বাধা ও অসফলতার জন্য চিন্তা। মানসিক টানাপোড়েনের মধ্যে কোনও ভালো যোগাযোগ পেতে পারেন। ... বিশদ
সফলভাবে করোনা ভাইরাসকে আটকে দেওয়া মহিলা রাষ্ট্রপ্রধানদের সঙ্গে এই নেতাদের সবথেকে বড় যে পার্থক্যটি চোখে পড়েছে, সেটি হল, পরামর্শ গ্রহণের প্রক্রিয়া। অর্থাৎ কনসাল্টেশন। মহিলা রাষ্ট্রপ্রধানরা প্রায় প্রত্যেকেই এক্সপার্ট গ্রুপ, বিশেষজ্ঞ মেডিকেল প্রফেশনাল, বিজ্ঞানীদের প্যানেল এবং অন্য সফল দেশের ম্যানেজমেন্টকে দ্রুত প্রয়োগ করেছেন। অন্যদিকে, শক্তিশালী হিসেবে পরিগণিত দক্ষিণপন্থী রাষ্ট্রপ্রধানদের দেখা গিয়েছে প্রধানত নিজেদের ব্যক্তিগত যে অ্যাডভাইসর গোষ্ঠী অথবা পছন্দসই বিশেষজ্ঞ প্যানেল, তাঁদের কথাই অনুসরণ করেছেন। ডিসিশন এবং কাউন্টার ডিসিশন পদ্ধতি মানা হয়নি। ফলে এই তাবৎ দেশগুলিতে করোনা নিয়ে লাগাতার বিভ্রান্তি এবং পরস্পর-বিরোধী মতামত ছড়িয়ে পড়েছে। মার্চ মাসে বলা হয়েছে, একটি পথের কথা। এপ্রিল মাসে বলা হয়েছে, অন্য ফরমুলা। ক্রমাগত পরিবর্তিত মডেলের জেরে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। দ্রুত ছড়িয়েছে সংক্রমণ। গোটা বিশ্বের মিডিয়া, রাজনীতি, সমাজতত্ত্ব, জেন্ডার অ্যানালিস্টের মধ্যে আপাতত জোরদার আলোচনা চলছে, কেন তথাকথিত শক্তিশালী এবং একক ক্যারিশমাসম্পন্ন রাষ্ট্রনেতারা ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট অপারদর্শী? লেখা হচ্ছে থিসিস। সংবাদমাধ্যমে চলছে সেমিনার, বিতর্ক, নিবন্ধ রচনা।
স্ক্যান্ডিনিভিয়া রাষ্ট্র হিসেবে যাদের বলা হয়, সেখানে একটি তাৎপর্যপূর্ণ প্রবণতা দেখা গেল। পাশাপাশি দেশ। সুইডেনে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ও মৃত্যু উদ্বেগজনকভাবে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেল। অথচ ফিনল্যান্ড, ডেনমার্ক, নরওয়ে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হল ভাইরাসের সংক্রমণকে। এই তিন রাষ্ট্রই মহিলা প্রশাসক দ্বারা পরিচালিত। ফিনল্যান্ডের সানা মারিনের বয়স মাত্র ৩৪ বছর। এবং মাত্র ৬ মাস আগে তিনি প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। মার্চ থেকে মে দেড় মাসের মধ্যেই এই দেশের করোনা প্রায় নিয়ন্ত্রণে। আবার সব স্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে।
জার্মানির কাছের দেশগুলি তীব্র আতঙ্কে ভুগছে। ইতালি, স্পেন, ব্রিটেন, বেলজিয়াম। অথচ জার্মানির মহিলা চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মার্কেল একাই আটকে দিয়েছেন করোনার ভয়াবহতাকে। তিনি লজ্জা পাননি দক্ষিণ কোরিয়া মডেল ফলো করতে। মার্কেল নিজেও বিজ্ঞানী। অনেক কম মৃত্যু তাঁর দেশে। ক্যাটরিন জ্যাকবসদোত্তির আইসল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী। তিনি মার্চ মাসের শুরুতেই ডিকোড জেনেটিকস নামক একটি বায়োফার্মা সংস্থার সঙ্গে সরকারের চুক্তি সম্পাদন করে ফেলেন। এবং ২৪ ঘণ্টা পর থেকেই শুরু হয় ঘরে ঘরে করোনা টেস্টিং। আইসল্যান্ডের সাফল্য কী? ইউরোপের মধ্যে সবথেকে কম মৃত্যুহার এই দেশে। ডেনমার্কের মহিলা প্রধানমন্ত্রী মিট ফ্রেডেরিকসনকে লকডাউনের রোলমডেল বলা হচ্ছে। কারণ, তিনি এক মূহূর্ত সময় নষ্ট করেনি। সবার আগে দেশে লকডাউন ঘোষণা করেছিলেন। আর ঘোষণা করেন ইউনিভার্সাল টেস্টিং। চীন থেকে সবথেকে আগে টেস্টিং কিট অর্ডার করে ডেনমার্ক।
তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট সাই ইং ওয়েন একটি তাৎক্ষণিক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সেটি হল, এয়ারপোর্টে নামলেই মোবাইল ফোন হ্যান্ডওভার করে দিতে হবে সিকিউরিটি এজেন্টদের। সেই ফোনের জিপিএস সিস্টেম ট্র্যাক করে দেখা হচ্ছিল ওই প্যাসেঞ্জার কবে কোথায় ছিলেন। ঠিক সেই লোকেশন ট্রেস করে করে প্যাসেঞ্জারদের কোয়ারিন্টাইনে পাঠানো হয়েছিল। যাতে এয়ারপোর্ট থেকে তাঁরা শহরে ঢুকতেই না পারেন। সাই ইং ওয়েন সরকারের সেই সিদ্ধান্ত অনেক পর অন্য ‘শক্তিশালী’ নেতাদের দেশ অনুকরণ করেছে। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে।
নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিনা আর্ডেনকে দেখা গিয়েছিল, মাঝেমধ্যেই নিজের মোবাইল থেকে একটা ক্যাজুয়াল সোয়েট শার্ট পরে নিজের বাচ্চাকে কোলে নিয়ে ফেসবুক লাইভ টেলিকাস্ট করছেন। কোনও প্রোটোকলের মধ্যেই যাননি তিনি। প্রতিদিন তিনি এই লাইভ করে সরকারের প্রতিটি সিদ্ধান্ত জানাতেন দেশবাসীকে। ফেব্রুয়ারি থেকে আর্ডেন কোয়ারিন্টাইন শুরু করেছেন। নিউজিল্যান্ডে মৃত্যুর সংখ্যা কত? মাত্র ১৮। গোটা বিশ্ব তাঁকে বাহবা দিচ্ছে। নরওয়ের প্রধানমন্ত্রী এরনা সোলবার্গ নিয়েছেন একটি আশ্চর্য সিদ্ধান্ত। সব রাষ্ট্রপ্রধানরা যেমন বিশেষজ্ঞ অথবা চিকিৎসক ও বিজ্ঞানীদের সঙ্গে পরামর্শ করেন, প্রত্যেকের মতামত নিয়ে অগ্রসর হয়েছেন, নরওয়ের প্রধানমন্ত্রী এরনা সোলবার্গ এসবের সঙ্গে আরও একটি কাজ করেছেন। সেটি হল, তিনি টিন এজারদের মতামত নিয়েছেন। ১০ বছরের কমবয়সি বাচ্চাদের ‘কী করতে ইচ্ছে করছে’,তাদের কী কী প্রবলেম হচ্ছে এসব জানতে চেয়েছেন সরকারিভাবে। প্রধানমন্ত্রী দু’টি প্রেস কনফারেন্স করেছেন, যেখানে অ্যাডাল্ট সাংবাদিকদের প্রবেশ নিষেধ। শুধুই ১৮ বছরের কম বয়সি নাগরিক স্কুলপড়ুয়াদের ডাকা হয়েছিল সেই প্রশ্নোত্তরে। তাদের বলা হয়েছিল, যা সরকারের থেকে জানতে ইচ্ছা হবে অথবা ক্ষোভ প্রকাশ করতে হবে, সেটা প্রধানমন্ত্রীকে সরাসরি বলতে।
এই প্রবণতার পাশাপাশি ট্রাম্প, জি জিনপিং, বরিস জনসন, পুতিন, নরেন্দ্র মোদি, বোলসোনারোর মতো তথাকথিত ক্যারিশম্যাটিক এবং প্রবল শক্তিধর ইমেজসম্পন্ন নেতারা তাঁদের দেশের সংক্রমণকে কেন নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেন না সময়মতো? একটা কমন ফ্যাক্টর হল, এই প্রতিটি রাষ্ট্র দেরি করে রেসপন্স করেছে। অন্য দেশগুলির তুলনায় এই রাষ্ট্রগুলিতে জনসংখ্যা বেশি। সুতরাং অনেক আগে থেকেই সচেতনতা দেখানো উচিত ছিল। কিন্তু এঁরা প্রত্যেকেই আগে থেকে হিসেব কষতে শুরু করেছেন কী করা হলে তাঁর নিজের সাফল্য প্রতিষ্ঠা পাবে। বর্তমান পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের এই নেতাদের মধ্যে সাদৃশ্য হল, এঁরা সকলেই প্রায় একক পার্সোনালিটির ভাবমূর্তিতে বিশ্বাসী। দেশের যে কোনও অ্যাচিভমেন্টকে নিজেদের সফলতা হিসেবে বিবেচনা করেন এবং প্রচারও করেন। আর ব্যর্থতা হলেই বিরোধীদের দিকে অথবা অতীতের অন্য সরকারের ভুল নীতিকে দোষারোপ করেন। এই নেতারা সকলেই প্রায় নিজেদের দলকে গ্রাস করে ফেলেছেন ব্যক্তিগত ইমেজকে দিয়ে। আমেরিকার রিপাবলিকান পার্টি অথবা ভারতের বিজেপির একটি নিজস্ব অস্তিত্ব এবং পরিচিতি ছিল। কিন্তু ক্রমেই এই দলগুলি হয়ে গিয়েছে ট্রাম্পের পার্টি অথবা মোদির দল। ব্রিটেনে বরিস জনসন ক্ষমতায় এসেছেন ব্রেক্সিটকে সমর্থনের জেরে। তাঁরা সকলেই দেশে প্রবল জনপ্রিয়। বিপুল সমর্থন নিয়েই ভোটে জয়ী হয়েছেন। আগামীদিনেও হয়তা জয়ী হবেন। কিন্তু ক্রাইসিস ম্যানেজে যে দক্ষ নন তাঁরা, সেটা প্রমাণিত হচ্ছে। তাঁরা দেশবাসীকে একটি বার্তা দিতে সদা সচেষ্ট। সেটি হল, এতকাল পর এই প্রথম এমন একজন রাষ্ট্রপ্রধান এসেছেন যিনি দেশের স্বার্থই সর্বাগ্রে রাখেন। এই উচ্চকিত দেশপ্রেমের কথা শুনতে এবং ভাবতে অবশ্যই নাগরিকদের ভালো লাগে। কিন্তু সমস্যার উৎপত্তি হচ্ছে ক্রাইসিস এলে। দেখা যাচ্ছে, একের পর এক ক্রাইসিস যখনই আসছে, তখন আর এই স্বঘোষিত শক্তিশালী নেতারা সেটাকে যথেষ্ট ধৈর্য, যোগ্যতা এবং ধীরস্থিরভাবে সামাল দিতে পারছেন না। কিন্তু, একজন নেতার প্রকৃত সাফল্য হল, তিনি ঠান্ডা মাথায় ক্রাইসিস মোকাবিলায় কতটা দক্ষ। সেটিই তাঁর প্রধান পরীক্ষা। তিনি গোটা বছর ধরে নিজেকে শক্তিশালী এবং প্রতিপক্ষকে দুর্বল হিসেবে উচ্চস্বরে প্রচার করে গেলেন। কিন্তু যখন দেখা যাচ্ছে তাঁর কঠোর সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় এসেছে, তখন তিনি সেই শক্তির প্রমাণ দিতে পারছেন না। ঠিক এখান থেকেই প্রবল ধাক্কা খাওয়ার সম্ভাবনা ইমেজের।
এখন তাই সবথেকে বড় পরীক্ষা নরেন্দ্র মোদির। চীনের সঙ্গে ভারতের সংঘাত তাঁর কাছে বড় চ্যালেঞ্জ। এতদিন তিনি ও তাঁর দল জওহরলাল নেহরুকে দুর্বল, ব্যর্থ আখ্যা দিয়ে এসেছেন ১৯৬২ সালে চীনের কাছে পরাজয়ের জন্য। এবার সময় এসেছে তাঁর নিজেকে প্রমাণের। চীনের চরম আগ্রাসনে তিনি কী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, সেদিকে তাকিয়ে আছে ১৩৫ কোটি দেশবাসী। বিরোধীরা প্রশ্ন তুলবে, জওহরলাল নেহরু অন্তত একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, চীনের সঙ্গে যুদ্ধ করা হবে। তিনি ঘোষণা করেছিলেন যে, আমি আমাদের সেনাকে বলেছি চীনকে ছুঁড়ে সীমান্তের এপারে পাঠিয়ে দিতে। সেটা হয়তো ভুল ছিল। ভারত পারেনি, পরাস্ত হয়েছে, এটা ঠিক। কিন্তু সিদ্ধান্তটা অন্তত নেওয়া হয়েছিল। কোনও আপস করা হয়নি। দ্বিধাও নয়। এখন কী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে? নেহরুকে অপছন্দ করলেও নেহরুর একটি উচ্চাশার সঙ্গে মোদির সাংঘাতিক মিল। সেটি হল, নেহরু চাইতেন তিনি নিছক ভারতের প্রধানমন্ত্রী নন, একজন বিশ্বস্তরের স্টেটসম্যান হবেন। তাই তিনি নির্জোট নেতা হয়েছিলেন। মোদিরও ওরকম একটি উচ্চকাঙ্ক্ষা আছে। তিনি অবিকল নেহরুর মতোই সর্বদা বিদেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের সঙ্গে অতি বন্ধুত্বের প্রমাণ দিতে সদা তৎপর। চীন বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল নেহরুর সঙ্গে। অবিকল এবারও তাই। জি জিনপিং ঠান্ডা মাথায় বিশ্বাসভঙ্গ করেছেন এবং ভারতের ভূমি দখল করতে মরিয়া। সুতরাং চরিত্রগতভাবে মোদির পক্ষে এটা তো মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। কী করবেন তিনি?
কঠোরতায় এখনও রোলমডেল হলেন ইন্দিরা গান্ধী। তিনি কোনও রাষ্ট্রের নেতাদের সঙ্গে বেশি উচ্ছ্বসিত ফোটো সেশন করতেন না। পিতার সঙ্গে গোটা বিশ্ব ঘুরে ঘুরে তাঁর দীর্ঘ অভিজ্ঞতা ছিল যে, বিদেশনীতি সদা পরিবর্তনশীল। কেউ স্থায়ী বন্ধু নয়, কেউ স্থায়ী শত্রু নয়। একটি বহুল চর্চিত জানা কাহিনী আবার মনে করা যাক। মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিংগার ইন্দিরা গান্ধীর বাসভবনে ব্রেকফাস্ট করতে আসার আগে সেনাপ্রধান জেনারেল মানেকশকে ডেকে নিয়েছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। কিসিংগারকে তিনি চা খেতে খেতে বলেছিলেন, পাকিস্তানকে বলুন পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালিদের উপর অত্যাচার বন্ধ করতে। ওরা আপনাদের কথা শোনে। আপনারা ব্যবস্থা না নিলে আমাদেরই নিতে হবে। কিসিংগার বলেছিলেন, কী ব্যবস্থা নেবেন? ইন্দিরা গান্ধী হেসে সেনাপ্রধান মানেকশর দিকে আঙুল দেখিয়ে বলেছিলেন, আমি কেন নেব? উনি নেবেন। কিসিংগার স্তব্ধ হয়ে যান এই ইঙ্গিতে! শুধু মুখেই আস্ফালন করেননি ইন্দিরা গান্ধী। সত্যিই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। পাকিস্তানকে জবাব দিয়ে আক্রমণ করে ভারত। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানকে ভারতীয় সেনা শুধু পরাজিত করেনি, দেশটাকেই ভেঙে দু’টুকরো করে দেওয়া হয়। এর আগে ১৯৬৭ সালে চীনকেও ভারতীয় সেনা সিকিমে চরম জবাব দিয়ে পরাস্ত করে। তখনও প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী।
চীনকে কড়া শিক্ষা দেওয়া হোক সেটা অবশ্যই ভারতবাসী চায়। পদ্ধতি কী হবে? কূটনৈতিক? বাণিজ্যিক? নাকি সামরিক? স্থির করবেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। চীনের বর্তমান আগ্রাসনে ভারত কী সিদ্ধান্ত নেবে সেটাও হবে ইতিহাসেরই অংশ!