কর্মে শুভ। নতুন কর্মপ্রাপ্তি বা কর্মসূত্রে দূররাজ্য বা বিদেশ গমন হতে পারে। আনন্দানুষ্ঠানে যোগদান ও ... বিশদ
১৩ জুলাই এটা যখন লিখছি তখন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষয়ক্ষতির ছবিটা এইরকম: মোট আক্রান্ত ৩৩ লক্ষ ৭০ হাজার। একদিনে যোগ হয়েছে ৬০,৭১৯। মৃত
১ লক্ষ ৩৭ হাজার। একদিনে যোগ হয়েছে ৪৮২।
শুধু টেক্সাসে আক্রান্ত ২ লক্ষ ৫৯ হাজার। একদিনে যোগ হয়েছে ৮,১৯৬। মৃতের সংখ্যা ৩,২০৭। একদিনে যোগ হয়েছে ৮০।
এসব কোনও গোপন তথ্য নয়। বরং পৃথিবীজুড়ে প্রত্যেকে প্রত্যেককে সতর্ক করছেন—‘করোনা হইতে সাবধান’! তার পরেও নিজেদের মৃত্যুর এমন বিলাসী আয়োজন। মানুষ, বিশেষ করে কিছু উচ্ছৃঙ্খল হঠকারী মানুষ, ছাড়া আর কার পক্ষে সম্ভব?
টেক্সাসের নামকরা মেথডিস্ট হাসপাতালের চিফ মেডিকেল অফিসার জেন অ্যাপেলবি সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছেন, ওই ঘটনায় বছর তিরিশের এক যুবক মারা গেছেন। একটা কোভিড-১৯ পার্টিতে তিনি দেদার মজা করেছিলেন। তাঁর ধারণা ছিল যে, করোনা আসলে একটা ‘হোক্স’! এই ধরনের মানুষকে ঈশ্বরের ঈশ্বর বলে যদি কেউ থাকেন, তাঁর পক্ষেও বাঁচানো অসাধ্য নয় কি? হাসপাতালে মৃত্যুশয্যায় যুবকটি করুণ মুখে তাঁর নার্সের কাছে দুঃখ করেছিলেন, ‘আমি একটা ক্ষমাহীন ভুল করে ফেলেছি—তাই না?’ যুবকটির দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, করোনায় অল্পবয়সিদের কোনও ভয় নেই। যুবারা অজেয়।
টেক্সাসের চিকিৎসক সমাজ এই ঘটনাকে সামনে রেখে ফের সতর্ক করে দিচ্ছেন, করোনার সামনে কেউই নিরাপদ নন। সবাইকে সমান সতর্কতা নিয়ে চলতে হবে। বিপদ কিন্তু পায়ে পায়ে। অ্যাপেলবির বক্তব্য, কম বয়সি রোগীদের দেখে বোঝা যায় না তাঁরা ভিতরে ভিতরে কতটা রুগ্ন। অক্সিজেন লেভেল এবং আনুষঙ্গিক ল্যাব টেস্ট রিপোর্টেই ধরা পড়ে করুণ বাস্তবটা। টেক্সাস অবশ্য প্রথম নয়। পায়োনিয়ার হল কেন্টাকি। তারা খবরের শিরোনামে এসেছিল ২৫ মার্চ। ৬ মে প্রকাশিত সিয়াটেল টাইমস-এর রিপোর্টে তো ভিরমি খেতে হয়: কিছু মানুষ সংক্রমণের শিকার হওয়ার জন্যই এমন পার্টির আয়োজন করছে! অতীতে এইভাবে নাকি চিকেন পক্স পার্টিও হতো।
খবরে প্রকাশ ২: অবশেষে মাস্ক পরলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ১১ জুলাই। একটা উল্লেখযোগ্য দিন। ন্যাশনাল মিলিটারি হাসপাতাল পরিদর্শনে গিয়েছিলেন মাস্ক পরে। খবর, ছবি প্রকশ্যে আসতেই নেটিজেনরা বাঁকা হাসি দিতে শুরু করেছেন, রঙিন ট্যুইটে ছয়লাপ। নমুনা—(১) যাক, পরিস্থিতির ভয়াবহতাটা অবশেষে ট্রাম্প সাহেবের মগজে ঢুকুছে। (২) মাস্ক পরে মানুষের সামনে আসতে বড্ড দেরি করে ফেললেন যে মহামানব! (৩) ক্লাউনটা ফাইনালি মাস্ক পরলেন তবে! (৪) বুদ্ধিমান গোড়াতেই করে, আর বোকা করে সবার শেষে। (৫) এক লক্ষ তিরিশ হাজার (অর্থাৎ ওইদিন পর্যন্ত আমেরিকায় করোনায় মৃতরা) বলেছন যে, সামান্য দেরি হয়ে গেছে। (৬) মাথাটা ঢেকে যাওয়া উচিত ছিল মিস্টার প্রেসিডেন্টের। সেনাদের সুরক্ষা নষ্ট করার জন্য তাঁকে ধিক্কার জানাই। (৭) প্রেসিডেন্টের মতো ব্যক্তিত্ব মেডিক্যাল প্রোটোকল মানছেন তবে! তাজ্জব ব্যাপার! বিরাট খবর।
যুক্তরাষ্ট্রের যুব শ্রেণীর একটা অংশ মেডিক্যাল প্রোটোকল বেপরোয়াভাবে অমান্য করছেন। এর পিছনে ‘ট্রাম্পদর্শন’-এর কিছুমাত্র অবদান কি নেই? আমেরিকাবাসী মাথা চুলকোচ্ছেন নিশ্চয়।
খবরে প্রকাশ ৩: ডাক্তার লোরনা এম ব্রিন (৪৯)। ইমারজেন্সি বিভাগের ডিরেক্টর ছিলেন ম্যানহাটানের একটা নামী হাসপাতালে। যেটা করোনা ভাইরাস রোগীতে ভরা। ডা. ব্রিন অনেক রোগীর চিকিৎসা করেছেন নিজের হাতে। তিনিই আত্মঘাতী হলেন আচমকা! ২৬ এপ্রিল। পৈতৃক বাড়িতে। তাঁর শোকসন্তপ্ত বাবা ড. ফিলিপ সি ব্রিন সংবাদ মাধ্যমের কাছে খেদ জানালেন, ‘মেয়েটি আমার সবার সেবা করার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু সেই কাজই তাকে মেরে ফেলল।’
নিউ ইয়র্ক ততদিনে করোনার এপিসেন্টার। হাসপাতালে কী বীভৎস দৃশ্যের মধ্যে লোরনাকে কাজ করতে হতো, পুলিসকে জানিয়েছেন ড. ফিলিপ। এত রোগীর ভিড় যে সবার জায়গা দেওয়া মুশকিল হচ্ছিল। পার্কিংলটেও বেড সাজাতে হয়েছিল। করোনায় মৃত্যু লেগেই ছিল। অসুস্থ হচ্ছিলেন সহকর্মীদের একাংশ। লোরনাও কোভিড-১৯ আক্রান্ত হন। সুস্থ হয়ে দিন দশেক ডিউটিও করেন। তার মধ্যেই এই মর্মান্তিক ঘটনা। পরিবার চায়, মানুষ লোরনাকে বীরাঙ্গনা হিসেবেই মনে রাখুন। কারণ, লড়াইতে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন একেবারে সামনে থেকে।
ডা. ব্রিনের আত্মহত্যার কারণ সরকারিভাবে স্পষ্ট করেনি কেউ। তবে, পুলিস এবং ডাক্তারদের একাংশের অনুমান, তিনি ভীষণ অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। যদিও তাঁর মানসিক সমস্যার কোনও অতীত নেই। অন্তত পরিবারের দাবি সেরকমই। সহকর্মীদের সুরক্ষার ব্যাপারেও সদাসতর্ক থাকতেন ডা. ব্রিন। সবাই ঠিকঠাক পিপিই ব্যবহার করছেন কি না খেয়াল রাখতেন। সহকর্মীদের টেক্সট করে সতর্ক করতেন। সেই তিনিই মৃত্যুকে বেছে নিলেন, ‘হার্ডেস্ট টাইম অফ মাই লাইফ’-এর সঙ্গে যুঝতে না পেরে। শেষ আক্ষেপ রেখে গিয়েছেন ডা. ব্রিন, ‘কাউকে সাহায্য করতে পারিনি। মানুষকে সাহায্য করতেই চেয়েছিলাম। কিন্তু আমি কিছুই পারিনি।’
৬ জুন দ্য গার্ডিয়ান-এ প্রকাশিত তথ্য অনুসারে, যুক্তরাষ্ট্র ওই সময় পর্যন্ত প্রায় ছ’শো ফ্রন্ট লাইন হেলথকেয়ার ওয়ার্কারকে হারিয়েছেন। এই করোনা-যোদ্ধাদের মধ্যে রয়েছেন ডাক্তার, নার্স, প্যারামেডিকস এবং অন্য স্বাস্থ্য সহায়করা। এই ক্ষতি বন্ধ হয়নি। তার মধ্যে ডা. লোরনা ব্রিনের চলে যাওয়ার ঘটনাটা সবচেয়ে মর্মান্তিক। আমেরিকা তো বটেই সারা পৃথিবীর মানুষকে কষ্ট দিয়েছে। ফলো আপ স্টোরি এখনও যেভাবে হচ্ছে, তাতেই বোঝা যায়, ডা. ব্রিনের সামাজিক গুরুত্ব এখনও কতটা। বিস্মিত হতে হয় যে, এর পরেও ডা. ব্রিনের দেশের কেউ কেউ কোভিড-১৯ পার্টি করতে পারে! তাদের মহামান্য প্রেসিডেন্ট প্রথমবার মাস্ক পরেছেন এই ১১ জুলাই। দেশটাকে বস্তুত খাদের কিনারে দাঁড় করিয়ে দেওয়ার পর।
ভারতের একটা প্রান্তিক রাজ্যে বসে এতটা আমেরিকা চর্চার কী মানে! এই প্রশ্ন, এই বিস্ময় জাগা অস্বাভাবিক নয়। সমস্যা হল, আমরা ভারতীয়রা বিদেশিদের ফলো করেই সুখী অনুভব করি। আগে গুরুঠাকুর ছিল ইংরেজের কালচার। এখন আমেরিকান। কলকাতাসহ বাংলার যত্রতত্র অল্প বয়সি ছেলেমেয়েদের অসুরক্ষিত অকুতোভয় আড্ডা বেড়ে চলেছে। সকাল সন্ধ্যে ভেদ নেই। ভয় হয়, তারা কি ট্রাম্প-দর্শনে মজেছে!
খবরে প্রকাশ ৪: জুলাই ৮। করোনা পজিটিভ একজন কোয়ারেন্টাইন সেন্টার থেকে পালিয়েছিল। এতে ঘুম ছুটে গেছিল নিউজিল্যান্ড প্রশাসনের। বছর বত্রিশের ওই কীর্তিমান দিল্লি থেকে অকল্যান্ডে গেছে কনস্ট্রাকশনের কাজে। তার হঠাৎ খেয়াল হল সুপার মার্কেটে কেনাকাটা করবে! আর তাই না বলে-কয়ে মিনিট কুড়ি মার্কেটে কাটিয়ে, সওয়া এক ঘণ্টা বাদে যথাস্থানে ফিরে এল। সে বোধহয় মনে রাখেনি, সব মোদির বা ট্রাম্পের দেশ নয়। করোনা মোকাবিলাকে হাতে গোনা যে ক’টা দেশ সিরিয়াসলি নিয়েছে নিউজিল্যান্ড তার একটা। স্বাস্থ্যমন্ত্রী ক্রিস হিপকিনস বলেছেন, ‘এই স্বার্থপরটার সাজা হবে।’ শোনা যাচ্ছে শাস্তির বহরটা এইরকম: ছ’মাস পর্যন্ত জেল অথবা চার হাজার ডলার ফাইন। বজ্র আঁটুনি বেশিরভাগ সময়েই ফসকা গেরো হয়ে যায়। নিউজিল্যান্ডকে ওই দলে ফেলার আগে ক’টা সংখ্যায় চোখ বুলিয়ে নিন: ১৩ জুলাই পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত ১,৫৪৪। সুস্থ ১,৪৯৭। মৃত ২২। এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে অ্যাকটিভ কেস ক্রমশ কমছে। এখন প্রায় নেই। একদিনে সর্বাধিক চারজনের মৃত্যু দেখেছে এপ্রিলের মাঝামাঝি। ২ জুনের পর কারও মৃত্যু হয়নি।
ভাবুন, কোন মডেল নেবেন।