কর্মে শুভ। নতুন কর্মপ্রাপ্তি বা কর্মসূত্রে দূররাজ্য বা বিদেশ গমন হতে পারে। আনন্দানুষ্ঠানে যোগদান ও ... বিশদ
বেঙ্গল লাইন ও কেরল লাইন ছিল সিপিএমের ‘অন্দর কি বাত’-এর মতো। তা পার্টির নেতা আর ক্যাডারদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। তাঁরাই কেবল জানতেন দল পরিচালনা, দলের নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে কমিউনিস্ট পার্টির ভিতরে এই দু’টি লবির লড়াইয়ের কথা। কিন্তু সেই গোপন কথাটি আর গোপন রইল না ১৯৯৬ সালে, যখন দেশের প্রধানমন্ত্রীর কুর্সিতে বাঙালির বসার সম্ভাবনা খারিজ হয়ে গেল। তখন গেরুয়া শিবিরকে ঠেকাতে দেশের প্রায় সমস্ত অবিজেপি দল জ্যোতি বসুকে প্রধানমন্ত্রী করার প্রস্তাব দিয়েছিল। জ্যোতি বসু তো বটেই, সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক হরকিষেণ সিং সুরজিৎও সেই প্রস্তাবে রাজি ছিলেন। কিন্তু, মূলত কেরল লবির বিরোধিতায় আটকে গিয়েছিল জ্যোতিবাবুর প্রধানমন্ত্রী হওয়া। ভয়ঙ্কর চটেছিলেন জ্যোতিবাবু। তারপরই তাঁর সেই বিখ্যাত উক্তি, ‘ঐতিহাসিক ভুল।’
আরও একবার কেরল লাইনের ক্ষমতা টের পেয়েছিলেন এ রাজ্যের মানুষ। ২০০৮ সালে। কেন্দ্রে তখন কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকার। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। ২০০৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বামফ্রন্ট ৬০টি আসন জিতেছিল। কোনও দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। কংগ্রেস চেয়েছিল, কেন্দ্রের ইউপিএ সরকারে যোগ দিক বামফ্রন্ট। বামেরা সরকারে যায়নি। তবে তাদের প্রতিনিধি হিসেবে লোকসভার স্পিকার হয়েছিলেন সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়। সেই সরকারের চার বছরের মাথায়, ২০০৮ সালে পরমাণু চুক্তিকে ঘিরে কংগ্রেস ও সিপিএমের বিরোধ চরমে উঠেছিল। বামেদের প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও মনমোহন পরমাণু চুক্তির সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন। আর তাতেই সরকার থেকে সমর্থন তুলেছিল সিপিএম।
সেই সিদ্ধান্তের পিছনেও ছিল কেরল লাইনের চাপ। সোমনাথবাবুকে স্পিকার পদ ছাড়তে নির্দেশ দিয়েছিল দল। কিন্তু, মানেননি সোমনাথবাবু। মাঝপথে সরকারকে বিপাকে ফেলতে চাননি তিনি। নির্দেশ না মানায় পার্টি থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন। তবে বামেরা সমর্থন তুললেও সরকার পড়েনি। উল্টে পশ্চিমবঙ্গ সরকার থেকে উৎখাত হওয়ার বীজ সেইদিনই পোঁতা হয়ে গিয়েছিল। সিপিএম সরতেই কংগ্রেসের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কাছাকাছি এসেছিল দুই কংগ্রেস। তারই পরিণতিতে ২০১১ সালের বিধানসভা ভোটে কংগ্রেস-তৃণমূল জোট।
সেই জোটই উপড়ে দিয়েছিল বামফ্রন্ট সরকারের ৩৪ বছরের শিকড়। কেরল লবির চাপে কংগ্রেসের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন না করলে এরাজ্যে সিপিএমের এত তাড়াতাড়ি এমন দৈন্যদশা হতো না। এখনও অনেক সিপিএম নেতাকেই বলতে শোনা যায়, ২০০৮ সালে সমর্থন তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত পার্টির ‘দ্বিতীয় ঐতিহাসিক ভুল’। তাই রাজনীতিতে যখনই কোনও লাইনের কথা ওঠে তখনই বাঙালির চোখ বড় বড় হয়। আশঙ্কার প্রহর গোনে। কারণ লাইনের যে কী মহিমা, তা রাজ্যবাসী ভালোই জানেন! লাইনের চক্করেই ঘটনার ঘনঘটা।
‘কেরল লাইনে’র ধাক্কায় চুরমার হয়েছে বাঙালির প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন। সেই লাইনের চক্করেই পার্টি থেকে ঘাড়ধাক্কা খেয়েছেন সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়। আর দলে ফিরতে পারেননি। তাঁকে বলা হয়েছিল, ভুল স্বীকার করে চিঠি দিলেই দলে ফিরিয়ে নেওয়া হবে। কিন্তু, তিনি তা করেননি।
ফের বঙ্গ রাজনীতিতে একটি লাইন নিয়ে চর্চা শুরু হয়েছে। একেবারে নতুন লাইন। গুজরাত লাইন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে মাঝে মধ্যেই বলতে শোনা যায়, ‘বাংলা কি গুজরাত থেকে পরিচালিত হবে? যাঁরা বাংলা ভাষা জানেন না, বাংলার সংস্কৃতি বোঝেন না, তাঁদের খবরদারি বাংলা কিছুতেই মেনে নেবে না।’
বিপ্লব মিত্র বিজেপি ছাড়ার কারণ হিসেবে ঠিক এমনই একটি কথার উল্লেখ করেছেন। বিপ্লববাবু বিজেপিতে গিয়েছিলেন লোকসভা নির্বাচনের পর। সেই সময় অনেকেই গেরুয়া শিবিরে যোগ দিয়েছেন। তাঁদের অনেকেই আবার পুরনো দলে ফিরেছেন। তাঁদের কেউ বলেছেন, গাঁদা ফুলের গন্ধ সহ্য হচ্ছিল না। কেউ বলেছেন, গুটখার গন্ধ বড় অসহ্য লাগে। কিন্তু, বিপ্লববাবু সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা বলেছেন। তাঁর কথায়, দিল্লি এবং গুজরাতের নির্দেশে বাংলা চলবে, তা বুঝে যেতেই তিনি বিজেপি ছেড়েছেন। তিনি বলেন, ‘বাংলার কীসে মঙ্গল হবে, তা দিল্লি বা গুজরাত থেকে বোঝা যায় না। এরাজ্যের মাটিতে দাঁড়িয়েই বাংলার ভালো করা সম্ভব। কিন্তু, বিজেপিতে সেই সুযোগ নেই।’
নরেন্দ্র মোদি এবং অমিত শাহ মাঝে মধ্যেই কংগ্রেসকে ‘একটি পরিবারের পার্টি’ বলে কটাক্ষ করেন। তাঁদের আক্রমণের লক্ষ্য গান্ধী পরিবার। তাঁরা খুব ভালো করেই জানেন, যতই পরিবারতন্ত্রের কথা বলা হোক না কেন, কংগ্রেসকে ধরে রেখেছে এই গান্ধী পরিবারই। এই পরিবার বিচ্ছিন্ন হলেই কংগ্রেস হবে টুকরো টুকরো। তখন দিল্লিতে বিজেপিকে চ্যালেঞ্জ জানানোর কোনও শক্তিই আর থাকবে না। সেই লক্ষ্যেই তাঁদের আক্রমণের কেন্দ্রবিন্দু গান্ধী পরিবার। সুযোগ পেলেই ঠুকে দেন।
তবে, বিজেপির এই দুই শীর্ষ নেতৃত্বের দিকেও আঙুল ওঠা শুরু হয়েছে। তাঁরাই দলের শেষ কথা। এছাড়া সরকারে এবং দলে যাঁরা রয়েছেন, তাঁরা সংখ্যা মাত্র। এই দু’জনই গুজরাতের মানুষ। দলে ছাড়াও সাউথ ব্লকে গুজরাতের আইএএস অফিসারদের দাপট ক্রমবর্ধমান। ফলে চালকের আসনে গুজরাত সুপ্রতিষ্ঠিত।
১৯ লক্ষ করোনা আক্রান্তের বোঝা ঘাড়ে নিয়ে হই হই করে হয়ে গেল রামমন্দিরের শিলান্যাস। করোনায় আক্রান্ত হওয়ায় অমিতজি সেখানে যেতে পারেননি। তবে, মোদিজির উজ্জ্বল উপস্থিতির ছটায় ঝলমল করছিল গোটা অযোধ্যা। তাঁকে ঘিরেই যত উৎসব, যত আয়োজন। অথচ কোটি কোটি হিন্দুর মনে এই রামমন্দির তৈরির স্বপ্নের বীজ যিনি বপন করেছিলেন সেই লালকৃষ্ণ আদবানি থেকে গেলেন অন্ধকারেই। বিজেপির সেই ‘লৌহ পুরুষ’ এই অনুষ্ঠানে থাকার আমন্ত্রণটুকুও পাননি।
ইতিহাস বলছে, ১৯৯০ সালে আদবানিজির ‘রাম রথযাত্রা’র জন্যই বিজেপির হিন্দুত্বের লাইন কংক্রিটের উপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই রাম রথের কারণেই দেশজুড়ে বিজেপির শক্তি একধাক্কায় দ্বিগুণ হয়েছিল। এই রথযাত্রার জন্যই গুজরাতের ক্ষমতায় বসেছিল বিজেপি। এসব দেখে অনেকেই টিপ্পনি কাটছেন, ‘কাজের সময় কাজি, কাজ ফুরলেই আদবানিজি।’
এই মুহূর্তে ‘আদবানিজি’ কোনও ব্যক্তি বিশেষ নন, হয়ে উঠেছেন প্রতীক। অবহেলার প্রতীক। বঙ্গ বিজেপিতেও ‘আদবানিজি’ আছেন। এক আধজন নয়, প্রচুর। তাঁরাই ছিলেন পঞ্চায়েত ও লোকসভা নির্বাচনে এরাজ্যে বিজেপির ভিত মজবুত করার অন্যতম কারিগর। ভেবেছিলেন, নতুন দলে গিয়ে জাঁকিয়ে বসবেন। তাঁরাই তুলে নেবেন দলের ব্যাটন। তাঁদের কেউ কেউ হয়তো পঞ্চায়েত প্রধান, কেউ কেউ এমপিও হয়েছেন। কেউ কেউ গালভরা পদও পেয়েছেন। কিন্তু ওই পর্যন্তই। কিছুতেই ভিতরে ঢুকতে পারছেন না। ঢুকতে গেলেই রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘের প্রাচীরে ঠোক্কর খাচ্ছেন। এই অবস্থায় আবার দিলীপ ঘোষ বোমা ফাটিয়েছেন, ‘বাংলার পরিবর্তন দিলীপ ঘোষ একা করতে পারবেন।’ আরএসএসের প্রাক্তন প্রচারকের এই গুণটা সব্বাই স্বীকার করেন। তাঁর মন আর মুখ এক। মনে যা থাকে, মুখ দিয়ে সেটাই গড় গড় করে বেরিয়ে যায়। তবে, তাতে অনেকের কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে লেগেছে।
রাজনীতিতে দল বদল খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। তবে, যাঁরা দল বদলান, তাঁরা ‘ঘরের ছেলে’র মর্যাদা হারান। গায়ে লেগে যায় ‘সুবিধাবাদী’ তকমা। পরিস্থিতি বলছে, তাতে রাজনীতির কুশীলবরাই হয়ে যান হাতের পুতুল। অদৃশ্য সুতোর টানেই তাঁদের যত নাচন কোঁদন। আর সুতোটা গুজরাতের তৈরি। সবাই জানে, সুতো উৎপাদনে দেশের এক নম্বর গুজরাতই!