গৃহে শুভকর্মের প্রস্তুতি ও ব্যস্ততা। হস্তশিল্পীদের নৈপুণ্য ও প্রতিভার বিকাশে আয় বৃদ্ধি। বিদ্যায় উন্নতি। ... বিশদ
কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকার আনলক পর্ব শুরু করতেই একটা প্রশ্ন মানুষের মধ্যে ভীষণভাবে ঘুরপাক খাচ্ছে, করোনা আক্রান্তের সংখ্যা যখন প্রতিদিন রেকর্ড গড়ছে তখন সব কিছু খুলে দেওয়া কি ঠিক হল? তাহলে লকডাউন করে কী লাভ হল? এমন
প্রশ্ন ওঠাটা খুবই স্বাভাবিক। কারণ প্রতিটি
রাজ্যেই আক্রান্তের গ্রাফ ঊর্ধ্বমুখী। এমনকী, যে
কেরল করোনা মোকাবিলায় দেশের মডেল হিসেবে নিজেদের তুলে ধরেছিল, সেখানেও করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে।
বিশেষজ্ঞরা অনেকেই বলছেন, প্রথম দফায় যে ২১দিনের লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছিল, তা দেশের সর্বত্র কঠোরভাবে মানলে করোনাকে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হতো। কিন্তু, সেই সুযোগটা আমরা কাজে লাগাতে পারিনি। করোনাকে আমরা তখন অনেকেই হাল্কাভাবে নিয়েছিলাম।
তার সুযোগ নিয়েছে করোনা। সে তার নিজের গতিতে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়িয়ে গিয়েছে। অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যানের মতো ক্রিজে টিকে থেকে এখন চার, ছক্কা হাঁকাচ্ছে। সরকারও এক, দুই, তিন করে লকডাউনের পর্যায় বাড়িয়ে গিয়েছে। কিন্তু, চার দফার লকডাউন শেষে বোঝা গেল, করোনাকে এভাবে আটকে রাখা যাবে না। উল্টে দিনের পর দিন লকডাউন চালিয়ে যেতে থাকলে না খেয়ে মরাটাই ভবিতব্য
হবে। সামনেই বর্ষা। এই সময় গৃহবন্দি হয়ে থাকলে চাষের বারোটা বাজবে। টান পড়বে খাদ্য ভাণ্ডারে।
এই বর্ষাতেই সব থেকে বেশি ধানচাষ হয়। ভালো
বর্ষা হলে বদলে যায় দেশের গ্রামীণ অর্থনীতি। আবহাওয়া দপ্তরের পূর্বাভাস, এবার ভালো বর্ষা হবে। মুখ থুবড়ে পড়া দেশের অর্থনীতিকে কিছুটা অক্সিজেন জোগাতে পারে বর্ষা। সেই সুযোগ হাতছাড়া হলে বিপদ আরও বাড়বে।
প্রায় আড়াই মাসের লকডাউনে বদলে গিয়েছে অনেক কিছুই। ঘন ঘন সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, নিজেকে যথাসম্ভব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা অভ্যেসে পরিণত হয়েছে। আমরা বেশিরভাগ মানুষই বুঝে গিয়েছি, মাস্ক আর স্যানিটাইজার জীবনের রক্ষাকবচ। প্রায় তিন মাস হতে চলল এখনও বহু বাড়িতে
কাজের লোকের জন্য ঝুলছে ‘নো এন্ট্রি’ বোর্ড।
আর যাঁদের বাড়িতে আসছেন তাঁরাও যথেষ্ট সতর্ক। হাত ধোয়ার জন্য থাকছে পৃথক সাবান। এমনকী, অনেকে মাস্কও দিচ্ছেন। বজায় রাখছেন দূরত্ব। কারণ বোধগম্য হয়েছে, নিকট ভবিষ্যতে করোনা নির্মূল হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। করোনাকে নিয়েই বাঁচতে হবে। তবে চলতে হবে তাকে এড়িয়ে।
লকডাউন ছিল করোনা মোকাবিলার একটা প্রস্তুতি পর্ব। লকডাউন করে সংক্রমণের গতি কিছুটা হলেও কমানো গিয়েছে। পাওয়া গিয়েছে করোনা বিরোধী লড়াইয়ে নিজেদের প্রস্তুত করার সময়। দেশজুড়ে টেস্টিং সেন্টারের সংখ্যা অনেকটা বাড়ানো গিয়েছে। তৈরি হয়েছে বহু করোনা হাসপাতাল। স্বাস্থ্য কর্মীদের প্রশিক্ষিত করা গিয়েছে। অধিকাংশ মানুষই হয়েছেন সচেতন। আর তার জন্যই করোনার কাছে আত্মসমর্পণ করতে হয়নি, জারি রাখা গিয়েছে জবরদস্ত লড়াই।
একথা মানতেই হবে, জনসংখ্যা এবং আক্রান্তের বিচারে যে পরিকাঠামো গড়ে তোলা গিয়েছে, তা যথেষ্ট নয়। তাই প্রতিটি হাসপাতালে হাজার হাজার নমুনা পেন্ডিং পড়ে রয়েছে। মানুষ চূড়ান্ত দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে। রিপোর্ট আসার আগেই অনেকে মারা যাচ্ছেন। রিপোর্ট দেরিতে আসায় মৃতের পরিবারকে দেহ নেওয়ার জন্য দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে হচ্ছে। সহ্য করতে হচ্ছে এক অসহনীয় মানসিক যন্ত্রণা। দিন যত যাবে, এই সঙ্কট আরও ঘনীভূত হবে।
তবে, তার জন্য ভয় পেয়ে গেলে চলবে না। আতঙ্কিত না হয়ে নিতে হবে পরিকল্পনা। নিখুঁত পরিকল্পনায় যে সুফল পাওয়া যায় তার নজির আমাদের রাজ্যেই তৈরি হয়েছে। জুন মাসের
গোড়ায় ঝাড়গ্রাম জেলায় মোট করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ১১। তার মধ্যে পাঁচজন ঝাড়গ্রামের
বাসিন্দা হলেও আক্রান্ত হয়েছিলেন অন্য জেলায়। আর জেলায় আক্রান্ত ছ’জনের মধ্যে তিনজনই পরিযায়ী শ্রমিক। ৩ জুন পর্যন্ত জেলার সকল করোনা আক্রান্ত সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন।
এর পিছনে কোনও ম্যাজিক নেই। আছে নিখুঁত পরিকল্পনা। ঝাড়গ্রাম জেলার জেলাশাসক আয়েষারানি এ কেরলের বাসিন্দা। নিপায় আক্রান্ত হওয়ার অভিজ্ঞতা তাঁর রাজ্যের আছে। তাঁর সেই অভিজ্ঞতা যথেষ্ট কাজ দিয়েছে। তিনি বুঝেছিলেন, করোনার মোকাবিলা করতে গেলে সব চেয়ে বেশি দরকার জনগণের সহযোগিতা। মানুষকে ঠিকমতো বোঝাতে পারলেই আসবে সাফল্য। তাই পুলিস, স্বাস্থ্য দপ্তর ও জেলা প্রশাসনকে একছাতার নীচে এনে মানুষকে লাগাতার সচেতন করে গিয়েছেন। লকডাউন ঘোষণা হতেই সিল করে দিয়েছিলেন জেলার ওড়িশা ও ঝাড়খণ্ড রাজ্যের বর্ডার। পাশাপাশি অন্য জেলা থেকেও কেউ যাতে ঢুকতে না পারে তার জন্যও গুপ্তমনি সীমানায় ছিল পুলিসের কড়া নজরদারি।
সাধারণ মানুষকে বোঝানোর পাশাপাশি ওষুধের দোকানগুলিতে ক্রেতাদের নাম ও ফোন নম্বর
লিখে রাখতে বলা হয়েছিল। এমনকী, কেউ বেশি জ্বরের ওষুধ কিনলেই বিষয়টি প্রশাসনের নজরে আনার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। জ্বরের ওষুধ কোনও বাড়িতে বেশি গেলেই স্বাস্থ্যকর্মীরা গিয়ে জানতে চাইছিলেন, জ্বর হয়েছিল শুনলাম, এখন কেমন আছেন? তাতে মানুষ আতঙ্কিত হয়নি। বরং ভরসা পেয়েছিল, প্রশাসন আছে পাশে।
ঝাড়গ্রামের উপর দিয়ে কোনও পরিযায়ী শ্রমিককে হেঁটে বা সাইকেলে বাড়ি ফিরতে দেওয়া হয়নি। একটি ঘটনার কথা বললে বোঝা যাবে, প্রশাসনের দৃষ্টিভঙ্গি। ২৪ মে বিকেল তিনটে নাগাদ গুজরাত থেকে জাতীয় সড়ক ধরে ঝাড়গ্রাম হয়ে সাইকেলে বাড়ি ফিরছিলেন দক্ষিণ ২৪ পরগনার ১৪ জন পরিযায়ী শ্রমিক। জেলাশাসক নয়াগ্রাম থেকে ফেরার সময় বাঁকশোলের কাছে তাঁদের দেখতে পান। দেখামাত্র জেলাশাসক তাঁদের থামিয়ে লোধাশুলি পথসাথীতে তোলেন। সেখানে খাইয়ে সকলকে নতুন জামাকাপড় দিয়ে বাসে করে দক্ষিণ ২৪ পরগনায় পাঠিয়ে দেন। এইভাবে বেশ কয়েকবার পরিযায়ী শ্রমিকদের বাসে করে বাড়ি ফিরিয়েছে প্রশাসন। কারণ প্রশাসন বুঝেছিল, বাইরের সংক্রমণ ঠেকানো গেলেই ঝাড়গ্রামকে বিপদমুক্ত রাখা যাবে। নিখুঁত পরিকল্পনা। ফলও মিলেছে হাতেনাতে। তাই দেশজুড়ে করোনার তাণ্ডবলীলা চললেও জুনের গোড়ায় ঝাড়গ্রাম জেলা করোনাশূন্য।
আমরা একটা ঝড়ের মধ্যে দিয়ে চলেছি। ঝড়ের আগের, আর পরের অবস্থার মধ্যে বিস্তর ফারাক। কখনওই ঝড়ের আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়া যায়
না। অনেক কিছুই নতুন করে শুরু করতে হয়। রাতারাতি আগের জীবনে ফিরে পাওয়ার চেষ্টা
করলে শুধু ভুল হবে না, আমরা বিপদ ডেকে আনব। গন্তব্যে পৌঁছনোর জন্য ভুলতে হবে মারামারি, ঠেলাঠেলির অভ্যেস। হতে হবে সংযত, দিতে
হবে ধৈর্যের পরীক্ষা। আড়াই, তিন মাস ধরে কোটি কোটি মানুষ ধৈর্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ বলেই ১৩০ কোটির দেশ হয়েও আক্রান্তের তালিকায় আমরা এখনও শীর্ষে উঠে যাইনি।
আমাদের দেশে করোনা থাবা বসিয়েছে অনেক পরে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনার আক্রমণ
শিখরে পৌঁছবে জুলাই মাসে। এখনই প্রতিদিন
নতুন আক্রান্তের সংখ্যা ১০ হাজারের আশপাশে।
এই গতি জুলাই মাস পর্যন্ত বজায় থাকলে
সংক্রমণের গ্রাফ আকাশ ছোঁবে। তবে তারই মধ্যে আশার কথা, আমাদের দেশে সুস্থ হয়ে ঘরে ফেরা মানুষের সংখ্যাও প্রচুর।
আনলক মানে খুলে দেওয়া। কিন্তু, খুলে দেওয়ার অর্থ খুল্লম খুল্লা নয়। বন্দিদশা থেকে মুক্তির অর্থ, বাঁধনহারা উচ্ছ্বাস নয়। সব কিছু আগের মতো হয়ে গেল, এমনটা ভাবলে খুব ভুল হয়ে যাবে। বরং
আরও বেশি সংযমী, আরও বেশি হিসেবি, আরও বেশি সতর্ক হতে হবে। কারণ লকডাউন পর্বে করোনার বিরুদ্ধে লড়াইটা ছিল যুদ্ধের মহড়া।
আনলক পর্বেই শুরু হয়েছে আসল যুদ্ধ। এবার লড়াইটা রাস্তায় এবং মুখোমুখি।