বাধা ও অসফলতার জন্য চিন্তা। মানসিক টানাপোড়েনের মধ্যে কোনও ভালো যোগাযোগ পেতে পারেন। ... বিশদ
টেলিভিশনের আলোচনায় সন্ধেবেলা সঞ্চালক জিজ্ঞেস করছেন এর সমাধান, বিশেষজ্ঞরা গম্ভীর মুখে উত্তর দিচ্ছেন। কিন্তু সকলেই জানেন এর উত্তর সহজ নয়। আর তার থেকেও বড় মুশকিল একেবারে নিম্নবিত্তের কাছে ত্রাণ পৌঁছে দেওয়ার উপায় যেমন সরকারের জানা আছে, মধ্যবিত্তের কিন্তু সেই জায়গাটাই নেই। নিম্নবিত্তের কাছে ত্রাণের টাকা পৌঁছনো নিয়ে অনেক গল্প আছে, সত্যিই বরাদ্দ একশো টাকার মধ্যে ঠিক কত তাঁদের কাছে পৌঁছয় আর কতটা মাঝপথে উধাও হয়ে যায় সেটা আমাদের রাজনীতির মূল আলোচ্য বিষয়। শেষমেশ ত্রাণের একটা অংশ চুঁইয়ে তাঁদের কাছে পৌঁছয়। অন্যদিকে কোনও এক-দু’ কামরার আবাসের বারান্দা থেকে নীচের রাস্তায় চাল-ডাল বিলনো হচ্ছে দেখলেও মধ্যবিত্ত খুব সহজে সেই সারিতে দাঁড়াতে পারেন না। এ প্রসঙ্গে দু’-একটি ঘটনার কথা উদাহরণ হিসেবে বলতেই হয়। ধরুন এক কিশোরীর কথা। সময়টা হতে পারে ষাটের দশক, যখন তার বাবার ব্যবসাটা একবারেই চলছে না। অথবা আজকের কোভিড অতিমারী, যখন পিতৃদেবের বেসরকারি চাকরিটা গেছে। মেয়েটির বাড়িতে তিনবেলা খাবার হওয়া বন্ধ, অর্থাৎ সকালের জলখাবারের পাট চুকে গিয়েছে। এখন কোনওভাবে দুপুরের ভাত আর বিকেলের রুটি। পাশের বাড়ি বা ফ্ল্যাটে থাকে সেই কিশোরীর বান্ধবী। সৌভাগ্যবশত বান্ধবীর পরিবারে এখনও বজায় আছে স্বচ্ছলতা। সে হয়তো বারান্দায় দাঁড়িয়ে সকালের জলখাবারে পাউরুটি-মাখন খাচ্ছে আর তার ধারের অংশটুকু ছিঁড়ে ছিঁড়ে ফেলছে সামনে উড়তে থাকা কাকগুলোর জন্য। এ দৃশ্য দেখে যদি প্রথম কিশোরীর খিদে পায়, সে শুধু গিলতে পারে ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস। গোপনে ফেলতে পারে চোখের জলটুকুই। একেবারে নিম্নবিত্ত পাশাপাশি বাস করা দুই পরিবারের একজনের অভুক্ত থাকার সঙ্গে মধ্যবিত্তের বিভাজন অনেকটা আলাদা। নীচের তলায় চাওয়ার লজ্জা খুব বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায় না, কিন্তু মধ্যবিত্তের শরীর জাপটে থাকে বংশগত আত্মসম্মান। পাশের বাড়ি থেকে রবিবারের দুপুরে উড়ে আসা মাংসের ঝোলের গন্ধ প্রতি মুহূর্তে মনে করিয়ে দেয় অতীতে ঠিক কোথায় ছিলাম আর ঘটমান বর্তমানে কোথায় আটকে গেছি। মধ্যবিত্তের সন্তান অন্যের বাড়িতে গিয়ে আইসক্রিম কাপের তলাটুকু জিভ দিয়ে চাটলে বাবা-মা আড়ালে তাকে কানমলা দেন। সে সমস্যা নিম্নবিত্তের নেই।
মধ্যবিত্তের সংজ্ঞা পেরিয়ে আবার একটু অঙ্কে ফিরে আসি। আট কোটি মধ্যবিত্ত মানুষের রোজগার প্রতি মাসে গড়ে পঁচিশ হাজার টাকা করে ধরলে দাঁড়ায় দু’লক্ষ কোটি। অর্থাৎ বছরে চব্বিশ লক্ষ কোটি টাকা। মনে রাখতে হবে, আমাদের দেশের বাৎসরিক বাজেট তিরিশ লক্ষ কোটির কিছুটা বেশি। অর্থাৎ মধ্যবিত্তের যে বাজার তা বিপুল। আর এই মধ্যবিত্তের বাজারের উপর নির্ভর করে বেঁচে থাকে মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত। আজকের দিনে রেস্টুরেন্ট থেকে শুরু করে পর্যটন, শিক্ষা থেকে শুরু করে বিউটি পার্লার, সব জায়গাতেই লকডাউনের তীব্র প্রভাব। উচ্চ মাধ্যমিকের কয়েকটা পরীক্ষা বাকি থেকে যাওয়া অবস্থায় ভ্যান-রিকশায় সব্জি বিক্রি করতে হচ্ছে মধ্যবিত্ত বাড়ির ছেলেকেই। সারাদিন খেটে এসে ক্লান্ত চোখে চলছিল পড়া মুখস্থ। আজকে ভাগ্যিস সেই বাকি পরীক্ষাগুলো বাতিলের খবর এসেছে। সন্ধেবেলা আর পড়তে হবে না। কোনওমতে রিচার্জ করে আনা মোবাইল ফোনে সে জীবনমুখী গান শোনে। কিন্তু তার মধ্যেই আবার মাথায় আসে সামনের দিনে কলেজে ভর্তি হওয়ার দুশ্চিন্তা। তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে কাজ করা কোনও এক মধ্যবিত্তের চাকরিটা এখনও টিমটিম করছে, কিন্তু মাইনে কমেছে অনেকটা। একদিকে ইএমআই, অন্যদিকে সন্তানের ইস্কুলের ফি কিংবা গৃহশিক্ষকের বেতন। স্কুলের ফি নিয়ে গন্ডগোলে সেখানকার মালিক মাইনে কাটছে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের, তাঁরাও আবার মধ্যবিত্ত। শুধুমাত্র গৃহশিক্ষকতা করে মাসে হাজার কুড়ি টাকা রোজগার করতেন যে মানুষটি, লকডাউনে তিনি পড়েছেন মহা আতান্তরে। একদিকে ছাত্রের মা বলছে সাম্মানিক দিতে অসুবিধের কথা, অন্যদিকে নিজের মেয়ের জন্যে নতুন বছরের স্কুলের বইগুলো কেনা হয়নি। ভীষণ এক আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে মধ্যবিত্তের প্রতিদিন। রেললাইনের ধারে বসতি পুড়লে সেই বিপদ থেকে উদ্ধার পান নিম্নবিত্ত মানুষ। পাড়ার নেতা ত্রাণের ব্যবস্থা করেন, রাতের থাকার ব্যবস্থা হয় স্কুলবাড়িতে, আবার কিছুদিন পর শুরু হয় ত্রিপল টাঙিয়ে জীবনযুদ্ধ। মধ্যবিত্তের জীবনখাতায় সেই অঙ্ক মেলে না। সেখানে কাজের লোকের ছুটি হয়, ছেলেমেয়ের টিউশনের মাস্টার কাজ হারান, বাড়ির টেলিভিশন খারাপ হলে সারানো হয় না, সোফা ছিঁড়ে তুলো বেরতে থাকে, কাজ হারানো গৃহকর্তা বেলা এগারোটার পর বাজার যান শুকনো সব্জির সন্ধানে, পঞ্চাশ টাকা থেকে চালের কিলো নামে তিরিশে, আমিষ বলতে শুধু ডিম, পাতা ভুলে সস্তার ফোটানো চায়ের উষ্ণতায় দিন গড়ায়। এখানে একশো দিনের কাজ নেই।
তবে মনে রাখতে হবে, প্রথম বিশ্বের দেশগুলো এই বিষয়ে ভাবছে। মার্কিন দেশে যাঁরা কর দেন তাঁদের প্রত্যেকের ব্যাঙ্কে পৌঁছে গিয়েছে বেশ কয়েক হাজার ডলার। ঠিক সেরকমই আমাদের দেশেও বেসরকারি বহু কর্মচারী কর দেন, গাদা গাদা জিএসটি দেন বহু ব্যবসায়ী। সেখান থেকে পরিসংখ্যান নিয়ে তাঁদের আগের বছরের রোজগার এবং এ বছরের আয়ের তুলনা করে সরকার গত বছরের দেওয়া কর থেকে কিছুটা ফেরত দিতে পারেন। সরকারি ব্যাঙ্কের থেকে নেওয়া ঋণের ক্ষেত্রে ইএমআই আপাতত শোধ করতে হবে না সেকথাও বলতে পারেন। এরকম কথা সরকার বলেছেন, কিন্তু তাতে অনেকটাই ফাঁকি, কারণ সুদ চড়ছে ইএমআই না দিলে। অর্থাৎ দেশ যদি হয় কল্যাণকামী, তাহলে সমাজতন্ত্র বা পুঁজিবাদের কচকচিতে জনগণের জীবন বিপর্যস্ত হয় না। নিম্নবিত্তকে যেভাবে সামলানো যায় শিক্ষিত মধ্যবিত্তকে সেই পথে দমিয়ে রাখা কিন্তু শক্ত। সকলেই তো আর লুকিয়ে জীবন থেকে পালিয়ে যাবেন না। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া মধ্যবিত্ত যদি সবাই একসঙ্গে কোণঠাসা বিড়ালের মতো ফোঁস করে ওঠে, সরকারের পক্ষে তা সামলানো মুশকিল। পরিস্থিতি হাতের বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার আগে নেতানেত্রীরা একটু ভাববেন কি?
লেখক ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক। মতামত ব্যক্তিগত