বাধা ও অসফলতার জন্য চিন্তা। মানসিক টানাপোড়েনের মধ্যে কোনও ভালো যোগাযোগ পেতে পারেন। ... বিশদ
ভারত–চীন যুদ্ধ হয়েছিল ১৯৬২ সালে। ৫৮ বছর আগে। সেটা অবশ্যই ধাক্কা। নেহরু–চৌ এন লাই ঘনিষ্ঠতা, ভারত–চীনি ভাই ভাই থেকে শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ। তারপর, ধীরে ধীরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়েছে। তার বড় অবদান ১৯৭৭ সালে বিদেশমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ির। এতদিন পর, ফের সংঘাত। রক্তপাত। গালওয়ানে ২০ জওয়ানের শহিদ হওয়ার পর বিবৃতি দিতে ৩৬ ঘণ্টা সময় লেগেছে প্রধানমন্ত্রীর। তাঁর প্রতিক্রিয়ায় চীনের নাম উধাও। কেন?
প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, প্রধানমন্ত্রী চীনের প্রতি নমনীয় মনোভাব দেখাচ্ছেন? ‘মন কি বাতে’ সীমান্ত সমস্যা ইস্যুতে বলতে গিয়ে কেন চীনের নাম উল্লেখ করা থেকে বিরত থেকেছেন? সর্বদলীয় বৈঠকে “কেউ ভারতের ভূখণ্ডে ঢোকেনি, কেউ ভারতের সীমান্ত ঘাঁটি দখলও করেনি” বলে ইচ্ছাকৃত বিভ্রান্তি তৈরি করেছেন কেন? তাহলে ২০ জন জওয়ানকে শহিদ হতে হল কেন? সীমান্ত সমস্যা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী, প্রতিরক্ষামন্ত্রী, বিদেশমন্ত্রী আর সেনা প্রধানের বয়ানে গরমিল থাকছে কেন?
যে নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে নির্বাচনী ফায়দার জন্য উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে ইন্ধনের অভিযোগ উঠেছে বারবার, সেই তিনি চীনের মতো প্রতিপক্ষের সঙ্গে চলতি সংঘাতের আবহে কী করে এমন মন্তব্য করে বসলেন? ভারতের ভূখণ্ডে নাকি এক ইঞ্চিও ঢোকেনি চীন-বাহিনী, ভারতের সেনাবাহিনীও নিয়ন্ত্রণরেখা পেরয়নি। তা হলে দুই বাহিনীর
রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষটা ঘটল কীভাবে? এই সব কঠিন প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেয়ে নজর ঘুরিয়ে দেওয়া
ভালো শেয়ারইট আর টিকটকের দিকে। যাকে বলে ড্যামেজ কন্ট্রোল!
অতএব, ফোন থেকে সবরকম চৈনিক চিহ্ন মুছে ফেলতে হবে। স্রেফ জাতীয়তাবাদের জিগির তুলতে চীনের ৫৯টি অ্যাপ নিষিদ্ধ করে দেওয়া হল। এর
মধ্যে রয়েছে জনপ্রিয় শর্ট ভিডিও প্ল্যাটফর্ম টিকটক, ইউসি ব্রাউজার, ফাইল শেয়ারের জন্য ব্যবহৃত শেয়ারইট এবং ক্যাম স্ক্যানার, যে অ্যাপের মাধ্যমে অ্যাপল ও অ্যান্ড্রয়েড ডিভাইসে ছবি ও ডকুমেন্ট স্ক্যান করা যায়। নিষেধাজ্ঞার তালিকায় থাকা বেশ কিছু অ্যাপ, বিশেষত টিকটকের এদেশে ১০ কোটি অ্যাকটিভ ইউজার রয়েছেন। হেলো ও লাইকির মতো প্ল্যাটফর্ম এবং ভিডিও চ্যাট অ্যাপ বিগো লাইভ যেসব ভারতীয়রা ইংরেজিতে তত সক্ষম নন, তাঁদের মধ্যে যথেষ্ট জনপ্রিয়। এক্ষেত্রে ব্যবহারকারীদের বিকল্প খুঁজতে হবে। সেই বিকল্প কী? এ ছাড়াও এই প্ল্যাটফর্মগুলিতে ভারতীয় ক্রিয়েটর রয়েছেন, যাঁদের অনেকেরই এটিই একমাত্র উপার্জনের জায়গা। অনেকগুলি অ্যাপের ভারতে অফিস ও কর্মী রয়েছেন, কয়েক হাজার চাকরি এবার বিপন্ন।
জাতীয়তাবাদী আবেগ নিয়ে কেউ কেউ একে বলছেন: ‘ভার্চুয়াল স্ট্রাইক’!
১৯৬২ সালে চীন-ভারত যুদ্ধের সময়ও নয়া জাতীয়তাবাদের জিগির তুলে এভাবেই চীন সম্পর্কিত নাড়ি ছেঁড়ার চেষ্টা হয়েছিল। যদিও তখন চীনা পণ্য এই হারে উৎপাদন হতো না। দেশে-দেশে রপ্তানিও হতো না। এখন ঘরে ঘরে চীন। হাতে হাতে চীন। তার কারণ, চীনা পণ্য সস্তা। আর সস্তা বলেই মানুষ কিনছে। তাই আমদানিও হচ্ছে। কয়েকটি খবরের চ্যানেলে এ বিষয়ে তুমুল আলোচনা। খেয়াল করেছেন, সেইসব অনুষ্ঠানের বিজ্ঞাপনদাতা কিন্তু চীনা মোবাইল সংস্থা!
যাঁরা আমদানি-রপ্তানি বাজারের খবর রাখেন, তাঁরা জানেন, কোথায় কার টিকি বাঁধা। ২০১৬ সালের ৮ নভেম্বর দেশজোড়া নোটবন্দি করে জিনিসপত্র কেনাবেচায় টাকা লেনদেনের জন্য পেটিএম-পথ বাতলে দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। এই পেটিএম কোম্পানির প্রধান অংশীদার কে জানেন? চীনের আলিবাবা গ্রুপ। এলইডি লাইট, টুনি চেন, টর্চ, লাইটার, ব্যাটারি, মোবাইল বা আতসবাজিতেই চীনা পণ্যতালিকা শেষ নয়, ওগুলো স্রেফ খেলনা। জীবনদায়ী যাবতীয় ওষুধের কাঁচামাল আসে চীনের উহান প্রদেশ থেকে। তা যদি বয়কট করা হয়, আমাদের ওষুধ শিল্প মুখ থুবড়ে পড়বে। এছাড়া স্টার্ট-আপ ইন্ডিয়ার পতাকা যারা বহন করছে, তাদের অধিকাংশই চলছে এখন চীনা বিনিয়োগে ও অংশীদারিত্বে। ফ্লিপকার্ট, ওলা, ওয়ো, বিগ-বাস্কেট—সব
মিলিয়ে বিনিয়োগ প্রায় চার বিলিয়ন ডলার, কাজ তৈরি হয়েছে প্রায় এক কোটি।
সর্দার প্যাটেলের মূর্তি বা নাগপুরের মেট্রো প্রোজেক্ট যদি ছেড়েও দিন, গোটা লকডাউন-পর্ব বা এখন আনলক-পর্বে প্রধানমন্ত্রী ভিডিও কনফারেন্সে সব রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে ঘন-ঘন যে বৈঠক করলেন, তার অ্যাপ মানে জুম অ্যাপটির মালিক এক চীনা। এরিক ইউয়ান। কিংবা গত ৯ জুন কয়েকশো কোটি টাকা ব্যয়ে অমিত শাহ ভার্চুয়াল জনসভা করে বাংলার ভোটপ্রচারের প্রাথমিক সূচনা করলেন, তার কারিগরি টিকিও তো চীনের সঙ্গে বাঁধা। ওই যে সোশ্যাল ডিসট্যান্স রক্ষা করতে ঘরে বসে খাবারের অর্ডার দিচ্ছেন, তার বাহক, জ্যোম্যাটো বা সুইগি কোম্পানিরও সিংহভাগ শেয়ার চীনের। শুধু তাই-ই নয়, যুদ্ধ আবহে চীনা পণ্য পোড়ানোর ছবি তুলেছেন যে মোবাইল ফোনে, সেটাও কোনও চীনা কোম্পানির! চীনা লগ্নি যে এখন কার-কার সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে আছে, তা বাছতে গেলে গাঁ উজাড় হবে।
‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ বলে শোর তুললেই তো হয় না, ‘মেক’-টা করবে কে? মার্কিন লগ্নির আপ্যায়নে যাবতীয় সমস্যার সমাধান হবে তো? মোদি সরকার যতই মেক ইন ইন্ডিয়ার কথা বলুক, পরিসংখ্যানেই স্পষ্ট যে, ২০১৫ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে চীনা পণ্যের আমদানি এ দেশে কমেনি। বরং বেড়েছে। এর একটা বড় অংশ আবার রিয়্যাক্টর, বয়লারের মতো জটিল যন্ত্র, বিভিন্ন বৈদ্যুতিন পণ্য কিংবা তার যন্ত্রাংশ ইত্যাদি। এই সমস্ত পণ্য আসার পথে রাতারাতি দেওয়াল তুলে দিলে, দেশের উৎপাদন শিল্প সেই ধাক্কা সহ্য করতে পারবে তো? অন্য জায়গা থেকে বেশি দরে কাঁচামাল কিনতে হলে, তাদের পক্ষে আদৌ সম্ভব হবে দেশে কম দামে পণ্য বিক্রি? কিংবা দরের গলাকাটা লড়াইয়ে জিতে বিশ্ব বাজারে কল্কে পাওয়া?
সীমান্তে আগ্রাসনের জবাবে চীনা পণ্য বয়কট করুন। বাণিজ্যের দরজায় খিল এঁটে শায়েস্তা করা হোক বেজিংকে। লাদাখে সংঘর্ষের পর থেকে এই দাবিতে সরগরম সোশ্যাল মিডিয়া। পুরোদস্তুর প্রচারে সঙ্ঘের শাখা স্বদেশি জাগরণ মঞ্চ। বর্জনের দাবিতে ৫০০-রও বেশি পণ্যের তালিকা প্রকাশ করেছে খুচরো ব্যবসায়ীদের সংগঠন সিএআইটি-ও। অথচ, গত ১৮ জুন এক ই-কমার্স সংস্থায় স্বল্প সময়ের ছাড়ে (ফ্ল্যাশ সেল) মোবাইল বিক্রির বিজ্ঞাপন দিয়েছিল এক চীনা সংস্থা। সব বিক্রি হতে আধ ঘণ্টাও সময় লাগেনি! চীনা পণ্যের বিকল্পের খোঁজ কিংবা বেজিংয়ের বাণিজ্যিক প্রত্যাঘাত হজম করার কলজে এই মুহূর্তে ভারতীয় অর্থনীতির কতখানি, সে বিষয়েও তেমন নিশ্চিত নন বিশেষজ্ঞদের অনেকে। কে কাকে বোঝাবে, চীনা পণ্য মানে গুটিকয় চীনা খাবারের রেস্তোরাঁ নয়!
সামান্য গুগল সার্চ করলেই দেখতে পাবেন, চীনের সঙ্গে ভারতের ব্যবসায়িক সম্পর্ক ঊর্ধ্বমুখী। ২০০৬-এ যে চীন-ভারতের মধ্যে ব্যবসা হতো ২৩.৪৭ বিলিয়ন ডলারের সেটাই ২০১৯-২০ তে বেড়ে ৯২ বিলিয়ন ডলার। ভারতে আমদানি বাবদ ৭৪ বিলিয়ন ডলার চীনে ঢোকে। সেটা চীনের বছরে মোট রপ্তানির মাত্র ২ শতাংশ। চীনে রপ্তানির বাবদ ভারতের কোষাগারে ঢোকে ১৮ বিলিয়ন ডলার। আমদানি এবং রপ্তানির মধ্যে এই যে পার্থক্য, মার্কেটের পোশাকি ভাষায় এটাই, ‘বাণিজ্যিক ঘাটতি’। তাই চীনের ২ শতাংশ রপ্তানির কোমর ভাঙার আগে, আমাদের ওই বিপুল আমদানির বিকল্প ব্যবস্থা তো করতে হবে, তাই না?
আমদানির তালিকায় শুধু সস্তার আলো, খেলনা, ইলেকট্রিকাল বা ইলেকট্রনিক্স (যেমন ফোন, টিভি) নেই। আছে আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ সামগ্রী। যেমন— ওষুধ, কৃষির জন্য কীটনাশক, টেলিকম
ও কম্পিউটারের যন্ত্রপাতি, ব্যাটারি-র লিথিয়াম ইত্যাদি। দেশে যে ওষুধ তৈরি হয়, তার ৭৫ শতাংশ কাঁচামাল চীনের। কিছু অ্যান্টিবায়োটিকের ক্ষেত্রে
তা প্রায় ৮৫ শতাংশ। ওষুধ রপ্তানির ক্ষেত্রে
ভারতের যে সাফল্য, তাতে চীন থেকে আসা সস্তার কাঁচামালের ভূমিকা প্রধান। দেশে কৃষিক্ষেত্রে যে কীটনাশকের ব্যবহার, তার ৮০ শতাংশ কাঁচামাল চীনের। যে টেলিকম শিল্পের হাত ধরে ডিজিটাল ইন্ডিয়ার স্বপ্ন দেখানো হচ্ছে, ৩জি বা ৪জি, তার যন্ত্রাংশের ৭৫ শতাংশ চীনের।
ভারতের বাজারে চীনের এই ব্যাপক বিনিয়োগের বিকল্প দিশা দেখাবে কে? চীনের সঙ্গে মোদি সরকারের ব্যবসায়িক সখ্যের লিস্টি বেশ লম্বা। সম্প্রতি খবরে প্রকাশ, ‘পিএম কেয়ার’-এ চীনের কোম্পানিগুলির মোট অনুদানের পরিমাণ নাকি প্রায় ৫০ কোটি! ভারতের যে রাজ্যে চীনের বিনিয়োগ সবচেয়ে বেশি, সেটা টানা ১৯ বছরের বিজেপি শাসিত গুজরাত।
মনে রাখবেন, ৩০ মিনিটের বক্তৃতায় ২৭ বার ‘আত্মনির্ভর’ বললেই কিন্তু চীনের মোকাবিলা করা যায় না!