বিদ্যার্থীরা পড়াশুনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা পাবে। নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস বাড়বে। অতিরিক্ত চিন্তার জন্য উচ্চ ... বিশদ
রামগড়ের পাহাড়ের কোলে নিজের ডেরায় রাগে ফুঁসছেন গব্বর সিং। হাতের লোহার বেল্টটা পাথুরে মাটিতে ঘষতে ঘষতে এদিক ওদিক করছেন। চোখ মুখ দিয়ে তাঁর রাগ উথলে পড়ছে। চারপাশে গব্বর সিংয়ের চ্যালা কালিয়া, সাম্ভারা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। একটু পরে গব্বর সিং বললেন, ‘হুম, সীমান্তে ওরা কতজন ছিল?’ কালিয়া ভয়ে মুখ কাঁচুমাচু করে বলল, ‘ওরা অনেকেই ছিল সর্দার। হাতে ওদের অনেক অস্ত্রশস্ত্রও ছিল।’
গব্বর সিং আবার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আমাদের কতজন ছিল?’
সাম্ভা বলল, ‘আমাদেরও অনেকে ছিল সর্দার।’
‘তাহলে এমন হল কেন?’ গব্বরের হুঙ্কারে পাহাড় প্রকম্পিত হল। সবাই কেঁপে উঠল। পাখিরা ডানা ঝাপটিয়ে উড়ে গেল। সবাই চুপ। গব্বর তাঁর ঘনিষ্ঠতম সাঙাতের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ওরে অ মিত্র, একবার সবাইকে আমার ছাপ্পান্ন ইঞ্চি ছাতির গল্পটা বলে দে তো! সারা বিশ্বে আমার মান্যতা কেমন, সেটা সবাইকে বলে দে ভালো করে! সারা বিশ্ব আমার সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। এখান থেকে হাজার হাজার মাইল দূরেও বাচ্চারা ঘুমনোর সময় মায়ের কাছে আবদার করে বলে, মাগো, গব্বর সিংয়ের সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের গল্প বল না। আর তোরা কিনা, আমার নাম কলঙ্কিত করে এলি। রামগড়ের লোকেরা কতসব নিন্দামন্দ করছে, শুনতে পাচ্ছিস না?’
হাতের বেল্টটা তুলে গব্বর পাথরের উপর আছাড় মারলেন। সেই ধাতব ঝনঝন শব্দে সবাই কেঁপে উঠল। এবার তিনি হাতের পিস্তলটা নিয়ে মাথার উপর ঘোরাতে লাগলেন। একটা ব্ল্যাঙ্ক ফায়ারও করলেন, ঢিচক্যাঁও! সীমান্তকর্তারা বললেন, ‘আপনি নির্দেশ দিন সর্দার, আমরা সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ি।’ একথা শুনে হা হা হা করে হেসে উঠলেন গব্বর। অনেকক্ষণ ধরে শরীর কাঁপিয়ে হাসতে হাসতে বললেন, ‘ঝাঁপিয়ে পড়ার দরকার নেই। কৌশলগত অবস্থান আমাদের নিতে হবে। আমরা সবাই সীমান্ত দেশকে ইতিমধ্যেই যোগ্য জবাব দিয়েছি। এখন শুধু হুঙ্কারে খেলতে হবে।’
এক সীমান্ত কর্তা ভয়ে ভয়ে বললেন, ‘সর্দার রামগড়ের মানুষ চাইছে, আমরা ঝাঁপিয়ে পড়ি। ওদিকের সীমান্ত দেশকে যেমন মুখতোড় জবাব দিই, দুরমুশ করি, এবার এদিকের সীমান্ত দেশকেও বুঝিয়ে দিই, আমরা কতটা শক্তিধর। ওরা ক্রমেই এই রামগড়ের ভিতরে ঢুকে পড়ছে। গব্বর সিংয়ের নাম আমরা মাটির সঙ্গে মিশিয়ে যেতে দেব না।’
গব্বর হাতের তালুতে খৈনি ঢেলে ডলতে ডলতে বললেন, ‘ওরে পাগল, দুই সীমান্ত দেশ এক নয়। এটা বুঝতে হবে। প্রতিবেশী দেশগুলো গরম হয়ে আছে। বেশি কিছু দেখাতে গেলে সেই গরমে হাত পুড়বে। এই যে আমি গর্জন করলাম, তোদের দেখতে হবে কাল মিডিয়ায় যেন আমার এই গর্জনটা ঠিকমতো বের হয়, নাহলে মানুষ ভুল বুঝবে। এর আগে তালিবাজি, থালাবাজি নিয়ে গব্বর কা নাম রওশন নেহি হুয়া। আমাদের আরও অস্ত্র কিনতে হবে। হীরাকে খবর দাও। বলো আমাদের অনেক অস্ত্র লাগবে। নতুন করে ওর সঙ্গে আর্মস ডিল করতে হবে। যাও প্রেসকে জানাও।’
একজন চ্যালা বললেন, ‘আপনি যা বললেন, সর্দার সেটাই হবে। আপনি তো পিরেস কনফারেন্স করবেন না। তাই আপনার বার্তা আমাদের মিডিয়া সেল রামগড়ের সব কাগজ আর টিভিতে পৌঁছে দিচ্ছে।’
গব্বর বললেন, ‘সব যেন ঠিকঠাক হয়।’
সেই চ্যালা বললেন, ‘সর্দার আপনার নিমক খেয়েছি।’
গব্বর বললেন, ‘উল্টোপাল্টা হলে কচুপোড়া খাওয়াব।’
আর একজন সীমান্ত কর্তা বললেন, ‘সর্দার, ওরা যে আমাদের রামগড় এলাকায় অনেকটা ঢুকে বসে আছে। সেটার কী হবে?’
গব্বর বললেন, ‘ওদের আসলে পর্যটক বলে ভাবতে শেখো। পর্যটক হল আমাদের আত্মীয়ের মতো। ওই যে, কী যেন একটা বলে....!’
ওদিক থেকে মিত্র বললেন, ‘বসুধৈব কুটুম্বকম। সারা বিশ্ব আমাদের আত্মীয়।’
গব্বর বললেন, ‘ঠিক। সবাইকে আত্মীয় বানাতে হবে।’
সীমান্ত কর্তা বললেন, ‘সর্দার ওরা সীমান্তের ভিতরে কাঠামো বানিয়ে ফেলেছে। তাহলে এখন আমাদের কী কাজ হবে সর্দার?’
গব্বর বললেন, ‘সীমান্ত ডিঙিয়ে আসা সেনার বেশধারী ওই পর্যটকদের গতিবিধির উপর লক্ষ্য রাখ। ভেবে দেখে, ওদের ওইখানে পেয়িং গেস্ট হিসাবে রাখা যায় কিনা! যদি সম্ভব হয়, তাহলে তো নৈতিকভাবে জায়গাটা আমাদেরই রইল। আমি পরে দেশ সফরে বেরিয়ে রাষ্ট্রনায়কদের সঙ্গে দোলায় দুলে দুলে একটা কিছু সমাধান বের করব। আর ওসব নিয়ে না ভেবে তোমরা দেশের উন্নয়ন ও প্রগতির দিকে নজর দাও।’
একজন বললেন, ‘আপনি হলেন প্রগতির রামচন্দ্র, উন্নয়নের জগন্নাথ।’
গব্বর একটু গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘জগন্নাথ বলে তুমি কি আমাকে রামগড়ের মানুষের মতো ঠুঁটো বলে ঠেস মারলে?’
সেই চ্যালা নিজের কান মুলে বলল, ‘কীযে বলেন সর্দার! জগন্নাথ যেমন রথ নিয়ে মাসির বাড়ি যায়, আপনি তেমন রথ ছুটিয়ে রামগড়কে নিয়ে যাচ্ছেন উন্নয়নের পথে। সেই মন্ত্রটা জানেন তো সর্দার? জগন্নাথ স্বামী, উন্নয়নপথগামী।’
চারিদিকে সাধু সাধু রব উঠল। গব্বর বললেন, ‘আমি একটা প্ল্যান করেছি। সবাই শুনে রাখ। শত্রুদেশ থেকে আমরা আর মাটির হাঁড়ি, ভুট্টা, খেজুর রস, ঝিঙে, চিচিঙ্গে, চাউমিন ইত্যাদি রামগড়ে ঢুকতে দেব না। ওদের দেশের জিনিস ব্যান করলাম। ওদের এভাবেই জবাব দেব। ওদের আর কী কী জিনিস আমরা ঢুকতে দেব না, মিত্র তার একটা তালিকা তৈরি করে দেবে।’
সর্দারের কথা শুনে সকলে হাতাতলি দিয়ে উঠল। গব্বর বললেন, ‘আর একটা কথা সবাইকে মাথায় রাখতে হবে। এই দেশটাকে আমি এক নম্বর করে তুলব। সেটাই আমার টার্গেট। তোমরা সবাই রামগড়ে প্রত্যেকের ঘরে ঘরে যাও। ওদের মধ্যে দূরত্ব গড়ে তোল। সামাজিক দূরত্ব, আন্তরিক দূরত্ব। ধর্মের ভিত্তিতে জনসংখ্যা বানাও, বড় বড় মূর্তি বানাও। রামগড়ের আদর্শ হলেন রাম। যাও সবাই। ওদের বুঝিয়ে দাও, গব্বর সিংয়ের বিকল্প কেউ নেই। যদি থাকে, সে হল খুদ গব্বর। মনে রেখো যো ডর গয়া, উও মর গয়া। ভোট কব হ্যায়, কব হ্যায় ভোট?’
দৃশ্য ২
কালিয়া, সাম্ভা সহ গব্বর চ্যালারা রামগড়ের গ্রামে গ্রামে গিয়ে জনসংখ্যাপঞ্জির কাজ শুরু করে দিল। এতে দেশে অশান্তির বাতাবরণ তৈরি হল। বাধা দিতে এগিয়ে এলেন জয়, বীরু, বাসন্তী ও ঠাকুর বলদেব সিং সহ রামগড়ের বাসিন্দারা। জয় আর বীরু একসঙ্গে লড়াই করতে লাগলেন। ধর্নায় বসে অনশনও করলেন। একদিন রাতের অন্ধকারে গব্বর চ্যালাদের হানায় জয়ের মৃত্যু হল। কান্নায় ভেঙে পড়লেন বীরু। ঠাকুর সাব বললেন, ‘জয় ছিল দেশের বিজয় বা উন্নতির প্রতীক। জয়ের মৃত্যু মানে উন্নয়ন থমকে যাওয়া। গব্বর সিং সরকার এদেশের কিছু করতে পারবে না। ওরা দেশটাকে গোল্লায় নিয়ে যাচ্ছে। গব্বর বলেছে, দেশটাকে এক নম্বরে নিয়ে যাবে। এই দেশ এক নম্বর হবে হিংসায়, বিদ্বেষে, শিল্প-অর্থনীতির ভরাডুবিতে, শাসকের ব্যর্থতায় আর অমানবিকতায়। এই কষ্ট আর মানুষের অভাবের দিনে গব্বর দেশের কোনও কাজেই লাগবে না। বীরু, তুমি জেগে ওঠো। বীরু মানে হল বীরত্ব। আর বাসন্তী মানে হল সৌন্দর্য। বীরত্ব আর সৌন্দর্য, পুরুষ আর প্রকৃতি একসঙ্গে হাত ধরে সংগ্রমের পথে গেলে জয় আবার ফিরে আসবে।’
বীরু উঠে দাঁড়িয়ে চোখ মুছে বাসন্তীর হাত ধরে বললেন, ‘ঠিক বলেছেন ঠাকুরসাব। আপনি হলেন মানুষের মনের বিশ্বাস, শপথ। মানুষ কখনও ভেঙে পড়ে না। ভাঙার মধ্য থেকেই সে গড়ার স্বপ্ন দেখে। আপনি হলেন সেই স্বপ্ন। ওরা আপনার হাত দুটো কেটে নিয়ে ভেবেছিল মানুষের স্বপ্ন ভেঙে চুরমার করে দেবে। মানুষকে ভেড়া বানিয়ে তুলবে। তা ওরা পারেনি।’
ঠাকুরসাব বললেন, ‘সবকিছু মরে যায়, স্বপ্নটা মরে না।’
বাসন্তী বললেন, ‘চল বীরু, অনেক কাজ বাকি আছে আমাদের। ঠাকুরসাবের স্বপ্নই হল রামগড়ের প্রতিটা মানুষের স্বপ্ন।’
বীরু বাসন্তীর হাত ধরে গর্জন করে উঠলেন, ‘গব্বর, আমি এই লড়াইয়ে নামলাম। আমরা সবাই মিলে চুন চুন করে তোমার সব ব্যর্থতা চুরমার করে আবার দেশকে জয়ের পথে নিয়ে যাব। রামগড় আবার জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে।’
ঠাকুরসাব বললেন, কাশীরাম, অনেক হয়েছে। আর ওদের জন্য কোনও সমবেদনা নেই। ওদের ফাঁদে আমরা আর পা দেব না। গব্বর চ্যালারা এবার তোমরা যাও, গিয়ে তোমার সর্দারকে বলে দিও, রামগড়কে উচ্ছন্নে নিয়ে যাওয়া কোনও নেতাকে সাধারণ মানুষ আর পরোয়া করবে না। তোমাদের অনেক আশায় ভোট দিয়েছিলাম। কিন্তু তোমরা ব্যর্থ। মানুষের জীবন বেহাল করে দিয়েছো। আর কোনওদিন রামগড়ের মানুষ গব্বরকে একটি ভোটও দেবে না।’
গব্বর চ্যালারা বললেন, ভালো করে ভেবে দেখুন ঠাকুর। এসব কথা সর্দারের কানে গেলে তার ফল ভালো হবে না।’
ঠাকুরসাব বললেন, ‘চলে যাও তোমরা।’
গব্বর চ্যালারা মাথা নিচু করে ঘোড়ায় চড়ে সেখান থেকে চলে যায়। ব্যাকগ্রাউন্ডে গান বাজে, ‘সব কিছু মরে যায়, স্বপ্নটা মরে না।’