দীর্ঘমেয়াদি সঞ্চয় ও ব্যবসা থেকে অর্থাগম যোগ। প্রেমের প্রস্তাব পেতে পারেন। পুজো পাঠে মন। ... বিশদ
‘প্রজেক্ট জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীর’ নেওয়া হয়েছিল একাধিক উদ্দেশ্যে: রাজ্যটাকে ভেঙে দেওয়া, তারপর সেটাকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে নামিয়ে আনা, পুরো অঞ্চলটাকে কেন্দ্রীয় সরকারের শাসনে নিয়ে আসা, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড দমন করা, কাশ্মীর উপত্যকার ৭৫ লক্ষ মানুষকে অনুগত থাকতে বাধ্য করা এবং বিচ্ছিন্নতাবাদ ও সন্ত্রাসবাদ নির্মূল করে ফেলা। এসব অস্ত্র যখনই ব্যবহার করা হয়েছে কোনওবারই তা লক্ষ্যভেদ করেনি। আমার ব্যক্তিগত অভিমত, এই মনোভাব (ডিসপেনসেশনস পলিসি) দিয়ে কোনওকালেই সাফল্য আসবে না।
পূর্বতন রাজ্যের পরিস্থিতি
নথিভুক্ত কিছু বাস্তব ঘটনার উপর নজর করা যাক (প্রধান সূত্র: দ্য ফোরাম ফর হিউম্যান রাইটস ইন জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীর, জুলাই ২০২০ রিপোর্ট)
২০০১ থেকে ২০১৩। সন্ত্রাসবাদী হামলার ঘটনা ৪৫২২টা থেকে কমে ১৭০টা হয়েছিল। মৃতের সংখ্যাও ৩৫২২ থেকে কমে হয়েছিল ১৩৫। এর মধ্যে সাধারণ নাগরিক, নিরাপত্তার কাজে নিযুক্ত ব্যক্তি এবং জঙ্গি সবাইকেই ধরা হয়েছে। ২০১৪ সাল থেকে, এবং বিশেষ করে ২০১৭-র পর থেকে বলপ্রয়োগের যে অতি কঠোর নীতি নেওয়া হয়েছে তা হিংসাত্মক কার্যকলাপ বাড়িয়ে দিয়েছে। নীচের সারণিতে দেওয়া তথ্য দেখুন পরিষ্কার হয়ে যাবে:
চরম পরিস্থিতিতে ৬,৬০৫ জন রাজনৈতিক কর্মীকে (যাদের মধ্যে অবশ্য ১৪৪ জন অপ্রাপ্ত বয়স্ক) হেফাজতে নেওয়া হয়েছে। মেহবুবা মুফতি সমেত অনেকজন এখনও বিনা বিচারে আটক রয়েছেন। কঠোর ও নির্মম জন সুরক্ষা আইন নির্বিচারে প্রয়োগ করা হয়েছিল (৪৪৪টা কেস করা হয়েছিল)। রাজনৈতিক নেতাদের নিরাপত্তা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। সুরক্ষিত ভবনে তাঁদের বসবাসের সুবিধা বাতিল করা হয়েছে। যার ফলে তাঁদের চলাফেরা এবং রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
উপত্যকায় সেনা এবং আধা সেনাদের উপস্থিতিটা ব্যাপক। ৩৭০ ধারা বাতিলের পর অতিরিক্ত ৩৮ হাজার ফৌজি মোতায়েন করা হয়েছিল। ১৪৪ ধারার কড়াকড়ি বস্তুত সারা বছরই বলবৎ রয়েছে। গত ২৫ মার্চ পরবর্তী লকডাউন সবকিছু বন্ধ করে দিতে প্রশাসনকে সহায়তা করেছে। যদি কোনওরকম আপাত ‘শান্তি’ সেখানে থেকে থাকে, সেটা হল জন কেনেডি যাকে বলেছিলেন ‘কবরের শান্তি’।
সমস্ত প্রধান মৌলিক অধিকারগুলো কার্যকরভাবে খারিজ হয়ে গিয়েছে। জন সুরক্ষা আইন (পিএসএ) এবং বেআইনি কার্যকলাপ প্রতিরোধ আইন (ইউএপিএ) নির্বিচারে প্রয়োগ করা হয়েছে। ঘিরে ফেলে তল্লাশি (কর্ডন অ্যান্ড সার্চ অপারেশনস, সংক্ষেপে সিএএসও বা কাসো) অভিযান চালানো হচ্ছে ব্যাপকভাবে এবং রোজ।
এটা করা হচ্ছে মানুষের চলাচল আটকাতে। অধিকার সুরক্ষা সংক্রান্ত বিধিবদ্ধ কমিশনগুলোকে ঠুঁটো করে রাখা হয়েছে। জম্মু ও কাশ্মীরে গণমাধ্যমের যে কোনও স্থান নেই তার স্পষ্ট স্বীকারোক্তি হল নতুন মিডিয়া পলিসি এবং এটা সেন্সরশিপকে অলঙ্ঘনীয় করে তুলেছে।
মুবিন শাহ, মিয়াঁ আব্দুল কায়ুম, গৌহের গিলানি, মাসরত জ়ারা এবং সফুরা জ়াফরের কেসগুলো আইনের অপব্যবহার এবং বিচার পাওয়ার সমস্যার দিকগুলো স্পষ্ট করে দিয়েছে।
দ্য কাশ্মীর চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি হিসেব দিয়েছে যে, ২০১৯-এর আগস্ট থেকে শুধু কাশ্মীর উপত্যকাতেই ৪০ হাজার কোটি টাকার উৎপাদনের ক্ষতি হয়েছে। ওই সময়কালে চাকরি নষ্ট হয়েছে ৪ লক্ষ ৯৭ হাজার। ২০১৭ সালে পর্যটক এসেছিল ৬ লক্ষ ১১ হাজার ৫৩৪ জন। ২০১৮-তে সংখ্যাটা কমে দাঁড়ায় ৩ লক্ষ ১৬ হাজার ৪২৪। আর ২০১৯-এ পর্যটকের সংখ্যাটা একেবারে তলানিতে নেমে আসে: ৪৩ হাজার ৫৯ জন মাত্র! মারাত্মকভকাবে ধাক্কা খেয়েছে ফল, পোশাক, কার্পেট, তথ্য-প্রযুক্তি যোগাযোগ এবং পরিবহণ শিল্প।
শেষমেশ সুপ্রিম কোর্টের তরফে জম্মু ও কাশ্মীর পুনর্গঠন আইনের সাংবিধানিক বৈধতা, ৪জি পরিষেবা ফের চালু করা এবং ইউএপিএ আইনের সংশোধন বিষয়ক মামলাগুলোর শুনানি ও রায়দান বাকি রয়েছে। পাশাপাশি একই অবস্থায় রয়েছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে মানবাধিক লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে রুজু হওয়া জনস্বার্থের অগুনতি মামলাও।
নয়া কাশ্মীর ইস্যু
১৯৪৭-এ শাসক যখন কাশ্মীরের ভারতভুক্তি মেনে নিলেন তখন থেকে ছিল কাশ্মীর ইস্যু। পাকিস্তানের এই শিক্ষা হয়েছিল যে, ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ জয় এবং উপত্যকা ছিনিয়ে নেওয়া তার দ্বারা হবে না। ২০১৯-এর আগস্ট থেকে নয়া কাশ্মীর ইস্যু। নয়া কাশ্মীর ইস্যুর অনেকগুলো দিক (ডাইমেনশন): ৩৭০ ধারা বাতিলের সাংবিধানিক বৈধতা। একটা রাজ্যের মর্যাদা থেকে দু’টো কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের স্তরে নামিয়ে দেওয়া। রাজনৈতিক ও মানবিক অধিকার খারিজ। অর্থনীতির ধ্বংসসাধন। জঙ্গিপনার বৃদ্ধি। কাশ্মীরে মানুষের স্থায়ী নিবাস সংক্রান্ত নতুন নীতি বা ডমিসাইল পলিসি। উপত্যকার মানুষের মনে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্নতাবোধ। এখন আত্মিক টানের অভাব—জম্মু অঞ্চলের প্রতি নয়া ডমিসাইল পলিসির কারণে এবং লাদাখের প্রতি সেখানে প্রশাসনের পুরোপুরি অনুপস্থিতির কারণে।
বাকি ভারত দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষণা করে যে জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যটা আমাদের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু এটাই দুঃখের যে জম্মু ও কাশ্মীর এবং লাদাখের মানুষের দুঃখ-যন্ত্রণার বিষয়ে তাদের কোনও কষ্ট-উদ্বেগ নেই। লাদাখে চীনাদের অনুপ্রবেশ ও আক্রমণ এবং পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের জোট বাঁধার ঘটনা শেষেমশ ভারতের তন্দ্রাভাবে ব্যাঘাত সৃষ্টি করেছে, কিন্তু সেটা যথেষ্ট নয়।
লকডাউনকালের মধ্যে লকডাউন
পুরোপুরি লকডাউন জিনিসটা যে কী সেটা বাকি ভারতের মালুম হয়েছে—কেউ বাড়ির বাইরে বেরবেন না। লকডাউনের ভিতরেও বাকি ভারতের মুক্তকণ্ঠে কথা বলায় এবং ভাবপ্রকাশে কোনও বাধা ছিল না। তাঁরা খবরকাগজ পড়তে পেয়েছেন। দেখতে পেয়েছেন টেলিভিশন। তাঁদের নাগালে ছিল টেলিফোন ও ইন্টারনেট পরিষেবা। হাসপাতাল, থানা, আদালত এবং নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে পৌঁছতেও কারও বাধা ছিল না। অন্যদিকে, সম্পূর্ণ লকডাউনের সময়টা কাশ্মীরের জন্য ছিল অধিকারগুলো খারিজ হয়ে যাওয়ার লকডাউন। বাকি ভারতের কল্পনা করা উচিত, উপরোক্ত অধিকারগুলো ও পরিষেবাগুলো নস্যাৎ হয়ে যাওয়ার লকডাউনটা কতটা পীড়াদায়ক। এটাই আজকের পরিস্থিতি।
২০১৯-এর ৫ আগস্ট যে নয়া কাশ্মীর ইস্যুর সৃষ্টি করা হয়েছে, আগামী ৫ আগস্ট তার বর্ষপূর্তি। আমাদের সংসদ ও আদালতের মতো গর্বের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো এবং বহু দলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা এই নয়া কাশ্মীর ইস্যুর কোনও জবাব খুঁজে পায়নি। এ এক দুঃখজনক ব্যর্থতা। আর এই দুঃখটা বহু গুণ হয়েছে এই কারণে যে আমাদের সামনে কোনও আব্রাহাম লিঙ্কন নেই। হৃদয়কে নাড়িয়ে দেওয়ার মতো সেই কথাগুলোও আমরা শুনতে পাই না, ‘এই জাতির জন্য নতুন স্বাধীনতার জন্ম হবে এবং যে সরকার মানুষের, মানুষের দ্বারা ও মানুষের জন্য তা পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাবে না।'
• লেখক সংসদ সদস্য ও কেন্দ্রের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী