বাধা ও অসফলতার জন্য চিন্তা। মানসিক টানাপোড়েনের মধ্যে কোনও ভালো যোগাযোগ পেতে পারেন। ... বিশদ
গ্রামীণ পর্যটন
‘ভারতের গ্রামই হল ভারতের প্রাণ। এই গ্রামই ভারতাত্মা বাস করেন’—গ্রামীণ ভারত সম্পর্কে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর এই কথাটি মাইলস্টোন হয়ে আছে। বর্তমানে আমাদের জনসংখ্যার বাহাত্তর ভাগ মানুষই গ্রামে বাস করেন। স্বভাবতই গ্রামীণ পর্যটন এমনই এক সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র যা রুটি-রজির সংস্থানের পাশাপাশি গ্রাম-শহর বৈষম্য দূর করার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে। আন্তর্জাতিক স্তরে গ্রামীণ পর্যটন বহুদিন ধরেই স্বীকৃত। আমাদের দেশে এর পথ চলা শুরু বেশি দিনের নয়। নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময়ে এর যাত্রা শুরু। গত ২০১০ সালে আমাদের দেশের একশো ছেষট্টি গ্রামে গ্রামীণ পর্যটন শুরু হয়েছে। ইউরোপের দেশগুলোতে পঞ্চাশের দশকের শুরুতেই গ্রামীণ পর্যটনের সূচনা হয়। মূলত বৃহৎ কৃষিনির্ভর দেশ যেমন নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, ফ্রান্স, স্পেন, হল্যান্ড, ইংল্যান্ড, আমেরিকা, কানাডা, আর্জেন্টিনা, এবং দক্ষিণ আফ্রিকায় গ্রামীণ পর্যটন বিপুল জনপ্রিয়তা পায়। ফ্রান্সে চালু হয় কৃষি পর্যটন। বর্তমানে ফ্রান্সের কৃষকদের মধ্যে ২.৮ শতাংশ কৃষক গ্রামীণ পর্যটকদের কাছে পরিষেবা পৌঁছে দিচ্ছেন। আর আমাদের দেশের সর্বত্র কৃষকরা আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছেন। স্পেনে আশির দশকে কৃষি পর্যটন শুরু হয়। এখন সে দেশে গ্রামাঞ্চলে পর্যটকদের জন্য সাত হাজার গ্রামীণ রিসর্টে পঞ্চাশ হাজার পর্যটকের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। সমগ্র ইউরোপে দুই থেকে পাঁচ শতাংশ কৃষক প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে গ্রামীণ পর্যটনের সঙ্গে যুক্ত। লোকালের জয়গান গাওয়া নরেন্দ্র মোদি সত্যিই কি চান গ্রামীণ পর্যটনের হাত ধরে গ্রামীণ জীবনে উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের জোয়ার আসুক এবং গ্রামীণ সংস্কৃতির উত্তরণ ঘটুক।
গ্রামীণ পর্যটনের উদ্দেশ্য
ভারতের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বহু প্রাচীন হস্তশিল্পসহ নানান প্রথাগত শিল্পশৈলী ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে। উপযুক্ত পরিকল্পনার মাধ্যমে সেগুলির পুনরুদ্ধার ও পুনরুজ্জীবন সম্ভব। এজন্য স্থানীয় শিল্পীদের দক্ষতা বৃদ্ধির এক নিরন্তর প্রবহমান ধারা চালু রাখতে হবে। হস্তশিল্পীদের উৎপাদিত পণ্যের চাহিদা ও বাজার তৈরির ব্যবস্থা করতে হবে। এইভাবে লক্ষ লক্ষ শিল্পীর আর্থিক সমৃদ্ধির দিশা দেখানো যাবে। নয়ের দশকে কয়েকটি এনজিও-র সদস্যরা স্থানীয় কিছু উদ্যমী মানুষকে সঙ্গে নিয়ে এর সূচনা করেন। প্রকৃত অর্থেই জনগোষ্ঠীভিত্তিক সংগঠনই (কমিউনিটি বেসড অর্গানাইজেশন) ছিল এর প্রধান চালিকাশক্তি। স্বাধীনোত্তর কাল থেকে আজ পর্যন্ত আমাদের দেশে সর্বত্র চালু থাকা ‘টপ ডাউন অ্যাপ্রোচ’-এর একেবারে বিপরীতধর্মী ‘ডাউন টু টপ’ ধারাকে ভিত্তি করেই এগতে থাকে। এম আর মুরারকা রুরাল রিসার্চ ফাউন্ডেশন রাজস্থানের শেখাবতই অঞ্চলের গ্রামের মানুষদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে জৈবচাষে উৎসাহিত করে। একই সঙ্গে আতিথেয়তা শিল্পের প্রাথমিক পাঠও শেখাতে থাকে। এরপর ওই অঞ্চলের শিল্প-সংঙ্কৃতির নানান পসরা বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণের জন্য বিদেশে পাঠানো হয়। ধীরে ধীরে ভারতে গ্রামীণ পর্যটনের বিকাশের ক্ষেত্রে শেখাবতই একটা মডেল হয়ে ওঠে।
গ্রামীণ পর্যটনে প্রধানত পাঁচটি বিষয়ের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। সেগুলি হল কৃষি পর্যটন, ধর্মীয় পর্যটন, হেরিটেজ পর্যটন, প্রকৃতি পর্যটন এবং অ্যাডভেঞ্চার পর্যটন। বর্তমানে ভারতের বত্রিশটি বিখ্যাত গ্রামীণ পর্যটন ক্ষেত্রগুলির কয়েকটি হল রাজস্থানের জয়পুর জেলার সামোদ ও আলোয়ার জেলার নিমরানা, মেঘালয়ের মৌসিনরাম, তামিলনাডুর শিবগঙ্গা জেলার কারাইকুডি ও থুকুডি জেলার কাজঘুমালাই এবং ত্রিপুরার কমলানগর। আমাদের রাজ্যে সাতটি জায়গায় আমরা গ্রামীণ পর্যটন দেখতে পাই। বীরভূম জেলার শান্তিনিকেতন ও বল্লভপুরডাঙা এবং বাঁকুড়া জেলার মুকুটমণিপুর, সোনামুখী, পাঁচমুড়া, ছান্দার ও বিষ্ণুপুরের পোড়ামাটির হাট। এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক যে বাকি একুশটি জেলায় গ্রামীণ পর্যটনের তেমন প্রচার ও প্রসার ঘটেনি। মহারাষ্ট্র, কেরল ও মেঘালয় যেখানে গ্রামীণ পর্যটনে সফলকাম হয়ে সরকারি কোষাগারকে স্ফীত করছে তেমনটা কিন্তু আমাদের রাজ্যের ক্ষেত্রে চোখে পড়েনি।
গ্রামীণ পর্যটনের সমস্যা
গ্রামীণ পর্যটন শিল্পের সফল রূপদানের ক্ষেত্রে বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতাও আমরা দেখতে পাই। মূলত গ্রামীণ পরিকাঠামোর অপ্রতুলতা এবং গ্রামীণ পর্যটনের সুষ্ঠু বিপণন। তবে, এক্ষেত্রে আমাদের রাজ্যের প্রশংসা করতেই হয়। সারা দেশের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনার বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রথম স্থানে রয়েছে মুর্শিদাবাদ এবং দ্বিতীয় স্থানে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা। এই পরিকাঠামোকে হাতিয়ার করে গ্রামীণ ভারতের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, শিল্পকলা ও হস্তশিল্পগুলির উৎসস্থলগুলিকে অতি সহজেই পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত করা যেতে পারে। হরিয়ানা ও কেরল, গ্রামীণ পর্যটন শিল্পকে দেশের মধ্যে ও আন্তর্জাতিক বাজারে বিপণনের একটি সুপরিকল্পিত রূপরেখা তৈরির চেষ্টা করে যাচ্ছে।
গ্রামীণ পর্যটনের সম্ভাবনা
বণিকসভা ফিকি-র একটি সমীক্ষা থেকে জানা যাচ্ছে যে, ভারতে গ্রামীণ পর্যটনেই সর্বাধিক কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগের সম্ভাবনা রয়েছে। গ্রামীণ পর্যটন শিল্পে যদি দশ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয় তাহলে একেবারে শুরুর দিকে আটচল্লিশ জনের কর্মসংস্থান হবে। পরবর্তী পর্যায়ে আরও অতিরিক্ত সাতাত্তর জন মানুষ নিযুক্ত হবেন। এইভাবে সংখ্যাটা ক্রমশ বাড়বে। এছাড়াও অপ্রত্যক্ষভাবে যারা চিরায়ত হস্তশিল্প, কারুশিল্প ও মৃত্তিকা শিল্পের সঙ্গে যুক্ত তারাও রুটিরুজির সংস্থান করতে পারবেন। ভারত সরকারের পর্যটন মন্ত্রকের হিসাব অনুযায়ী, গ্রামীণ পর্যটনে কাজের অনুপাত ১:৩৬। ইউপিএ সরকারের ‘পর্যটন রোজগার যোজনা’-র লক্ষ্য ছিল, স্থানীয় পঞ্চায়েতকে সঙ্গে নিয়ে গ্রামীণ পর্যটনের বিকাশ সাধন। বর্তমানে এনডিএ-টু সরকারের ছাপান্ন ইঞ্চি ছাতিধারী একনায়কের যদি সদিচ্ছা থাকে তাহলে এই প্রকল্পটিকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। যেখান থেকে করোনার উৎপত্তি সেই চীনের দক্ষিণ পশ্চিম গুইঝোউ প্রদেশের ‘এথনিক ট্যুরিজম’ আশির দশকেই জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছয়। ভারত কি পারবে গ্রামীণ পর্যটনের ক্ষেত্রে অভিনব কোনও মডেলের জন্ম দিতে? স্বজন হারানো পরিবার কিংবা কাজ খুইয়ে কর্মহীন, ভাগ্যহীন নাগরিকদের জীবনে আবার সুখ-শান্তি-আনন্দ ফিরে আসবে কি? গ্রামীণ অর্থনীতির পুনুরুজ্জীবনের পাশাপাশি গ্রামীণ সংস্কৃতি নব নব রূপে পল্লবিত হবে। প্রায় সত্তর বছর ধরে অবহেলিত গ্রাম্য মানুষগুলো মাথা উঁচু করে প্রকৃত মানুষের মতো বাঁচার স্বাদ পাবেন। মানবেতর প্রাণীর মতো ধুঁকে ধুঁকে নিজেকে আর নিঃশেষ করা নয়, আমরা সবাই সেই সুদিনের আশায় রইলাম।
লেখক পেশায় কেরিয়ার কাউন্সেলর