পুরনো রোগ চাগাড় দেওয়ায় দেহকষ্ট ভোগ করতে হতে পারে। তীর্থ ভ্রমণ ও ধর্মকর্মে আত্মিক তৃপ্তিলাভ। ... বিশদ
কিন্তু অত সহজে কি আর পালানো যায়! এবার ফোন আসে স্থানীয় পুরপ্রতিনিধির কাছ থেকে। সংবর্ধনা নিতেই হবে। তাকে দেখে উৎসাহ পাবে সাধারণ মানুষ। ভরসা পাবে যে, করোনা মানেই মৃত্যু নয়। করোনাকে জয় করে ফিরে আসা যায়। আমার পরিচিত ভদ্রলোকটির পক্ষে এবার ‘না’ বলা কঠিন হয়ে পড়ে। তবে আপাতত হাসপাতাল-নির্দেশিত কোয়ারেন্টাইনের কথা বলে বিষয়টাকে খানিকটা পিছনো যায়।
করোনা যে সেরে যায়, মানুষকে এই বার্তা দেওয়াটা জরুরি নিশ্চয়। কিন্তু অতটাও জরুরি হয়তো নয়। প্রতিনিয়ত সংবাদ-মাধ্যমের প্রচারে এবং সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে আমরা প্রায় সবাইই জেনে গিয়েছি যে, করোনা যতটা ছোঁয়াচে ঠিক ততটা প্রাণঘাতী নয়। দেশভেদে, রাজ্যভেদে এই মৃত্যুর হারটার তারতম্য হয় নিশ্চয়। দশ-বারো শতাংশ মৃত্যুর হারও রয়েছে বেশ কিছু দেশে। ভারতের ক্ষেত্রে মৃত্যুর হার এই মুহূর্তে তিন শতাংশেরও কম। একশো জনের মধ্যে সাতানব্বই জনেরও বেশি সেরে যাচ্ছেন এই অসুখে। এই শতাংশটা অবশ্য করোনার পরীক্ষাতে যাদের করোনা আক্রান্ত হবার হদিশ মিলেছে তাদের মধ্যে। আমরা সবাই জানি যে, সে ছাড়াও বহু সংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন করোনাতে, যাঁদের কোনও উপসর্গ নেই। যাঁদের বলে ‘অ্যাসিম্পটম্যাটিক’ রোগী। এছাড়াও আছেন অনেক করোনা-আক্রান্ত, যাঁদের হয়তো-বা সামান্য সর্দিকাশি হয়েছিল, যাকে কোভিড বলে তাঁরা নিজেরাও ভাবতে পারেন নি। এঁরা কিন্তু সহজেই সংক্রামিত করতে পারেন অন্য মানুষদের, আর সেই সংক্রামিতদের উপসর্গ মারাত্মকও হতে পারে। এই উপসর্গহীন আক্রান্তের সংখ্যা ঠিক কত, তার সঠিক হিসেব করা মুশকিল। এদের হিসেবে ধরলে, করোনায় সুস্থ হবার হার কিন্তু আরও অনেক বেশি। আর, এই উপসর্গহীন-হীন ধরা-না-পড়া করোনা-আক্রান্তদের হিসেবে না ধরলেও এখন যা অবস্থা, পাড়ায় পাড়ায় কোভিড থেকে সেরে ওঠা মানুষ অনেক। ষাটের কম বয়সিদের মধ্যে এই সেরে ওঠার হার তো আরও বেশি। আমার আলোচনার এই ভদ্রলোকের বয়স চারের কোঠায়, তার অস্বস্তির কারণটা তাই আরও বেশি স্পষ্ট।
বরং আমার পরিচিত আর একজন করোনা আক্রান্ত হবার পরে তার পরিবারের লোকজন বা নিকটজনেরা যে বারবার ‘অসুখটা করোনা নয়’ বলে গিয়েছে আমাদের, ভদ্রলোক হাসপাতাল থেকে ছাড়া পারার আগে পর্যন্ত, তার কারণটা বোঝা কঠিন নয়। ‘করোনা’ শুনলেই পরিবারের লোকজন
শুধু নয়, যে নিকটজনের সঙ্গে গত কয়েক সপ্তাহও দেখা হয়নি তার, তারাও নানা ধরনের সামাজিক অস্বস্তির কিংবা প্রতিবন্ধকতার মধ্যে পড়তে পারেন। সরকারি অ্যাম্বুল্যান্স কোনও বাড়ির সামনে এসে রোগীকে নিয়ে গেলে তার পরিবারের লোকজনের যে ক্ষেত্রবিশেষে বেশ খানিকটা হেনস্তার শিকার হতে হচ্ছে, তার নজির আমরা সংবাদ-মাধ্যমে পেয়ে চলেছি নিরন্তর। অবশ্যই সরকারি এবং বেসরকারি
নানা তরফ থেকে প্রচার চলছে গণ-সচেতনতা বাড়াবার উদ্দেশ্যে। তাতে কিছু কাজও নিশ্চয় হয়।
করোনার ছুঁৎমার্গ কিন্তু এখানেই শেষ নয়। দিন কয়েক
আগে একটা খবর পড়লাম কাগজে। গল্পটা এক সরকারি হাসপাতালের কোভিড-ওয়ার্ডে কাজ করা এক নার্সকে নিয়ে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর অনুসারে এই নার্স নিজেই
আক্রান্ত হন কোভিডে। কিন্তু রোগমুক্তির পরে হাসপাতাল থেকে ছুটি পেলে তাঁকে তার বাড়িতে ফিরতে বারণ করেন
যৌথ পরিবারের বিভিন্ন সদস্য। আপাতভাবে অবশ্য
পরিবারের বৃদ্ধদের নিরাপত্তার দোহাই দিয়েই তাঁকে কয়েক
মাস বাড়িতে ফিরতে নিষেধ করা হয়। বাড়িতে ফিরতে সমস্যার কথা জানার পরে তাঁকে নার্সিং হস্টেলে রাখার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু হস্টেলের নার্সদের একাংশের বিক্ষোভে সম্ভব হয়নি তা। এই পরিস্থিতিতে তাঁকে ঠাঁই দিয়েছেন অন্য এক হাসপাতালের আর এক নার্স, যিনি নিজেও অসুস্থ হয়ে ভর্তি ছিলেন এই নার্সটির সঙ্গে একই হাসপাতালে।
এই গল্পটি কিন্তু অমানবিকতার সঙ্গে অজ্ঞানতার মিশেলের এক ভয়াবহ চিত্রণ। কোনও অসুখ থেকে কেউ সেরে ওঠার পরে তার শরীরে সেই অসুখের কোনও জীবাণু অবশ্যই নেই। হাসপাতাল পরীক্ষা করে তাঁকে সেরকম রিপোর্টই তো দিয়েছে। শুধু তাই কিন্তু নয়। সদ্য-রোগমুক্ত হয়তো আরও বেশি নিরাপদ। ভাইরাস-ঘটিত কোনও অসুখে কেউ আক্রান্ত হয়ে সেরে উঠলে তাঁর শরীরে সেই অসুখের অ্যান্টিবডি তৈরি হয়ে যায়, যার ফলে খুব তাড়াতাড়ি তাঁর আর সেই অসুখ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। এটা অবশ্য এক এক অসুখের ক্ষেত্রে এক এক রকমের হয়। যেমন, কারও পক্স হলে চট করে আবার পক্স হওয়ার সম্ভবনা ভীষণ কম, আমরা জানি। কিন্তু সাধারণ সর্দি-কাশি তো ঘনঘনই হয়। করোনার ক্ষেত্রে এই অ্যান্টিবডি ক’দিন শরীরে কার্যক্ষম থাকবে সেটা এই মুহূর্তে স্পষ্ট নয়। এনিয়ে আরও গবেষণা হবে নিশ্চয় আগামী দিনগুলিতে। তবে যে কেউ করোনা থেকে সেরে ওঠার পরে পরেই তার আবার করোনা আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা হয়তো বেশ কম। তার অর্থ হল, তার থেকে অন্যের সংক্রামিত হওয়ার সম্ভাবনাও প্রায় নেই বললেই চলে। বিভিন্ন দেশ যে তাদের জনগণের মধ্যে তথাকথিত ‘হার্ড ইম্যুনিটি’ আনবার জন্য মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছে, সেটাও তো এই একই জিনিস। দেশের জনগণের একটা বড় অংশের মধ্যে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়ে যাওয়া। আজ যখন দেশে করোনা-আক্রান্তের সংখ্যা লাখে লাখে, এবং সুস্থও হয়ে উঠছেন লক্ষ লক্ষ লোক, এই অতি-সাধারণ সাধারণ বিজ্ঞানের অতি-সাধারণ রহস্যটা সাধারণ মানুষের মস্তিষ্কের মধ্যে গেঁথে দেওয়াটা খুবই জরুরি। যার করোনা হয়নি তার সঙ্গে দিনযাপনের চাইতে অনেক বেশি নিরাপদ যে সদ্য করোনা থেকে সেরে উঠেছে তার সঙ্গে সময় কাটানো। মজার কথা হল, আমাদের আলোচনার যে নার্সটিকে তাঁর পরিবারের লোকজন বাড়িতে জায়গা দেননি, তাঁরাই শুধু নয়, নার্সিং হস্টেলের আবাসিকরা, অর্থাৎ নার্সরাও, এই সহজ কথাটা সম্পর্কে হয় ওয়াকিবহল নন অথবা জেনেও বিস্মৃত হয়েছেন। সংবাদপত্রেই বেরিয়েছে যে, সুস্থ হবার পরে কর্মস্থলেও সহকর্মীদের একাংশের আচরণও বিস্মিত হবার মতো। কিন্তু এই সহকর্মীরা তো সবাই স্বাস্থ্যকর্মী! এই শ্রেণীর মানুষজনের আচরণের বহর যদি এরকম হয়, সাধারণ মানুষের ব্যবহার কী পর্যায়ে যেতে পারে তা অনুমান করা কঠিন নয়।
তবে সবাই নিশ্চয় এমন নন। দ্বিতীয় যে নার্স তাঁর নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছেন এই আপাতভাবে স্বজন-বর্জিত নার্সটিকে, মানবিকতার নিদর্শনের সঙ্গে সঙ্গে তিনি কিন্তু ভালোই জানেন যে, সদ্য রোগমুক্তের কাছ থেকে সংক্রমণের নজির নেই। সদ্য-রোগমুক্ত অনেক বেশি নিরাপদ। তিনি নিজেও নিরাপদ। নিরাপদ অন্যদের জন্যও। এনিয়ে সামাজিক সচেতনতা বাড়াবার প্রয়াস চলছে নিশ্চয়। বেলেঘাটা আইডি হাসপাতালেই যেমন চালু হয়েছে ‘পোস্ট করোনা ক্লিনিক’। এ ধরনের ক্লিনিক কিন্তু আজ প্রয়োজন পাড়ায় পাড়ায়, মহল্লায় মহল্লায়। সমাজের অহেতুক ভয় কাটাতে। অজ্ঞানতার ভয়ঙ্কর যে মানসিক রোগ শিকড় গেড়ে রয়েছে আমাদের সমাজে, তা থেকে মুক্তির প্রয়োজনে। করোনা দিনের ছোঁয়াছুঁয়ি খেলাকে যুক্তি এবং বিজ্ঞানের আলোকধারায় ধুইয়ে দিতে।