কর্মপ্রার্থীরা বেশ কিছু সুযোগের সংবাদে আনন্দিত হবেন। বিদ্যার্থীরা পরিশ্রমের সুফল নিশ্চয় পাবে। ভুল সিদ্ধান্ত থেকে ... বিশদ
উপরে যে সিদ্ধান্তগুলোর কথা বলা হল সেগুলো ‘পরিষ্কার ভুল’ কি না একটু ভেবে দেখার সময় হয়েছে। ‘স্বাধীনতা’ একটি অলঙ্ঘনীয় অধিকার। তার প্রতি আমাদের মমত্ববোধের অভাব এবং স্বাধীনতা কমে যাওয়ার ব্যাপারে অজ্ঞতা থাকতে পারে। তার থেকে ব্যাপারটা ‘জর্জ ফ্লয়েড পরিস্থিতি’ (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটা) এবং ‘জয়রাজ ও ফেনিক্স পরিস্থিতি’ (ভারতের তামিলনাড়ু)-র দিকে গড়ায়।
‘জয়রাজ ও ফেনিক্স’ যদিও ভারতে হেফাজতে অত্যাচারের প্রথম মামলা নয়। ১৯৯৬ সালে ফিরে যাওয়া যাক। হেফাজতে হরবখত অত্যাচারের অভিযোগ জানিয়ে চিঠি লিখেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের জনৈক ডি কে বসু এবং উত্তরপ্রদেশের জনৈক এ কে জোহরি। ব্যাপারটাতে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে (স্যুয়ো মোটো) হস্তক্ষেপ করেছিলেন সুপ্রিম কোর্টের দুই বিচারপতি। ১৯৯৬ সালের ১৮ ডিসেম্বর ‘ডি কে বসু বনাম পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য (১৯৯৭) ১ এসএসসি ৪৩৬’ মামলায় তাঁরা এক ঐতিহাসিক রায় দেন। ওই রায়ের বাস্তবতার প্রমাণ বহুবার পাওয়া গিয়েছে। কিন্তু, পরিতাপের বিষয় এই যে পরবর্তী ২৪ বছরে এই রেওয়াজের কোনও বদল হয়নি।
অতিরিক্ত পুলিস
অন্যের প্রতি রাষ্ট্রের আচরণ সম্পর্কে একজন গড়পড়তা নাগরিকের রাষ্ট্রের প্রতি সরল বিশ্বাস থাকে। সাধারণ নাগরিক এটাই বিশ্বাস করেন যে, একজন পুলিস অফিসার, একজন সরকারি উকিল, একজন বিচারক, একজন বিচারপতি কিংবা একজন ডাক্তার সবসময় আইন মেনে কাজ করবেন। আসলে তিনি ভুলের শিকার। লর্ড ডেনিংয়ের কাছে শুনুন:
‘আমাদের সকলের মধ্যে যে ধরনের দোষ ‘কমন’, প্রশাসনের কর্তারা (এক্সিকিউটিভ) সেইসব ব্যাপারে কখনওই অপরাধী হবেন না, এটা কেউ মনে করেন না। আপনি নিশ্চিত হতে পারেন যে তাঁরা কখনও কখনও এমন কাজ করে ফেলেন যা তাঁদের করা উচিত নয়। অন্যদিকে, তাঁদের করা উচিত এমন অনেক জিনিস আবার তাঁরা করেন না।’
হেফাজতে অত্যাচারের বীজ হেফাজতেই বোনা হয় না। এর সন্ধান মিলতে পারে বাইরের একাধিক ক্ষেত্রে। যেমন গ্রেপ্তার, জামিন নামঞ্জুর, পুলিসি হেফাজত মঞ্জুর এবং বিচারবিভাগীয় হেফাজতে পুনরায় পাঠানো। প্রতিটা পর্বের জন্য আইনি অবস্থান স্পষ্ট। কিন্তু আইনের প্রয়োগের ব্যাপারটাই প্রায়শ গোলমেলে—ত্রুটিপূর্ণ ও বিকৃত।
ব্যাপারটা গ্রেপ্তার থেকে বুঝে নেওয়া যায়। ডি কে বসু মামলায় আদালত মনে করিয়ে দিয়েছে যে, সাধারণ পুলিসকে বাদ দিয়েও আমরা অন্য অনেকগুলো সংস্থাকে গ্রেপ্তার করার ক্ষমতা দিয়েছি। যেমন সিবিআই, ইডি, সিআইডি, সিআরপিএফ, বিএসএফ, ট্রাফিক পুলিস, ইনকাম-ট্যাক্স প্রভৃতি। এদের মধ্যে কেউ কেউ দাবি করে যে, যেহেতু তারা পুলিস নয়, সেই কারণে তারা সমস্ত আইনি ব্যবস্থা (কোড অফ ক্রিমিনাল প্রসিডিওর) মানতে বাধ্য নয়! উদাহরণ হিসেবে ইডি-র কথা বলি। ইডি-র সাফ কথা, তারা ‘কেস ডায়েরি’ মেনটেন করতে বাধ্য নয়। একটা গ্রেপ্তারের ঘটনা যখন ঘটে তখন আরও কী খারাপ হয় তা আমরা নির্দিষ্ট করে বলিনি। জাতীয় পুলিস কমিশনের তৃতীয় পর্যবেক্ষণ রিপোর্টে ধরা পড়েছে যে, সমস্ত গ্রেপ্তারের ঘটনার শতকরা ৬০ ভাগই ‘অপ্রয়োজনীয়’'। ওই রিপোর্টে যেসব গাইডলাইনের সুপারিশ রয়েছে, বিচারপতিরা সেগুলো তুলে ধরে হতাশা প্রকাশ করেছেন—
‘ব্যক্তি স্বাধীনতার (পার্সোনাল লিবার্টি অ্যান্ড ফ্রিডম) মৌলিক অধিকারটা সংবিধানস্বীকৃত। পুলিস কমিশনের সুপারিশগুলো তার সঙ্গেই সঙ্গতিপূর্ণ। তা সত্ত্বেও এই সুপারিশগুলো এখনও পর্যন্ত বিধিবদ্ধ মর্যাদা (স্ট্যাটুটরি স্টেটাস) পায়নি।’
গ্রেপ্তার ও হাজত
আনেকগুলো কর্তৃপক্ষের হাতে গ্রেপ্তারের ক্ষমতা দেওয়া রয়েছে। এগুলো কেড়ে নেওয়া থেকেই সংস্কারটা শুরু হওয়া দরকার। দ্বিতীয় ঘোষণা দরকার, গ্রেপ্তার করার ক্ষমতা যাঁর থাকবে তিনি হবেন একজন ‘পুলিস’ অফিসার। সংস্কারের তিন নম্বরে গ্রেপ্তারের ক্ষমতা ভীষণভাবে সীমাবদ্ধ করে দিতে হবে। শুধু নির্দিষ্ট করে দেওয়া পরিস্থিতিগুলোতেই গ্রেপ্তার করা যাবে। মনে করে দেখুন, জয়রাজ ও ফেনিক্সকে কেন গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। লডকাউনে যতটা সময় দোকান খুলে রাখার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল, তার চেয়ে ১৫ মিনিট বেশি দোকান খুলে রেখেছিলেন তাঁরা। তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল এমন এক অভিযোগে!
দ্বিতীয় ধাপটা হল, অভিযুক্তকে আদালতে পেশ করা এবং হেফাজতে নেওয়া। নিম্ন আদালতের একজন বিচারক বা জেলা বিচারক পুলিসি হেফাজত মঞ্জুর করার আগে ক্বচিৎ বিচার করে দেখেন যে সেটার আদৌ দরকার আছে কি না। পুলিসি হেফাজতের সর্বোচ্চ মেয়াদ হল ১৫ দিন। পুলিসি হেফাজতের মেয়াদ শেষ হতেই আদালত অবধারিতভাবে অভিযুক্তকে বিচারবিভাগীয় হেফাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন। কিন্তু আইন একেবারে অন্যরকম। ‘মনুভাই রতিলাল প্যাটেল, (২০১৩) ১ এসসিসি ৩১৪’ মামলায় সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, ‘বিচারক ঘটনাটির সত্যাসত্য উপলব্ধি সাপেক্ষে নিজের বিবেচনামতো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন: অভিযুক্তকে পুলিসি হেফাজতে পাঠাবেন, না কি বিচারবিভাগীয় হেফাজতে পাঠানো যুক্তিযুক্ত হবে, অথবা কোনও হেফাজতে পাঠানোর আদৌ প্রয়োজন নেই।’ নিম্নরেখ কথাগুলো মনে রেখে রায় দেন এরকম ম্যাজিস্ট্রেট বা জেলা জজ বিরলপ্রায়।
তৃতীয় ধাপ হল, গ্রেপ্তার হওয়া বা হেফাজতে নেওয়া ব্যক্তির ডাক্তারি পরীক্ষা। জয়রাম এবং ফেনিক্সকে একজন ডাক্তারকে দিয়ে ঠিকমতো দেখানো হয়ে থাকলে, তাঁদের স্বাস্থ্য ঠিক আছে (আ ক্লিন বিল অফ হেলথ) বলে কী করে রিপোর্ট দিতে পারতেন?
ব্যতিক্রমটাই আইন হয়ে যায়!
চতুর্থ ধাপ হল জামিন। সরকার পক্ষের উকিল বা প্রসিকিউটর জামিনের বিরোধিতা করলে খুব কম ম্যাজিস্ট্রেট বা জেলা জজ জামিন মঞ্জুর করে থাকেন। অন্তত প্রথম বা দ্বিতীয় শুনানিতে এটাই হয়েই থাকে। তদন্ত অথবা বিচার শেষ হয়নি এমন অভিযুক্তদের (আন্ডার-ইনভেস্টিগেশন অর আন্ডার-ট্রায়াল) নিয়ে ভরে আছে প্রতিটা জেল। যদিও লোকগুলোর জামিনেই ছাড়া পাওয়ার কথা। বালচাঁদ (১৯৭৭) ৪ এসসিসি ৩০৮ মামলায় এই আইনটা তৈরি হয়েছিল। বিচারপতি ছিলেন কৃষ্ণ আয়ার জে। সেই থেকে জামিন মঞ্জুর করাটাই আইন এবং জেলে পাঠানোটা ব্যতিক্রম (বেইল ইজ দ্য রুল, জেল ইজ দি এক্সেপশন)—এক মান্য নিয়মে পরিণত হয়েছে। কিন্তু সামান্য সংখ্যক ম্যাজিস্ট্রেট বা বিচারক এই আইনের প্রয়োগ করে থাকেন। ‘ব্যতিক্রম’-এর প্রয়োগেই তাঁদের সুখ!
জয়রাজ ও ফেনিক্স মামলার কথায় আসি। অতি তুচ্ছ অভিযোগে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। পুলিসি বা বিচারবিভাগীয় কোনও হেফাজতেই তাঁদের পাঠানোর কথা ছিল না। আদালতে পেশ করামাত্র তাঁদের জামিন মঞ্জুর করাই উচিত ছিল।
এটাই হতাশার কথা যে, ব্যক্তি স্বাধীনতা সম্পর্কিত আইনটা তত্ত্বে রয়ে গেল একরকম আর বাস্তবে রয়ে গেল অ্যরকম। সৌভাগ্য যে, জিনিসগুলো পাল্টাচ্ছে। সম্প্রতি সুশীলা আগরওয়াল (জানুয়ারি ২৯, ২০২০) মামলায়, এক সাংবিধানিক বেঞ্চ পুরনো একটা সাংবিধানিক বেঞ্চের রায়ের সঙ্গে সহমত হল। পুরনো সাংবিধানিক বেঞ্চটা গঠিত হয়েছিল গুররক্স সিং সিব্বিয়া (১৯৮০) ২ এসিসি ৫৬৫ মামলার পরিপ্রেক্ষিতে। সুশীলা মামলায় গঠিত সাংবিধানিক বেঞ্চের সাহসী রায়ে খারিজ হয়ে গেল সুপ্রিম কোর্টেরই অন্য আটটি মামলার রায়। নির্দিষ্ট অন্য কয়েকটা রায় সম্পর্কে মত দিতে গিয়ে সর্বোচ্চ আদালত ওইসঙ্গে আরও ঘোষণা করে দিল যে, সেগুলো ‘ভালো আইন নয় (নট গুড ল)।’ মানুষমাত্রেই ভুল করে আর ভুলের সংশোধনটা হল বিচার।
জয়রাজ এবং ফেনিক্সকে মৃত্যুর আগে যে পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয়েছিল, সেই পরিস্থিতিতে যাঁরা রয়েছেন, তাঁদের জন্য তবু আশা আছে।
• লেখক সংসদ সদস্য ও কেন্দ্রের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী