্লিনারি সিস্টেম থেকে পরবর্তী সময়ে বিষয় নির্বাচনে ছাত্রছাত্রীদের নিজস্ব পছন্দ কার্যকরী করার সুযোগ থাকছে। এখন স্কুলশিক্ষায় থাকবে নিমোক্ত চারটি ভাগ :
১। ফাউন্ডেশন স্টেজ (৩ বছর প্রাথমিক-পূর্ব স্কুলে, ২ বছর প্রাথমিক স্কুলে প্রথম থেকে দ্বিতীয় শ্রেণী পর্যন্ত, সব মিলিয়ে একটি শিশুর ৩ বছর থেকে ৮ বছর বয়স অবধি)।
২। প্রিপারেটরি স্টেজ (তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত, অর্থাৎ ৮ বছর থেকে ১১ বছর বয়স অবধি)।
৩। মিডল স্টেজ (ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত, অর্থাৎ ১১ থেকে ১৪ বছর বয়স অবধি)।
৪। সেকেন্ডারি স্টেজ (নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত, অর্থাৎ ১৪ থেকে ১৮ বছর বয়স অবধি)।
ফাউন্ডেশনে স্টেজে ৩ বছরের একটি শিশু আরলি চাইল্ডহুড কেয়ার অ্যান্ড এডুকেশন (ইসিসিই) ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে যাবে। এটিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। সেই শিশুটির অঙ্গনওয়াড়ি বা প্রাথমিক-পূর্ব কোনও স্কুলে ৩ বছর বয়স থেকে সম্পূর্ণ শিশু উপযোগী মনোবিকাশের জন্য যা প্রয়োজন সেরকম শিক্ষার কথা বলা হয়েছে। এটি বোধহয় শিক্ষানীতির খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক। ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে বৃত্তিমূলক পড়াশোনা শুরু করার কথা বলা হয়েছে। ২০২৫ সালের মধ্যে অন্তত ৫০ শতাংশ স্কুল ও উচ্চশিক্ষার ছাত্রছাত্রীর বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়েছে। ষষ্ট থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত এই সময়কালে ১০ দিনের ব্যাগবিহীন ‘ইনটার্নের’ ব্যবস্থা করতে হবে স্থানীয় কাঠের মিস্ত্রি, মালি, কুমোর, শিল্পী প্রমুখের কাছে। একইভাবে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত বৃত্তিমূলক বিষয়ে ইন্টার্নশপি করার সুযোগ দিতে হবে (ছুটির দিন সমেত)। এই প্রস্তাবগুলি কার্যকর হলে ছাত্রছাত্রীরা ভবিষতে বিভিন্ন বৃত্তিমূলক ক্ষেত্রে নিযুক্ত হতে পারবে।
শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নের জন্য শিক্ষক নিয়োগেও চালু হবে বেশ কয়েকটি নিয়ম। প্রাথমিক-পূর্ব থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষক নিয়োগ হবে টিইটি বা এনটিএ স্কোর এবং ডেমনস্ট্রেশনের উপর ভিত্তি করে। স্বচ্ছতার জন্য শিক্ষকদের বদলি কম্পিউটার ভিত্তিক করা হতে পারে। স্কুল স্তরে আংশিক সময়ের শিক্ষক বা প্যারাটিচার নিয়োগ প্রথা তুলে দেওয়ায়, গুণগতভাবে উপযুক্ত শিক্ষকদের সম্মানের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ বাড়বে। শিক্ষকদের যোগ্যতা কী হবে, সেই বিষয়ে এনসিটিই ২০২২ সাল নাগাদ ন্যাশনাল প্রফেশনাল স্ট্যান্ডার্ডস ফর টিচার্স (এনপিএসটি) নামে একটা সাধারণ নির্দেশিকা প্রকাশ করবে। ২০২১ সাল নাগাদ এনসিটিই এবং এনসিইআরটি-র যৌথ উদ্যোগে ন্যাশনাল কারিকুলাম ফ্রেমওয়ার্ক ফর টিচার্স এডুকেশন (এনসিএফটিই) ২০২১ প্রকাশ পাবে।
মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের নাম পরিবর্তন করে শিক্ষামন্ত্রক করা হবে। কাজেই, শিক্ষা তার সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হবে না বলেই আশা করা যায়। মনে রাখা ভালো, এই প্রথম জাতীয় আয়ের ৬ শতাংশ শিক্ষা খাতে ব্যয় করা হবে বলে জানানো হয়েছে। এটি শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দীর্ঘদিনের দাবি। এটি হতে চলেছে। এর চেয়ে স্বস্তি ও আনন্দের খবর আর কী হতে পারে?
লেখক বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। মতামত ব্যক্তিগত