সঠিক বন্ধু নির্বাচন আবশ্যক, কর্মরতদের ক্ষেত্রে শুভ। বদলির কোনও সম্ভাবনা এই মুহূর্তে নেই। শেয়ার বা ... বিশদ
প্রাপ্তির তালিকায় প্রাকৃতিক পরিবেশের উন্নতির বিষয়টিকে সবার উপরে রাখা যায়। আমরা বিশেষভাবে অনুভব করতে পারছি শহরে বাতাসের দূষণমাত্রা অনেকখানি কমে যাওয়ার ব্যাপারটা। বাতাসের দূষণ কতটা কমে গিয়েছে, তা বোঝার জন্য গবেষণাগারে পাওয়া পরিসংখ্যানের দিকে নজর না-রাখলেও চলবে। ফুসফুসই বলে দিচ্ছে, আমাদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য তাকে আগের মতো চাপ নিতে হচ্ছে না। অনেকেই ভুলে যাচ্ছেন ইনহেলার হাতে তুলে নেওয়ার কথা। কারণ, শ্বাস নেওয়ার কষ্ট কীভাবে যেন উধাও হয়ে গিয়েছে! অথচ এই মানুষগুলিই দিনে অন্তত একবার ইনহেলারের শরণাপন্ন হতেন। তাছাড়া রাতটা কাটানোই ঝুঁকির হয়ে যেত। মাসে অন্তত একবার বিশেষজ্ঞের কাছে যেতেন নিয়ম করে। আপাতত সেসবের বালাই নেই। এই অনুভব যে কাকতালীয় নয়, ওষুধের দোকানে খোঁজ নিলেও মনে হয় এর পক্ষে সমর্থন মিলবে।
অনেকে বুঝতে পারছেন, আগের মতো চোখ-মুখ জ্বালা করছে না। দেখার কষ্টও হয়তো কমেছে। জামাকাপড় নোংরা কম হচ্ছে। নিত্য শ্যাম্পু করা যাঁদের হ্যাপা মনে হতো, তাঁরা বেশ আনন্দে আছেন। ঘরে-বাড়িতে ধুলো ঝুলকালিও কমে গিয়েছে।
এ তো গেল বাতাসের দিক। দূষণ কমেছে জলেও। বিশেষ করে নদীগুলির দূষণ। গঙ্গাকে আমরা আক্ষেপ করে বলতাম, পৃথিবীর বৃহত্তম ড্রেন। সেই গঙ্গার কথা শুনে বেশ ভালো লাগছে: গত এপ্রিল থেকেই ইতিউতি মুখ বের করছে, মনের আনন্দে খেলছে ডলফিন—বিখ্যাত গ্যাঞ্জেটিক ডলফিন বা দক্ষিণ এশীয় নদীর ডলফিন। অনেকের মতে, গঙ্গার প্রতি ডলফিনের এমন আস্থা ফিরে এল অন্তত তিন দশক পর। এই প্রজাতির ডলফিনকে আজ বিলুপ্তপ্রায় বলা চলে। সারা দুনিয়ায় এদের হালফিল সংখ্যা দু’হাজারেরও কম।
এপ্রিলের শেষদিকে প্রকাশিত একটি বেসরকারি রিপোর্ট দেখে মনটা ভালো হয়ে গিয়েছিল: খোদ কলকাতার বুকে এবং আশেপাশের পরিবেশে অনেক সুন্দর প্রাণীর আনাগোনা বেড়ে গিয়েছে। যেমন কাঠবেড়ালি, বেজি, ভামবেড়াল, শিয়াল, খটাশ, পায়রা, ঘুঘু, চড়ুই, শালিক, বুলবুল, দোয়েল, কোকিল, ফিঙে, হলদে পাখি প্রভৃতি। হবে নাই-বা কেন, গাছের পাতায় নেই ধুলো-ময়লা। গাছগুলো সত্যিই যেন হাসছে। রোদেলা দিনে আকাশকে এতটা নীল শেষ কবে দেখেছে, কলকাতাবাসী অন্তত মনে করতে পারছে না। তাহলে সেই আনন্দের দোলা পশুপাখিদের গায়ে, ডানায় সমপরিমাণ লাগবে না!
নাগরিক জীবনের অন্যতম বৃহৎ সমস্যা শব্দদূষণ। যানবাহন, কলকারখানা, শব্দবাজি প্রভৃতির বিকট আওয়াজের জায়গাটা সুন্দর নিয়েছে বিচিত্র সব পাখির কিচিরমিচির। বাতাসের শনশন, পাতার মর্মরধ্বনিও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে বহু বহু কাল পর। মেঘ-ডাকার আওয়াজটা ট্রেনের হুইসল কিংবা একসঙ্গে বেজে ওঠা একশো গাড়ির হর্নের নীচে চাপা পড়ে যাচ্ছে না। সব মিলিয়ে সাময়িক গৃহবন্দি জীবনকে মন্দের ভালো অনেক উপহার দিয়েছে প্রকৃতি।
এই লেখার শুরুতে পরিবেশের অভাবনীয় উন্নতির যেসব কথা বলে আহ্লাদ করেছিলাম, তাতে প্রথম বাদ সাধল উম-পুন। ধাক্কার উপর রামধাক্কা মিলল সাত দিন বাদেও। কলকাতা পুরসভার হিসেবে, সব মিলিয়ে শুধু এই মহানগরীতেই ১৫ হাজারের বেশি গাছ উপড়ে পড়েছে, কিংবা ভেঙে গিয়েছে। সুন্দরবন-সহ রাজ্যের বাকি অঞ্চলে গাছগাছালির ক্ষয়ক্ষতির হিসেবটা যে কী বিশাল, তা ভাবেতই শিউরে উঠি। চারা লাগিয়ে দেওয়া হল আর গাছ বেড়ে উঠল, ব্যাপারটা তো অত সহজ নয়। একটা চারা ছায়া-ফুল-ফল দানের উপযোগী গাছ হয়ে ওঠে অনেক অনেক ঝড়-ঝাপটা সয়ে। গাছেদের অনেক গল্প থাকে। গাছেরা কত ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে যায়। আবার কিছু বৃক্ষ স্বয়ং ইতিহাস! এই প্রসঙ্গে বিলের (নরেন্দ্রনাথ দত্ত বা স্বামী বিবেকানন্দ) সেই চাঁপাগাছের কথাটা বড় মনে পড়ছে—যেখানে নাকি ছিল বেম্মদত্যির বসত! পলাশীর সেই আমবাগানের কথা ভাবুন, যার কথা মনে এলে আমরা বোধহয় ভারতের স্বাধীনতার প্রিয় সূর্যটা অস্ত যাওয়ার করুণতম দৃশ্য দেখতে থাকি। কল্পনা করি সেই বৃক্ষের কথা, যার নীচে সাধনা করে এক অনামী রাজপুত্র ‘জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ’—বুদ্ধদেবে রূপান্তরিত হয়েছিলেন।
তাই বৃক্ষ নষ্ট হয়ে যাওয়া মানেই তুচ্ছ কিছু গাছ চলে গেল না। শিবপুর বি-গার্ডেনে গ্রেট ব্যানিয়ান ট্রি—তার ৪০টির মতো স্তম্ভমূলের ক্ষতি হল! এটাকে আপনি কোন মানদণ্ডে মাপবেন? রবীন্দ্র সরোবরেও গাছগাছালির যে ক্ষতি হয়েছে—তাও অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়। দিকে দিকে এত যে গাছপালার ক্ষতি হল, একে কারও ব্যক্তিগত বা কোনও সরকারের ক্ষতি বলে গণ্য করলে ভুল হবে। গাছ এমন একটা জিনিস, বাস্তবে তার কোনও মালিকানা হয় না। আমার পাঁচিল ঘেরা জমিতে আমি নিজে হাতে পরিচর্যা করে কিছু গাছ বড় করলাম বটে, সে কিন্তু আমার কোনও কথা শোনার অপেক্ষা করবে না—আমার শত্রু-মিত্র সকলের জন্যই অক্সিজেন দিয়ে যাবে, বাতাসকে পরিশোধনের দায়িত্ব পালন করে যাবে নীরবে।