রাজনীতিক ও পেশাদারদের ব্যস্ততা বাড়বে। বয়স্করা শরীর স্বাস্থ্যের প্রতি যত্ন নিন। ধনযোগ আছে। ... বিশদ
গরিব মানুষ অত শত বোঝেন না, শুধু শূন্যদূষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকেন আর ঘন ঘন দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। তবে আশার খবর, এরাজ্যে প্রান্তিক মানুষের সঙ্কট মোচনে মোদিজি সাড়া না দিলেও এগিয়ে এসেছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শুক্রবারই নবান্নে তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, বেসরকারি বাস যাতে রাস্তায় কমে না যায় তার জন্য তাঁর সরকার বাস পিছু ১৫ হাজার টাকা দেবে। এককথায় নজিরবিহীন পদক্ষেপ। এই সিদ্ধান্তে একদিকে যেমন বাসের ভাড়া এই কঠিন সময়ে বাড়বে না, তেমনি যে হাজার হাজার কন্ডাকটর ও ড্রাইভার কাজ হারিয়ে বসে যাওয়ার ভয় পাচ্ছিলেন, তাঁদের রুটিরুজির সমস্যাও অনেকটাই মিটবে। আগামী তিন মাস এই প্যাকেজ দেবে মমতার সরকার। নিঃসন্দেহে সীমিত আর্থিক ক্ষমতার মধ্যে তৃণমূল সরকারের এই উদ্যোগ অভূতপূর্ব। একদিকে মমতা বলছেন, সাধারণ মানুষের স্বার্থে কোনও অবস্থাতেই বাসের ভাড়া বাড়াতে দেব না, আবার বাস মালিকদের লোকসান মেটাতে ১৫ হাজার টাকাও দেওয়া হচ্ছে। বিরোধীদের প্রশ্ন করি, ভূভারতে কোনও রাজ্য সরকারের এমন মানবিক পদক্ষেপের নজির আর আছে কি? বিশেষ করে যখন দিল্লির কাছে থেকেই ৫৬ হাজার কোটি টাকা পাওনা মেলেনি। হঠাৎ ঘূর্ণিঝড়ে অন্তত ৯টি জেলা তছনছ হয়ে গিয়েছে। সেখানেও ত্রাণ ও পুনর্বাসনে ৬৩০০ কোটি টাকা খরচ করেছে রাজ্য। এতকিছুর পরও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে কার্পণ্য করেননি মুখ্যমন্ত্রী।
এরই ঠিক উল্টো পিঠে গোটা দেশ তেলের দাম বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত থেকে কেন্দ্রকে বারে বারে সরে আসতে বললেও কোনও কাজ হচ্ছে না। এর থেকেই কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্যটা জলের মতো পরিষ্কার হয়ে যায়। অভিধানে জনমুখী ও জনবিরোধী বলে দু’টো শব্দ আছে। অত্যন্ত বহুল ব্যবহৃত জনপ্রিয় শব্দ। মানুষ নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই বেছে বেছে শব্দ দু’টিকে ব্যবহার করে এবং কে জনগণের ভালোর জন্য কাজ করছে আর কে মানুষকে বেছে বেছে বিপদে ফেলছে, তা বুঝে নিয়েই গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করে, ইতিহাসই বারে বারে তার সাক্ষী!
গত ১ জুন থেকে শুরু করে আনলক পর্বের প্রথম একমাসও প্রায় কাটল বলে। কিন্তু ভয়ঙ্কর ছোঁয়াচে করোনার আতঙ্ক যেমন কমেনি, তেমনি লকডাউনের ক্ষত সামলে স্বাভাবিক হয়নি জীবনযাপনও। আর এখন তো দৈনিক সংক্রমণ ১৮ হাজার ছাড়াচ্ছে। তাই স্বভাবতই ভয়টাও আরও তীব্র। এই আকাল আর কতদিন চলবে তা বলতে পারছেন না বড় বড় বিশেষজ্ঞরাও। যেদিকেই তাকানো যায় শুধু মন্দা আর সব হারানোর হতাশা। একান্ত আপনজন মারা গেলেও শোক তাপ নয়। মানুষটা কেমন ছিল তা নিয়ে আলোচনা নয়। প্রথম প্রশ্ন—কী রে, সমীরদার করোনা ছিল না তো? এমন নির্মম ভয়ঙ্কর সত্যের মুখোমুখি আমরা জীবনে হইনি কখনও।
ব্যবসা কমেছে, বিক্রি কমেছে, উৎপাদন কমেছে, সুদ কমেছে, আয় কমেছে, চাকরি কমেছে। সিবিএসই দশম ও দ্বাদশের পরীক্ষা পর্যন্ত সম্পূর্ণ করতে পারল না। ফল কবে তা নিয়েও ধোঁয়াশার শেষ নেই। জিডিপি মানে দেশের অর্থনীতির পালস রেট তাও লাফিয়ে ছুটছে শূন্যের নীচের দিকে। মানুষের আশা ভরসা একটু খুশির ঝিলিক তাও কবেই যেন উধাও। কিন্তু পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে শুধু তেলের দাম। তবে নিন্দুকেরা যাই বলুন এর মধ্যেই আত্মনির্ভর ভারত গড়ার উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন দেশের নেতা নরেন্দ্র মোদি। কিন্তু কেমন করে হব আত্মনির্ভর? চাকরি তো নেই। ব্যবসার অবস্থাও তথৈবচ! বাজার এতটাই খারাপ যে ঋণ নিয়ে শোধ দিতেই পারব না। এই অবস্থায় একটাই সহজ রাস্তা আছে, রোজ বিকেল বিকেল বেশি করে পেট্রল ও ডিজেল কিনে পরের দিন সকালে লিটারে ৪০ থেকে ৫০ পয়সা লাভে বিক্রি করে দেওয়া! দ্রুত নিজের পায়ে দাঁড়ানোর এটাই এখন একমাত্র উপায়। মানুষের জন্য সরকারের যখন কোনও হেলদোলই নেই, সেখানে এ ছাড়া আর পথ কী? আর এই ইস্যুতেই আচমকাই তেতে উঠেছে জ্বালানি তেলের রাজনীতি। যখন আর্ন্তজাতিক বাজারে তেলের দাম তলানিতে তখন একতরফা পেট্রল ও ডিজেলের এই মূল্যবৃদ্ধি ঘিরে দেশজুড়ে তৈরি হয়েছে তীব্র অসন্তোষ।
শেষবার পেট্রল ও ডিজেলের দাম কমেছিল গত ১৬ মার্চ, লকডাউনের আগে। তারপর গোটা এপ্রিল ও মে মাসে আর তেলের দামে হাত দেওয়ার মতো অবস্থা ছিল না, তাই দাম অপরিবর্তিতই ছিল। গোটা দেশ কার্যত স্তব্ধ হয়ে যাওয়ায়, কাজকর্ম শিকেয় ওঠায় তেলের চাহিদাও তলানিতে গিয়ে ঠেকেছিল। জুনে আনলক পর্ব শুরু হতেই ৮২ দিন পর দাম বাড়ানো শুরু হয়। প্রথম দাম বাড়ে ৭ জুন। তারপর থেকেই লাগাতার বেড়েই চলেছে। সব মিলিয়ে এখনও পর্যন্ত দাম বেড়েছে ৯ টাকার আশপাশে। কিন্তু এই মুহূর্তে প্রশ্ন একটাই, কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিতে টানা এই মূল্যবৃদ্ধি কি খুব অনিবার্য ছিল? কে না জানে, তেলের দাম বৃদ্ধির নিট রেজাল্ট বাকি সব জিনিসেরও দামের ঊর্ধ্বগতি ও সাধারণকে আরও একটু অসুবিধায় ফেলা।
ফিরে যাই ছ’বছর আগে ২০১৪ সালের মে মাসে। ‘দুর্বল’ ছোট সঙ্কুচিত বুকের ছাতির মনমোহন সিং সরকারকে ভোটে হারিয়ে বীরবিক্রমে নরেন্দ্র মোদি যেদিন দেশের প্রধানমন্ত্রী হন, সেদিন দেশের মানুষের প্রত্যাশার শেষ ছিল না। দারিদ্র্য থেকে দুর্নীতিদমন, কর্মসংস্থান থেকে শিল্প বিনিয়োগ বৃদ্ধি, বিদেশ থেকে কালো টাকা ফেরানো, সবার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ১৫ লক্ষ টাকা দেওয়া, বছরে দু’লাখ চাকরি, সব কিছুতেই একটা নতুন জোয়ার আসার স্বপ্নে মশগুল ছিল দেশের মানুষ। ইন্দিরা গান্ধীর পর আবার একজন জবরদস্ত সাহসী প্রধানমন্ত্রী পেয়েছে দেশ—এই চর্চাতেই মুখর ছিল সব মহল। এই মানুষটাই চীন-পাকিস্তান সবাইকে উচিত শিক্ষা দিতে পারবেন, কেউ আর ভারতের দিকে চোখ তুলে তাকাবার সাহস পাবে না, এমন প্রচারও ছিল ষোলো আনা।
কিন্তু আজ নিরীহ নেপালও গলা তুলছে। চোখ রাঙাচ্ছে। এভাবেই ৬ বছর পেরিয়ে এসে আজ ধীরে ধীরে সেই স্বপ্নটা ধাক্কা খেয়েছে। বিশ্বাসেও যে একটা চিড় ধরেছে, সেকথা বললে বোধহয় মোটেই বাড়াবাড়ি হবে না। মোদিজির শপথ নেওয়ার সময় আর্ন্তজাতিক বাজারে অশোধিত তেলের দাম ঘোরাফেরা করছিল ৮৫ থেকে ১০৭ ডলারের আশপাশে। আর আজ আর্ন্তজাতিক বাজারে অশোধিত তেলের দাম ৪০ ডলারের আশেপাশে। দেশীয় বাজারে দাম কিন্তু তাতে কমেনি। মে মাসে বিশ্বজুড়ে চাহিদা কমে যাওয়ায় অশোধিত তেলের দাম ছিল আরও কম। কিন্তু সেই দাম কমার কোনও সুফল তো সাধারণের ঘরে পৌঁছয়নি। উল্টে দাম অনেকটা বেড়েছে। করোনা যন্ত্রণার মধ্যেই সাধারণের দুর্ভোগ বাড়িয়েছে মোদি সরকারের বিস্ময়কর সংকীর্ণ রাজনীতি। যেই দাম কমার একটু আশা জাগছে অমনি শুল্ক বাড়িয়ে দামের সমতা রক্ষায় নামছে কেন্দ্র।
এমনিতে একটা হিসেব বলছে, আর্ন্তজাতিক বাজারে অশোধিত তেলের দাম ব্যারেল পিছু ১ ডলার কমা মানে সরকারের দেড় বিলিয়ন ডলার সাশ্রয়। অঙ্কটা মোটেই কম নয়। সরকার বাহাদুর নাকি চলতি আর্থিক বছরে এভাবে প্রায় ৪৫ বিলিয়ন ডলার সাশ্রয়ের পরিকল্পনা করেছে। অথচ সেই সাশ্রয়ের ছিটেফোঁটাও জুটবে না আমাদের ভাগ্যে। খোদ রাজধানী দিল্লিতে ডিজেলের দাম পেট্রলের চেয়ে বেশি হয়েছে! আর আজ শহর কলকাতাতেও পেট্রলের লিটার ৮০ টাকার বেশি। অথচ , ২০১৪-র মে মাসে মোদি সরকারের অভিষেকের সময় দিল্লিতে পেট্রল ডিজেলের দাম ছিল লিটার পিছু যথাক্রমে ৭১ টাকা ৪১ পয়সা ও ৫৬ টাকা ৭১ পয়সা। আর আজ তেলের দাম বেড়ে কোথায়?
এ এক ভয়ঙ্কর প্রবণতা। কংগ্রেস আমলের তুলনায় এভাবেই মোদি জমানায় পেট্রল-ডিজেলে শুল্ক বেড়েছে কয়েকগুণ। কিন্তু এই উদ্বৃত্ত অর্থ দিয়ে কেন্দ্র করবে কী—এটাই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। বলা হচ্ছে, এভাবে বিশাল আর্থিক ঘাটতি মেটানোরই চেষ্টা করছে সরকার। করোনার এই কঠিন সময়ে যখন সমস্ত চিরাচরিত হিসেবই উল্টে গিয়েছে, মানুষ যখন নিজের দু’বেলা অন্নের সংস্থান করতেই হিমশিম খাচ্ছে, তখন ধাপে ধাপে পেট্রল ডিজেলের থেকে আয় বাড়ানোর এই কৌশল থেকে মোদি সরকারের আখেরে কতটা লাভ হয় সেটাই এখন দেখার। নিন্দুকেরা আবার বলছে ভোটের আগে বিলি করার জন্য, জনমোহিনী ঘোষণার জন্য তহবিল তৈরির কাজ চলছে সুকৌশলে। কারণ ইতিমধ্যেই ২০ লক্ষ কোটি টাকার প্যাকেজের কোনও সুবিধা দেশের আম জনতা পায়নি। অসন্তোষ রোজ বাড়ছে। তাই বড় কোনও ঘোষণার প্রস্তুতি নিচ্ছে কেন্দ্র। কিন্তু তা বলে তেলের দাম বৃদ্ধির সর্বনাশা পথে কোষাগার ভরা মানে তো দুঃসময়ে ঘুরিয়ে সবার পকেটেই গোপন হাতের অনুপ্রবেশ। এই জনবিরোধী প্রচেষ্টাকে কোনওভাবেই সমর্থন করা যায় না। মোদি সরকারকে অবিলম্বে গরিব মানুষের স্বার্থে এই লাগাতার মূল্যবৃদ্ধির খেলা বন্ধ করতেই হবে।