পঠন-পাঠনে আগ্রহ বাড়লেও মন চঞ্চল থাকবে। কোনও হিতৈষী দ্বারা উপকৃত হবার সম্ভাবনা। ব্যবসায় যুক্ত হলে ... বিশদ
তাহলে কি চীনকে বাণিজ্যিকভাবে শিক্ষা দেওয়া হবে না? চীনের এই ডাম্পিং বিজনেসকে মেনে নিতে হবে? ভারত আত্মনির্ভর হবে না? নিশ্চয়ই হবে? চীনকে অবশ্যই বাণিজ্যিকভাবে কোণঠাসা করতে হবে। কিন্তু সেটা এরকম স্থূল ভাবে হয় না । হঠাৎ কোনও একটি বুধবার সিদ্ধান্ত নিলাম যেহেতু লাদাখে চীন বাড়াবাড়ি করছে, তাই চীনের জিনিস কিনব না, এরকম হয় না। ওটা ম্যাচিওরিটি নয়। অপরিণতমনস্ক মেন্টালিটি নিলে দীর্ঘমেয়াদি সাফল্য আসে না। কারণ, বয়কট করার আগে তো আমাদের দেখতে হবে যে বিকল্প কী! বিকল্প হয়ে গেলেই চীনকে আর দরকারই হবে না। কিন্তু এই বিপুল সাপ্লাই চেইনের বিকল্প তো সেভাবে এখনও তৈরি হয়নি। প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে। সেই প্রয়াসকে সফল করতে গোটা দেশ একজোট হবে। কিন্তু যে কোনও ভারতীয় ট্রেড অর্গানাইজেশন অথবা ম্যানুফাকচারিং অ্যাসোসিয়েশনকে প্রশ্ন করলে বলবে, বিকল্প ভারতের সংস্থাই মেটাবে, সেখানে পৌঁছতে অন্তত ৫ থেকে ১০ বছর লাগবে। যদি এখনই সত্যিই কাজ শুরু করা যায়।
চীনের পণ্য বয়কট করলে ভারতের বাণিজ্যিক মডেলে তাহলে কোথা থেকে প্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে হবে? জাপান, ইওরোপীয় ইউনিয়ন এবং আমেরিকা। সমস্যা হল, এই প্রতিটি দেশের প্রোডাক্ট কিংবা ইকুইপমেন্টের আমদানি মূল্য চীনের পণ্যের তুলনায় অন্তত দ্বিগুণ। চীনের সেটাই সুবিধা। আমাদেরও। সুতরাং সার্বিক বয়কট, যাকে বলা হয় ব্ল্যাঙ্কেট ব্যান, সেটা করা অযৌক্তিক। চীনকে বাণিজ্যিকভাবে বয়কট করার প্রথম ধাপ হল, কেন্দ্র অথবা রাজ্য, কোনও সরকারি মেগা প্রজেক্টে চীনের কোম্পানিকে যুক্ত হতে না দেওয়া। কারণ, ভারতের সেতু, উড়ালপুল, রেলওয়ে করিডর, হাইওয়ে অর্থাৎ ইনফ্রাস্ট্রাকচারাল প্রোজেক্টগুলিই হল চীনের কাছে সবথেকে আকর্ষণীয়। সেগুলির সঙ্গে যুক্ত থাকে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকার ডিল। এগুলিতে আটকে দেওয়া দরকার। যেটা এখন কেন্দ্রীয় সরকার কিছুটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সরকারের কাছে যে টাকা আছে সেটা দিয়ে তারা চীনের বদলে জাপান অথবা ইওরোপের সঙ্গে টাই-আপ করলে ব্যয় বাড়লেও বহন করতে পারবে। কিন্তু আমাদের মতো ৯৫ শতাংশ গরিব, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্তদের দেশে তো সস্তার দিকে ঝোঁক থাকবেই। কেউ ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও সস্তা কেনে। কিন্তু তার থেকে বহুগুণ বেশি মানুষ ক্রয়ক্ষমতা কম বলেই সস্তা কেনে। যেমন ধরা যাক, মধ্যবিত্ত আজকাল এয়ারকন্ডিশনার কিনতে পারছে। কারণ বাজারে একঝাঁক চীনের এসি আছে। যেই ওই প্রোডাক্ট বয়কট করা হবে, তখনই এই মানুষগুলির আর এসি কেনা হবে না। কারণ, জাপান, সাউথ কোরিয়া, ইওরোপ, আমেরিকার ব্র্যান্ডেড এসির দাম বহুমূল্য তাদের কাছে।
ভাগলপুরের খলিফাবাগ বাজারে গেলে দেখা যাবে, সেখানে চীনের মোবাইল ফোন প্ল্যাস্টিক প্যাকেটে বিক্রি হচ্ছে। শয়ে শয়ে। বাজারজুড়ে ইলেকট্রনিক্স ইলেকট্রিক্যাল পণ্য। সিংহভাগ চীনের। যেদিন থেকে চীনের পণ্য বয়কটের প্রচার শুরু হয়েছে, এই দোকানগুলির বিক্রি অর্ধেকের বেশি নেমে গিয়েছে ভয়ে। যদি পুলিশ ধরে। আর সবথেকে বড় ক্ষতি হল দোকানগুলি জানিয়েছে, এভাবে চললে সামান্য ৩ থেকে ৬ হাজার টাকার বেতনে যে ছেলেগুলো এখানে কাউন্টারে কাজ করে, তাদের চাকরি চলে যাবে। লস করে কতদিন আর সম্ভব কর্মী রাখা? চন্দননগরের আলোকশিল্পীদের কাছে যদি বলা হয়, চীনের ল্যাম্প বন্ধ করে দিতে হবে, তাদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়বে। কারণ, বিকল্প নেই। সুতরাং আত্মনির্ভর ভারতের পরিকল্পনা যখন হয়েছে, তখন কার্যকর হোক, খুব ভালো কথা। কিন্তু, দুম করে হাইপার দেশপ্রেমের ইভেন্টে এভাবে সামগ্রিক ব্যান করা শক্তির লক্ষণ নয়। দুর্বলের লক্ষণ। শক্তিশালীরা প্রতিযোগিতা করে। অন্য শক্তিশালীকে ময়দানে ঢুকতে না দেওয়া কাজের কথা নয়। ভারতের শক্তি যথেষ্ট। সুতরাং এখন থেকেই দেশীয় প্রোডাকশনে মরিয়া হয়ে ঝাঁপালে আজ নয় কাল অবশ্যই চীনের প্রোডাক্ট পরাজিত হবে। কিন্তু এখন চীনের প্রোডাক্ট বয়কট করলে সবার আগে সঙ্কটে পড়বে গরিব মানুষ। সেসব বেচে সংসার চালায় বহু হকার। তাদের আর বহু পণ্য বেচা হবে না। একইভাবে গরিবের আর কেনাও হবে না জীবনযাপনের ক্ষেত্রে।
হঠাৎ লাদাখে চীনের সেনা এগিয়ে এসে সীমান্ত সংঘাতে জড়িয়ে পড়ায়, ২০২০ সালের লকডাউনের মধ্যে মে মাসের শেষ সপ্তাহে আমাদের দেশপ্রেম জাগ্রত হল। মনে হল আত্মনির্ভর হওয়া দরকার। এবার একটু চীনকে শিক্ষা দিতে হবে। এটা কী কোনও পরিণত চিন্তা? আমরা অপেক্ষা করছিলাম নাকি যে কবে চীন আক্রমণ করবে, তারপর চীনকে টাইট দিতে হবে? অনেক আগে থেকেই এসব পরিকল্পনা হল না কেন? আসলে রাষ্ট্র থেকে জনতা, আমরা ক্রমেই ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টেই নিজেদের অভ্যস্ত করে ফেলেছি। মাঝেমধেই একটি করে ইভেন্ট আসে, আমরা ভেসে যাই সেই নতুন ইভেন্টে। স্মার্ট সিটি, নোট বাতিল, এনআরসি, সিএএ—কোথায় আলোচনা হয় আজকাল? এখন তো গোটা দেশের খেটে খাওয়ার মানুষকে মাত্র দু’টি অস্তিত্বরক্ষার সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে একটি ভাইরাস। জীবন বাঁচানো এবং জীবিকারক্ষা। বাকি সব অর্থহীন মনে হচ্ছে না? গত তিনমাসের নানাবিধ উচ্চকণ্ঠের চর্চার আড়ালে বরং আমাদের দেশের বিভিন্ন প্রান্তে অজানা ইভেন্টগুলির দিকে তাকানো যাক। দেখা যাক কী কী চলছে অন্য প্রান্তগুলিতে। ‘ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে দু’টি সংবাদ।
ভাগলপুরের মুশাহারি টোলার বালক বালিকাদের সবথেকে প্রিয় দিন ছিল শুক্রবার। ওই দিন স্কুলের মিড ডে মিলে ডিম দেওয়া হতো। লকডাউনের ফলে স্কুল বন্ধ তিনমাস। সেই প্রিয় শুক্রবার আসে না। শুধু তাই নয়, এই ২৫০ ছাত্রছাত্রীকে এখন বাবা মায়ের মতোই জঞ্জাল, স্ক্র্যাপ কুড়াতে হচ্ছে। নিয়ম হল মিড ডে মিল যেহেতু নেই, তাই প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীর বাবা মায়ের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে মিড ডে মিলের টাকা চলে যায়। কত টাকা? ১৫ দিনের জন্য ১১৪ টাকা। অর্থাৎ দিনে ৭ টাকা ৬০ পয়সা। লকডাউনে এই মহাদলিত বর্ণের পারিবারিক জঞ্জাল কুড়ানোর কাজ অনেক কমে গিয়েছে। স্ক্র্যাপ বিক্রিও নেই। তাই ওই ছেলেমেয়েদের মিড ডে মিলের নামে ব্যাঙ্কে আসা মাসে ২২৮ টাকাও অনেক।
১৭ বছরের মোদিয়াম সুখলের সবথেকে বড় বন্ধু হল সাইকেল। ছত্তিশগড়ের বিজাপুরের পেড্ডাকোরমা গ্রামের মোদিয়াম প্রতিদিন বাড়ি থেকে ১১ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে একটি হাইওয়ের কাছে আসে। সেখানে রাস্তার পাশের মাঠে বসে। ব্যাগে থাকে আসন, খাতা, বই, পেন আর জল। ধু ধু প্রান্তরের মধ্যে বসে সে অনলাইন ক্লাস করে। লকডাউনের জন্য স্কুল বন্ধ। তাই ছত্তিশগড় সরকার প্রকল্প নিয়েছে স্কুল তোমার ঘরেই। অর্থাৎ অনলাইন ক্লাস। কিন্তু ঘরে বসে অনলাইন ক্লাস করা সম্ভব নয় মোদিয়ামের। তাই তাঁকে আসতে হয় চেরপাল নামের এক জনপদের কাছে হাইওয়েতে। কেন? কারণ একমাত্র সেখানেই সে মোবাইলের সিগন্যাল পায়! শুধু মোবাইলের সিগন্যাল পেতে তাঁকে প্রতিদিন সকালে ১১ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে আসতে হয় ওই মাঠে। ক্লাস করতে! লাদাখ নয়, কোভিড নয়, চাইনিজ প্রোডাক্ট বয়কট নয়। ক্লাস টেন পাশ করার জন্য মরিয়া মোদিয়াম সুখলের একটাই সমস্যা-সিগন্যাল!