কর্মপ্রার্থীরা বেশ কিছু সুযোগের সংবাদে আনন্দিত হবেন। বিদ্যার্থীরা পরিশ্রমের সুফল নিশ্চয় পাবে। ভুল সিদ্ধান্ত থেকে ... বিশদ
আমাদের দেশে মানবদেহে ভ্যাকসিনের পরীক্ষামূলক প্রয়োগ সবে শুরু হয়েছে। কাদের কাদের উপর প্রতিষেধক প্রয়োগ করা হবে, সেই তালিকা চূড়ান্ত করেই অতি সাবধানে এগচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। গোটাটা এক দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। অনেকবার এই পরীক্ষা করতে হয়। যাচাই করতে হয় পরীক্ষার ফল। তাতে সাফল্য কতদূর মেলে, হিতে বিপরীত হয় কি না, তার ওপরই নির্ভর করছে করোনা টিকার ভবিষ্যৎ। তবে বাণিজ্যিক প্রয়োগ শুরু হতে বছর ঘুরে যেতে পারে। সারা পৃথিবীতে একসঙ্গে দেড়শো এমন ভ্যাকসিন নিয়ে চূড়ান্ত কাজ চলছে। নিরলস পরিশ্রম করে চলেছেন গবেষকরা। আমাদের দেশে মূল পর্বে রয়েছে মাত্র দু’টি প্রতিষেধক। সরকারি সাহায্যে চলা এই সব প্রকল্পে সাফল্য এলেই জয় জয়কার শুরু হবে নেতাদের, ভোটযন্ত্রে উপচে পড়বে জনসমর্থন। বিরোধীরা বছরখানেক টুঁ শব্দটি করার সাহসটুকু পাবে না। কিন্তু ব্রাত্যই থেকে যাবেন অক্লান্ত গবেষকরা। নিরলস যোদ্ধারা। ঠিক যেমন গলওয়ানের ২০ জন বীর শহিদের পরিবারের অবস্থাটা এই মুহূর্তে কেমন, আমরা কেউ জানি না। খোঁজ নেওয়ার সময়ই নেই ব্যস্ত মিডিয়ার!
আবার এর উল্টোদিকে মানবদেহে প্রয়োগ করামাত্র প্রতিষেধকের ‘সাইড এফেক্টে’ কারও প্রাণ সংশয় হলে কিন্তু বিজ্ঞানীরাই তীব্র সমালোচনার শিকার হবেন। বাতিল হয়ে যাবে সেই প্রতিষেধক। আসলে এদেশে সবকাজে ব্যর্থতার দায় সংশ্লিষ্ট পেশাদারদের ঘাড়ে চাপানোই রীতি। কিন্তু সাফল্য এলে তার ষোলো আনা কৃতিত্ব রাজনীতির কারবারিদের। এদেশে এটা দিনের আলোর মতোই প্রতিষ্ঠিত সত্য। স্বাধীনতার ৭৩ বছর পর আদতে ছোট বড় হরেক কিসিমের নেতার নাগপাশে ভারতের অন্তরাত্মা এখানেই বাঁধা। সেই কারণেই লালকেল্লায় আসন্ন স্বাধীনতা দিবসে প্রধানমন্ত্রীর রাষ্ট্রীয় ভাষণের মাহেন্দ্রক্ষণের সঙ্গে ভ্যাকসিন আবষ্কারকে মেলাবার মরিয়া প্রয়াস। প্রচারের সবটুকু আলো শুষে নিতে রাজনীতির কারবারিদের কোনও কার্পণ্য নেই। পরে অবশ্য চাপে পড়ে সরকারি তরফে ঢোক গেলার চেষ্টাও চলল প্রাণপণে। কিন্তু দল ও সরকার উভয়কেই বুঝতে হবে, যাঁরা একাজ করেছেন তাঁরা মোদিজির ভালো করতে গিয়ে ক্ষতিই করেছেন বেশি। তাঁদের চূড়ান্ত ধিক্কারই প্রাপ্য। সবকিছুকে রাজনীতির ক্যালেন্ডারে বাঁধা যায় না। নির্ভেজাল এই সত্যটাকে যদি শাসক ও তার বশংবদ অনুগামীরা আজও বুঝতে না পারেন, তাহলে দেশবাসীর জন্য আরও বড় দুর্ভোগ অপেক্ষা করছে। কে না জানে, গবেষণায় যেমন যুগান্তকারী আবিষ্কার বেরিয়ে আসতে পারে, তেমনি তীরে এসে তরী ডোবার মতো ঘটনাও এই কাঁটা বিছনো পথের নিত্যসঙ্গী। ইতিহাস ঘাঁটলে এমন উদাহরণ ভূরি ভূরি পড়ে আছে। তবু সব জেনেও যুগে যুগে হীরক রাজারা অসহায় বিজ্ঞানীদের চাপ দিয়ে নিজেদের পছন্দমতো সময়ে ‘মস্তিষ্ক প্রক্ষালন যন্ত্র’ তৈরির ব্যর্থ সার্কাস চালিয়ে যান। আধুনিক ডিজিটাল দুনিয়ায় এসেও সেই সস্তা নাটকের বিরাম নেই। রাজা শত সহস্র স্বর্ণ মুদ্রা খরচ করছেন যে, হোক না তা জনগণের করের টাকা!
সবাই জানে এবং অবশ্যই মানে যে চলতি ভাইরাসকে হারানোর বিশ্বযুদ্ধটা আর পাঁচটা লড়াইয়ের চেয়ে অনেক কঠিন। গত চার পাঁচ মাসেই দুনিয়ার তাবৎ শক্তিশালী নেতানেত্রীকে এই অজানা রোগের ভয়ঙ্কর অভিঘাত পুরোদস্তুর হেলিয়ে দিয়েছে। এমনকী মার্কিন মুলুকে ধুরন্ধর ট্রাম্পের গদিও নাকি টলমল শোনা যাচ্ছে। বিশ্বজুড়ে অর্থনীতি চৌপাট। কাজ নেই, ব্যবসা নেই, বিধ্বস্ত মনের শেষ স্বপ্নটুকুকে কোনওক্রমে বাঁচিয়ে রাখতে হিমসিম খাচ্ছে সবাই। হঠাৎই আমরা যেন দিক হারিয়ে আজ নেই রাজ্যের বাসিন্দা। কোনওরকমে প্রাণটুকু নিয়ে ভেসে থাকতেই ব্যস্ত। প্রত্যেকে একটা কথা বিলক্ষণ বুঝে গিয়েছেন, ভ্যাকসিন ছাড়া পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে না। কিন্তু তা বলে কাল চাই, পরশু চাই বলে ছুটে বেড়ালেও তো সমাধান হবে না। এ তো ছেলের হাতের মোয়া নয়। শিশুর খেলনাও নয়। সময় তো দিতেই হবে বিজ্ঞানীদের। রাজনৈতিক লাভ লোকসান ভুলে গিয়ে পর্যাপ্ত সময়। সবে মানবদেহে প্রয়োগ শুরুর ছাড়পত্র মিলেছে। অন্তত নভেম্বর ডিসেম্বর পর্যন্ত তো অপেক্ষা করতেই হবে।
আর সে কথা মনে রেখেই টিকা বেরনোর আগে পর্যন্ত ভার্চুয়াল দুনিয়াতেই সিংহভাগ কাজ চালাতে হবে সবাইকে। মোদির লালকেল্লার বক্তৃতা থেকে মমতার ২১ জুলাইয়ের সমাবেশ সবই আপাতত অনলাইনে। এটাই সময়ের দাবি। কিন্তু গাড়িঘোড়া, পর্যটন, যাবতীয় ভোগ্যপণ্যের ব্যবসা কীভাবে চলবে? ঘরে থেকেই অফিস। এত জামা জুতোর কী হবে? পার্টি না হলে মহার্ঘ স্যুট, দামি বেলোয়ারি চুরি, হিরের নেকলেসের প্রয়োজনও ফুরতে বাধ্য। এমনকী আসন্ন পুজোয় মুখে মাস্ক এঁটে মাথায় ক্যাপ লাগিয়ে যেখানে ঠাকুর দেখতে যাওয়ারই নেই, সেখানে কেনাকাটা জমবে কোন ভরসায়? ভয় আতঙ্ক কাটিয়ে মানুষ একে অপরের সঙ্গে মিশতে না পারলে যতই চেষ্টা করুন, ব্যবসা বাণিজ্য বাড়া কঠিন।
কিন্তু তা বলে ভাইরাসের ওপর তো সার্জিকাল স্ট্রাইক চলে না! আর যাই হোক, বিজ্ঞানীরা তো আর ব্রজেশ মিশ্র, অজিত দোভাল নন। ডোকা লা’য় ভারত-চীন সংঘাত চলেছিল ৭৩ দিন। তার চেয়েও ১৩ দিন কম সময়ে সাময়িক মিটল লাদাখের গলওয়ান সঙ্কট। ৬০ দিনের মাথায়। অন্তত তেমনটাই সেনার দাবি। আর লকডাউনের প্রথম দিন থেকে আজ ১১২ দিন পার করেও এই মহামারীকে কাবু করার সামান্যতম ইঙ্গিত মেলার লক্ষণ নেই। বরং যুদ্ধ ক্রমেই আরও তীব্র হচ্ছে, ব্যাপক হচ্ছে। প্রতিদিন আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা লাফিয়ে বাড়ছে। আমাদের মতো বিপুল জনঘনত্বের গরিব দেশে মানুষ একবার রাস্তায় বেরলে গায়ে গায়ে ঠেসাঠেসি অনিবার্য। পেট বড় দায়। লোক বেরবেই। তাই মাস্ক, স্যানিটাইজারের ব্যবহার বাড়িয়েও ‘ড্রপলেট’ ছড়ানো বন্ধ করা অসম্ভব। বিক্রিবাটা বেড়ে যেটুকু আলোর ছটা জুলাইতে দেখা যাচ্ছে, সবাইকে ঘরবন্দি করে দিলে সেটা আবার বেমালুম নিভে যাবে। ফলে উভয়সঙ্কট। প্রায় দু’-আড়াই মাস স্তব্ধ হয়ে থাকায় অর্থনীতি সবে একটু ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। তবে ভ্যাকসিন না বেরনো পর্যন্ত এই বিশ্বজোড়া মহামারীর হাত থেকে মুক্তি পাওয়া কঠিন। গত ২৪ মার্চ মোদিজি প্রথম লকডাউন ঘোষণা করেছিলেন ২১ দিনের। তখনই মহাভারতের যুদ্ধের অবতারণা করেছিলেন তিনি। ভাবটা ছিল এমন যেন, মহাভারতের যুদ্ধ মিটেছে ১৮ দিনে, আর ২১ দিনেই করোনার হেস্তনেস্ত হয়ে যাবে! হয়নি। পাকিস্তান ও চীনের সঙ্গে সীমান্ত ‘যুদ্ধ’ আর বিশ্ব কাঁপানো প্যানডেমিকের সঙ্গে শেষ পর্যন্ত সমানে সমানে লড়ে যাওয়া এক নয়। জুনে আনলক পর্ব শুরুর পরও প্রায় দেড় মাস কাটতে চলেছে। কিন্তু মানুষ এখনও স্বস্তি পায়নি। আর এখন বলা হচ্ছে, যদি আগামী ফেব্রুয়ারি-মার্চেও ভ্যাকসিন না আসে তাহলে দেশে দৈনিক সংক্রমণ তিন লাখ ছুঁয়ে ফেলবে। অর্থাৎ ভ্যাকসিন বেরনোর আগেই আমাদের দেশের সিংহভাগ অংশ আক্রান্ত তো হবেই, সেইসঙ্গে সুস্থ হয়ে অ্যান্টিবডিরও বাহক হবে। আপাতত আশার আলো দেখাচ্ছে ওই অ্যান্টিবডিই। এছাড়া, সুস্থদের রক্তের প্লাজমা ব্যাঙ্ক। কিন্তু সব ছাপিয়ে আসল প্রশ্ন হচ্ছে, কবে আসছে ভ্যাকসিন? তার ওপরই নির্ভর করছে করোনা যুদ্ধের অন্তিম পরিণতি। শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধের পর শহিদ বীর জওয়ানের দেহ ফেরে। বাড়িতে কান্নার রোল ওঠে। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সৎকার হয়। তারপর একদিন আমরা সবাই ভুলে যাই। বীর জওয়ানদের আত্মবলিদানের ভিতের ওপর তৈরি হয় নেতাদের জনপ্রিয় কেরিয়ার। করোনাকে হারাতে ভ্যাকসিন আবষ্কারের যুদ্ধেও কত শত বিজ্ঞানী রাতদিন এক করে নিরলস প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন। ভ্যাকসিন বেরিয়ে যুদ্ধ থামলে তাঁদের কথা আমাদের মনে থাকবে তো?