পুরনো রোগ চাগাড় দেওয়ায় দেহকষ্ট ভোগ করতে হতে পারে। তীর্থ ভ্রমণ ও ধর্মকর্মে আত্মিক তৃপ্তিলাভ। ... বিশদ
রেলের হিসেব বলছে, আরও অন্তত এক থেকে দেড় সপ্তাহ তো লাগবেই আটকে পড়া শ্রমিকদের সবাইকে ঘরে ফেরাতে। আর যত তাঁরা ফিরবেন ততই বাড়বে করোনার সংক্রমণ। প্রশ্ন একটাই, সেই যখন সরকারি উদ্যোগেই শ্রমিক স্পেশালে চাপিয়ে তাঁদের ঘরে ফেরানো হল তখন অনেক আগেই কেন তা করল না মোদি সরকার। তখন তো সংক্রমণ কম ছিল। অসহায় মানুষগুলোকেও এতটা কষ্টে পড়তে হতো না। রাস্তার ধারে কিম্বা ট্রেনের কামরায় প্রাণও হারাতে হতো না। আর এখন আড়াই মাস পর কোনওরকম পরিকল্পনা ছাড়াই রাজ্যে রাজ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে ‘করোনা এক্সপ্রেস’। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ছাড়া কেউ প্রতিবাদ করারও নেই। এই ব্যর্থতা কার, তা নিয়ে ময়না তদন্ত করার সময়টুকুও নেই দিল্লির সরকার বাহাদুরের হাতে। গোটা সরকারটাই সব ভুলে এখন দ্বিতীয় মোদি জমানার বর্ষপূর্তির সাফল্য উপভোগ করতে মশগুল যে! অথচ লকডাউনের কড়াকড়ির পরও দৈনিক সংক্রমণ আজ ৯ হাজার ছাড়াচ্ছে। জুন মাস যত এগবে ততই সংখ্যাটা বাড়তে থাকবে, এমনই আশঙ্কা। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে সরকারের বর্ষপূর্তিতে শুধুই মোদিজির সাফল্যের খতিয়ান। হ্যান করেছি, ত্যান করেছির দু’শো ফিরিস্তি। তার পাশে ওই ঘোলাটে বিবর্ণ দৃষ্টি নিয়ে ট্রেন বোঝাই মানুষের ঘরে ফেরার অবর্ণনীয় মৃত্যুমিছিলের সত্যি কোনও মূল্য আছে কি?
গত বছর ৩০ মে শপথ নিয়েছিল মোদি সরকার-টু। দুর্বল, মেরুদণ্ড নুইয়ে পড়া পরজীবী প্রধানমন্ত্রী বলে নিন্দিত মনমোহন সিং বিদায় নিয়েছেন ওই শপথেরও পাঁচবছর আগে। কিন্তু তা বলে অর্থনীতির এমন লক্ষ্মীছাড়া হাল তো ইউপিএ জমানাতেও দেখা যায়নি। আর ৫৬ ইঞ্চির শাসনে জিডিপি, মানে যে সূচক দিয়ে বিশেষজ্ঞরা অর্থনীতির স্বাস্থ্য মাপেন, তা কমতে কমতে একেবারে তিনে। এবং তা হয়েছে লকডাউনের আগেই। এবার তো আগামী কতদিন তা শূন্যের নীচে থাকে সেটাই দেখার। প্রতিটি ক্ষেত্রেই ভয়ঙ্কর মন্দা গ্রাস করছে। নগদ জোগানের তীব্র সঙ্কট। কোনও কিছুরই চাহিদা নেই। দ্রুত বাজারে কেনাকাটা তেজি হওয়ার সম্ভাবনাও ক্ষীণ। তাই আগামী একবছর খামোকা উৎপাদন বাড়িয়ে আত্মনির্ভর দেশ গড়ার খোয়াব দেখবে কোন ‘ধুরন্ধর’ মোদিভক্ত ব্যবসায়ী। আর এই অবস্থা চলছে তো লকডাউনের আগে থেকেই। গত বেশ কয়েক বছর ধরে। নোটবন্দি আর জিএসটির ক্ষত নিয়ে বাজার তারপর থেকেই আর সেভাবে জমেনি। অথচ ৮ নভেম্বর ২০১৬-র সেই ঘোর লাগানো রাতে প্রবল পরাক্রান্ত নরেন্দ্র মোদি ভারতীয় অর্থনীতিকে নোটবন্দির মাধ্যমে একেবারে অন্য মার্গে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন দেশবাসীকে। সে স্বপ্নপূরণ হয়নি, মোদিও তাঁর কথা রাখেননি। আর এখন যখন ব্যবসা লাটে, বাজার প্রায় মরুভূমি, তখন ছোট বড় মাঝারি সব উদ্যোগপতিকে ব্যাপক হারে ঋণ দিয়ে স্বাবলম্বী ভারত গড়ার মন্ত্রে দীক্ষিত করার ফাঁদ পেতেছেন। একটা কথা আছে, পেটে খেলে তবেই পিঠে সয়! এই মরা বাজারে নতুন করে ঋণের জালে ফাঁসবে কোন আহাম্মক! অথচ এই দুর্দিনে ২০ লক্ষ কোটি টাকার গালভরা প্যাকেজ ঘোষণার নামে নানা কিসিমের ঋণের মায়াজাল ছড়ানোর একঘেয়ে প্রহসনই চলেছে টানা পাঁচ-ছ’দিন ধরে। তার বাইরে মেলেনি তেমন কিছুই। এভাবেই চোখে ধুলো দিতে প্যাকেজের পর প্যাকেজ আসছে, কিন্তু লাভ কিছুই হচ্ছে না। অর্থনীতি আরও অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে।
তবু অর্থনীতি গোল্লায় গেলেও গত একবছরে বিজেপি সরকারের সাফল্যের দাবিও তো বড় কম নয়। সেই সাফল্যের ঢাক পেটাতেই আপাতত আসরে নেমেছেন মোদি সরকারের মন্ত্রী-সান্ত্রিরা। আগাগোড়া মানুষে মানুষে বিভেদ বাড়িয়ে, সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে বিভাজনের সুযোগে ভোটব্যাঙ্কের মেরুকরণকে পোক্ত করাই ছিল এবারের লক্ষ্য। যাতে ২০২৪ সালে ক্ষমতায় ফেরা আরও সহজ হয় মোদি-অমিত শাহদের। সেই কারণেই কাশ্মীরে ৩৭০ ও ৩৫এ ধারার বিলোপ, তাৎক্ষণিক তিন তালাক প্রথার অবলুপ্তি, অযোধ্যায় মন্দির নির্মাণ এবং এনআরসি নিয়ে সরকার গত একবছরে এতটা মরিয়া। প্রতিটি উদ্যোগই আখেরে গণতন্ত্রের নামাবলির আড়ালে মানুষে মানুষে রাজনৈতিক দূরত্ব তৈরিরই নামান্তর। এতে করে সামগ্রিকভাবে দারিদ্র ঘুচবে না। শিক্ষার মান উন্নত হবে না। শিশু ও নারী পাচারের মতো সামাজিক অবক্ষয়কেও রোখা যাবে না। গরিবের মুখে দু’মুঠো খাবারও তুলে দেওয়া যাবে না। কিন্তু একটা জিনিস হবে, একটা সম্প্রদায় বাহবা দেবে, আর অপর সম্প্রদায় ভয় পাবে, সিঁটিয়ে যাবে! মানুষে মানুষে বৈরিতা চরমে পৌঁছবে। সব মিলিয়ে ধর্মীয় মেরুকরণের এই মওকায় ভোটবাক্সকে সুনিশ্চিত করার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত পাকা করা যাবে। ভারতীয় গণতন্ত্রকে ঢাল করে এভাবেই কখনও হিন্দু-মুসলমান আবার কখনও ধনী গরিবের বিভাজন চলে আসছে অবলীলায়। নরেন্দ্র মোদি সেটাকেই আরও সুদৃঢ় করার নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
কিন্তু এই কঠিন সময়ে কোনওক্রমে সাফল্যের ঢাক বাজিয়ে একে অপরের পিঠ চাপড়ানোর কোনও মূল্য আছে কি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ছুটে চলা মানুষের কাছে? সত্তরদিনের ওপর কাজকর্ম শিকেয়। চাল ডাল তেল নুনের বাইরে কোনও ভোগ্য পণ্যের বিক্রি কবে আবার স্বাভাবিক হবে জানা নেই কারও, অথচ সরকার মেতে এনআরসি, তিন তালাক আর ৩৭০ ধারার বিলোপের সাফল্য প্রচারে। অর্থনীতির কথা নয় ছেড়েই দিলাম, কী চলছে লাদাখ সীমান্তে? কেন এত সেনা মোতায়েন, যুদ্ধ বিমানের অনবরত চক্কর। পাকিস্তান না হয় ভারতের চিরশত্রু, কিন্তু শান্ত, নিরীহ নেপালও কেন রাতারাতি সবকিছুতে এত চড়া সুরে বিরোধিতা করতে শুরু করল? চীনের উস্কানি আছে মানলাম, কিন্তু বিদেশনীতির ব্যর্থতাটাকে ওই বলে কি আড়াল করা যাবে? করদাতাদের কোটি কোটি টাকা খরচ করে বার বার বিদেশ সফরের এই তাহলে নিট ফল! দেশের শত্রুর সংখ্যা বৃদ্ধি মোটেই ভালো কথা নয়। রাশিয়া, চীন, পাকিস্তান ও নেপাল একজোট হলে তা মোদি সরকারের বিদেশনীতির সাফল্য হিসেবে কখনও গণ্য হতে পারে না। আর মার্কিন বন্ধুত্ব যে আসলে ভারতকে দামি অস্ত্র বিক্রিরই দীর্ঘমেয়াদি কৌশল তা কে না জানে!
এ হেন মোদি সরকার তথা শাসক বিজেপির এখন প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গে ডালপালা বিস্তার করা। তাই বাংলা যখন করোনা, লকডাউন ও শতাব্দীর অন্যতম শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়ে বিপন্ন তখন সেদিকে বিশেষ আমল না দিয়ে বাংলার রাজ্যপাট দখলেরই স্বপ্ন দেখছেন নরেন্দ্র মোদির লেফটেন্যান্ট অমিত শাহ। গেরুয়া শিবিরের সেই স্বপ্ন অচিরেই দুঃস্বপ্নে পরিণত হতে বাধ্য। কারণ বাংলার মানুষ তাঁর শিকড়টাকে খুব ভালো চেনে। বাংলার মাটি জানে দুর্দিনে শেষ পর্যন্ত লড়াই করবেন মমতাই। অন্যরা যে ভোট এলে বিমান ছুটিয়ে এসে বড় বড় ভাষণ দিয়েই পালিয়ে যাবেন, তা তাঁদের অজানা নয়। রাজ্যের প্রতি দিল্লির অবহেলা আজ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে রাজ্যে উম-পুনের ক্ষয়ক্ষতি দেখতে কেন্দ্রীয় দল আসার আগেই উদ্বিগ্ন ফরাসি প্রেসিডেন্টের ফোন এসেছে প্রধানমন্ত্রীর কাছে। ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রঁ দুর্গতদের ক্ষতিপূরণে প্রায় ১৭০০ কোটি টাকার সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছেন। অথচ কেন্দ্রীয় সরকার দিয়েছে মাত্র ১ হাজার কোটি টাকা। আর তেমন কোনও ক্ষয়ক্ষতি না-হলেও ওড়িশা পেয়েছে ৫০০ কোটি টাকা। কিন্তু বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর নাম যখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তখন অপমান আর বঞ্চনা করে, হুমকি দিয়ে তাঁকে দমিয়ে রাখা গেরুয়া শিবিরের পক্ষে কার্যত অসম্ভব। তাই দিল্লি যতই অবহেলা করুক, সীমিত ক্ষমতার মধ্যে মমতার সরকার ইতিমধ্যেই ৬ হাজার ৩০০ কোটি টাকা বের করে দিয়েছে আর্ত, দুর্গত মানুষের সেবায়। অথচ ভুল ধরার গোঁসাইরা বুক ফুলিয়ে সমালোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন নেত্রীর। ভাবটা এমন যেন মুহূর্তে সব ঠিক করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন ওঁরা। এই দুর্দিনে সহযোগিতার বদলে যে-শক্তি ক্ষমতা দখলের খোয়াব দেখে, যারা মানুষের পাশে না দাঁড়িয়ে বিভাজনের বিষ বপনের সঙ্কীর্ণ রাজনীতিকে পাখির চোখ করে, তাদের হাতে বাংলার ভবিষ্যৎ বিপন্ন। বাংলার মানুষ সেই ভুল সহজে করবে না। ২০২১-র বিধানসভা ভোটে অমিত শাহদের স্বপ্নও তাই দুঃস্বপ্নে পরিণত হতে বাধ্য।