কর্মপ্রার্থীরা বেশ কিছু সুযোগের সংবাদে আনন্দিত হবেন। বিদ্যার্থীরা পরিশ্রমের সুফল নিশ্চয় পাবে। ভুল সিদ্ধান্ত থেকে ... বিশদ
ইস্টার্ন সেক্টরে চীন বলেছিল যে, তারা ‘প্রস্তুত হচ্ছিল বর্তমান অবস্থান থেকে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখার উত্তর দিকে, মানে অবৈধ ম্যাকমোহন লাইনের উত্তরে সরে যাওয়ার জন্য এবং ওই রেখা থেকে আরও ২০ কিলোমিটার পিছিয়ে যাওয়ার জন্য।’ একতরফাভাবে সরে যাওয়ার পর যে অবস্থান চীন নিয়েছিল, ইস্টার্ন সেক্টরে বেআইনি জবরদখল মোটামুটিভাবে যতটা খালি করে দিয়েছিল, ১৯৬২ থেকে সেটাই তারা বজায় রেখেছে।
১৯৬২-র যুদ্ধে ভারত হেরেছিল। আর সেই বৈরীভাব রয়ে গেছে। চীন একটা নিয়ন্ত্রণ রেখা টেনেছিল। কিন্তু সেটাকে দু’তরফ ভিন্নভাবে ভেবে নিয়েছিল। ১৯৯৩। নিয়ন্ত্রণ রেখা (এলওসি) বা যেটাই তাকে ভাবা হোক না কেন, সেটাকেই প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা (এলএসি) হিসেবে মেনে নেওয়া হল। কিন্তু এলএসি সম্পর্কেও দু’পক্ষের মনোভাব বদলায়নি। এটা সম্পর্কেও দু’পারের উপলবব্ধি আলাদা। এই প্রসঙ্গে একটা উল্লেখযোগ্য দিকের কথা বলতে হয়: ১৯৭৫ সাল থেকে ভারত-চীন সীমান্তে কোনও গোলাগুলি চলেনি এবং ওই ধরনের ঘটনায় কোনও প্রাণ যায়নি। ৪৫০৬ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্তে টানা ৪৫ বছর যাবৎ একটা সূক্ষ্ম শান্তি বজায় ছিল। ওই অ্যাচিভমেন্টটা এবার নস্যাৎ হয়ে গেল। শান্তি নষ্ট হল চীনের দ্বারা। ২০ জন সেনা নিহত হলেন। নজরদারির দায়িত্বে যখন নরেন্দ্র মোদি।
চীন ছিল প্রথম আক্রমণকারী
এই সময় জুড়ে, এমনকী চীন যখন এলএসি মেনে নিল (যদিও দু’পক্ষের উপলব্ধি আলাদা) তখনও কিন্তু লাদাখের গলওয়ান উপত্যকা তারা দাবি করেনি। ১৯৬৩-র ১ জানুয়ারি জওহরলাল নেহরু একটা চিঠি লিখেছিলেন চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাইকে। পরিস্থিতির বাস্তবটা ওতেই ধরা রয়েছে।
‘৩. বিগত সাত-আট বছরে বিভিন্ন উপলক্ষে আমি ব্যক্তিগতভাবে লাদাখের নানা অংশে গেছি। আমার আগের ভিজিটগুলোতে চীনা বাহিনীর চিহ্নমাত্র ছিল না। এমন কোনও রিপোর্টও ছিল না যাতে করে বোঝা যায় যে চীনারা লাদাখে আসে। পরবর্তী উপলক্ষগুলোতে রিপোর্ট পাওয়া যেতে লাগল যে চীনারা লাদাখের নানা জায়গায় ঢুকছে ... ব্যক্তিগতভাবে যতটুকু জেনেছি তার ভিত্তিতে এই ব্যাপারে কিছুটা আমি বলতে পারি। পূর্ব লাদাখের বৃহত্তর অংশে চীনাদের জবরদখল, যা নিজে চাক্ষুষ করিনি, সেই ব্যাপারে আপনি প্রত্যাশা করবেন না যে আমি ভাসা ভাসা কিছু অভিযোগ মেনে নিয়েছি ...
‘৮. ... ভারত স্বাধীন হওয়ার পর থেকে, ১৯৬২-র ৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চীনারা কখনওই ইস্টার্ন সেক্টর বা পূর্ব সীমান্ত পেরয়নি। একমাত্র ব্যতিক্রম লংজু ...’
মোদিজির নজরদারিতে
চৌ-কে লেখা চিঠিতে নেহরুর কোনও কথা মোলায়েম ছিল না। দ্ব্যর্থহীনভাবেই তিনি চীনকে ‘অ্যাগ্রেসর’—অর্থাৎ, প্রথম আক্রমণকারী বলেছিলেন। এটা ছিল যুদ্ধে ভারতের পরাজয় এবং চীনের তরফে ভিক্টরস জাস্টিস (পরাজিত শত্রুপক্ষের প্রতি অবিচার) বলবৎ করার চেষ্টা পরবর্তী ঘটনা।
এই সেই গলওয়ান উপত্যকা, তখন থেকে যার উপরে চীন কখনও সার্বভৌমত্ব দাবি করেনি। এবং, গত মার্চ-এপ্রিলে যে প্যানগং হ্রদ ও হট স্প্রিং এলাকায় তারা বেআইনিভাবে ঢুকেছিল, তার উপেরও না। বেআইনি প্রবেশ লক্ষ করে ভারতীয় বাহিনী ৫ মে চীনা বাহিনীকে চ্যালেঞ্জ জানায়। ১৫-১৬ জুনে গিয়ে রেষারেষিটা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ পর্যন্ত গড়ায়। এটাও ঘটেছিল নরেন্দ্র মোদির নজরদারিতে।
তবু, অজ্ঞাত কারণে, প্রধানমন্ত্রী প্রথম আক্রমণকারী হিসেবে চীনের নামটা নেবেন না। এই নজিরবিহীন অস্পষ্টতা নিয়ে বিদেশ মন্ত্রক কি আদৌ খুশি? প্রধানমন্ত্রীর এই যে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বাক্সংযম, কর্মরত সেনাকর্তারা এবং যে-সমস্ত সেনা জওয়ান যুদ্ধ করছেন, তাঁরাও কি এতে খুশি?
পূর্বস্থিতির পুনরুদ্ধার
মাঝে গেছে মাত্র কয়েকটা মাস। নাটকীয়ভাবে পাল্টে গেছে দুটো প্রতিবেশী দেশের মধ্যেকার সম্পর্ক। উহান সম্মেলন হয়েছিল ২০১৮-র ২৮ এপ্রিল। যৌথ বিবৃতিতে সীমান্ত বিষয়ে একটামাত্র প্যারাগ্রাফ ছিল। যা সীমিত ছিল ‘শান্তি ও সুস্থিতি রক্ষিত হচ্ছে’, ‘আস্থা গড়ার ব্যবস্থা’ প্রভৃতি কয়েকটা গতানুগতিক প্রবাদে। মহাবলীপুরম সম্মেলন হয়েছিল ২০১৯-এর ১২ অক্টোবর। সেখান থেকে ১৭ প্যারাগ্রাফের একটি বিবৃতি প্রকাশ করা হয়েছিল। সীমান্ত বিষয়টাকে তাতে নামিয়ে আনা হয়েছিল ১৬ নম্বরে! অন্যদিকে, দুই নেতার সিদ্ধান্ত ছিল যে ‘২০২০ সালটাকে ভারত-চীন সংস্কৃতি এবং মানুষে মানুষে ভাব বিনিময়ের বর্ষ হিসেবে চিহ্নিত করা হবে’। আইডিয়াটা স্মরণীয় হবে ভেবে মোদিজি নিশ্চয় আহ্লাদিতই হয়েছিলেন!
সাম্প্রতিককালের মধ্যে ২০১৯-এর ২১ ডিসেম্বরের কথা মনে করা যায়। স্পেশাল রিপ্রেজেন্টেটিভদের ২২তম মিটিংয়ের পর যে বিবৃতি প্রকাশ করা হয়েছিল, তাতেও ছিল গতানুগতিক প্রবাদগুলোর পুনরাবৃত্তি। এটা এখন পরিষ্কার হচ্ছে যে পিপলস লিবারেশন আর্মি (পিএলএ) বা চীনের লাল ফৌজ তিনমাস পরে পরদেশ আক্রমণের পাকাপোক্ত প্ল্যান নিয়েই নেমেছিল। ভারতের অর্থনীতির দ্রুত পতন ঘটছিল। ভারতের এই দুর্বল দিকটা মিস্টার জি সম্ভবত নিখুঁতভাবে ধরতে পেরেছিলেন বলে মনে হয়। অন্যদিকে মনে হয় যে মিস্টার জি-র মতলব টের পেতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছিলেন মোদিজি। এই ‘ফল আউট’ ভারতের জন্য এক বিরাট কূটনৈতিক বিপর্যয়, একটা ‘মিলিটারি সেট ব্যাক’ (অন্তত সাময়িক) এবং ১৯৯৩ থেকে চীন-ভারত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে ভারতের যাবতীয় লাভ ধুয়েমুছে যাওয়া। এর থেকে শিক্ষাটা হল—ডিপ্লোম্যাসি বা কূটনীতির ব্যাপারটা ডিপ্লোম্যাট বা কূটনীতিকদের উপর ছেড়ে দিন। তাঁরা ভারিক্কিভাবের এবং ধীরগতির হতে পারেন, কিন্তু ‘সিগন্যাল’ বা ইঙ্গিত কিছু থাকলে তাঁরা ঠিক ধরে ফেলবেন। নবিশ লোকরা তা ধরতেই পারবেন না।
৫ জুলাই জাতীয় নিরাপত্তা এজেন্সিগুলোর (এনএসএ) মধ্যে আলোচনার পর দু’তরফই বলেছিল যে, সেনা সরানো এবং উত্তেজনা কমানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। আমি স্বাগত জানিয়েছিলাম। সরকারের ঘোষিত লক্ষ্য '২০২০ সালের ৫ মে তারিখের status quo ante বা পূর্বস্থিতি’তে পৌঁছনো। কিন্তু তার আগে কিছু সমস্যা রয়েছে। সমাধানের প্রশ্নে সরকার কী করছে (প্রসেস) এবং কতটা এগচ্ছে (প্রগ্রেস), সেটার উপর দেশবাসী ঠিক নজর রাখছেন। মোদি সরকারের কাছে এর জবাব তাঁরা চাইবেন।
‘২০২০ হল ভারত-চীন বর্ষ ...’—ব্যাপারটা শুরু হওয়ার আগেই, মাঝপথে একটা লজ্জাজনক পরিণতির সাক্ষী আমরা।