সঠিক বন্ধু নির্বাচন আবশ্যক, কর্মরতদের ক্ষেত্রে শুভ। বদলির কোনও সম্ভাবনা এই মুহূর্তে নেই। শেয়ার বা ... বিশদ
কিছুদিন আগে আমার এক অধ্যাপক বন্ধুর সঙ্গে ফোনে কথা হচ্ছিল। কথা প্রসঙ্গে সে বলেছিল, করোনা কালে একটা কথা খুবই স্পষ্ট। সেটা হল, গত কয়েক বছরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নির্বাচন হয়েছে। সেই নির্বাচনের ফল থেকে এখন একটা ব্যাপার খুবই স্পষ্ট। দেখা যাচ্ছে, সব দেশেই কমবেশি অপদার্থ নেতাদের মানুষ ভোট দিয়ে ক্ষমতায় এনেছেন। ভোটের সময় ভোটারদের মাথা কি কোনও ভাইরাসে আক্রান্ত ছিল? নাহলে সব দেশের ভোটারই এমন অপদার্থদের চিনতে পারল না কেন? কেনই বা তাদের বিপুল ভোটে জিতিয়ে সিংহাসনে বসাল। আমরা আমাদের দেশের দিকে তাকিয়ে দেখতে পাচ্ছি, আজকের করোনার দৈত্য আটকাতে না পারার কারণ অবশ্যই সরকারের কমবেশি নিষ্ক্রিয়তা, যথার্থ পরিকল্পনার অভাব, নেতৃত্বের বিচক্ষণতার অভাব, দূরদৃষ্টির অভাব ইত্যাদি। এরকম অসংখ্য কারণ উল্লেখ করে ব্যর্থতাকে চিহ্নিত করা যায়। এদিকে, সরকার কিন্তু নিজের ঢাক নিজেই বাজিয়ে বলছে, আমরা এই করোনাকালে দারুণ কাজ করেছি। এর মধ্যেই দ্বিতীয় মোদি সরকার দ্বিতীয় বর্ষে পদার্পণ করল। তাই মন্ত্রী, নেতারা সাফল্য-সঙ্গীত গেয়ে জোর ঢাক বাজাচ্ছেন। কিন্তু মানুষ জানে, বর্ষপূর্তি হলেও ভরসাপূর্তি হয়নি। দ্বিতীয় মোদি সরকারের প্রথম সেমেস্টারে সরকার সব বিষয়ে ডাহা ফেল। গত এক বছরে সরকার দেশে অস্থিরতা তৈরি করেছে, দেশের অর্থনীতিটাকে টাইটানিক বানিয়ে ফেলেছে। সেটা একটু একটু করে তলিয়ে যাচ্ছে। আর ডেকে দাঁড়িয়ে ক্যাপ্টেন বলছেন, সকলে থালা-বাটি বাজাও হে।
এছাড়া করোনা মোকাবিলায় সরকারের ব্যর্থতা প্রতিটি পদক্ষেপে। সারা পৃথিবীতে আমাদের স্থান এখন সপ্তম। আমরা ক্রমেই এগচ্ছি। আরও এগব। হয়তো ছুঁয়ে ফেলব ‘বন্ধু’ ট্রাম্পের দেশকেও। ভারতে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় দু’লক্ষ। ফ্রান্সকে ছাড়িয়ে সে দৌড়াচ্ছে। সবার আগে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সে দেশে আক্রান্তের সংখ্যা ১৮ লক্ষেরও বেশি। অর্থাৎ আমাদের দেশের ১৩০ কোটি মানুষের মধ্যে আক্রান্ত ২ লক্ষ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৩৩ কোটি মানুষের মধ্যে আক্রান্তের সংখ্যা ১৮ লক্ষ। হিসেবটার মধ্যে একটা গোলমাল আছে কিন্তু। ব্যাপারটা একটু বিচার করে দেখা যেতে পারে। দেশের জনসংখ্যার পাঁচ শতাংশের করোনা টেস্ট করেছে আমেরিকা। তার মধ্যে তাদের আক্রান্তের সংখ্যা বেরিয়েছে ১২ শতাংশ। সেই সংখ্যাটাই ১৮ লক্ষ। পাশাপাশি ভারত ৪০ লক্ষেরও কম মানুষের করোনা টেস্ট করেছে। অর্থাৎ ০.৩০ শতাংশ মানুষের টেস্ট হয়েছে এবং তার মধ্যে ৪.২৮ শতাংশ পজিটিভ। মারাত্মক জাগলারি, তথ্য চাপার মারাত্মক ব্যবস্থা। যেখানে যত কম টেস্ট হবে, তত কমই তো করোনা পজিটিভ হবে, এটাই স্বাভাবিক। কোনও টেস্ট না হলে দেখা যেত জিরো শতাংশ আক্রান্ত আমাদের দেশে। আমরা যদি পাঁচ শতাংশ টেস্ট করতাম, তাহলে হয়তো আমরাই বিশ্বে এক নম্বরে থাকতাম। সব কাজই কি আর রাম কিংবা গোমূত্রে হয়? কম টেস্ট করিয়ে কম আক্রান্ত দেখানোর প্রবণতাটা সত্যিই ভয়ঙ্কর।
এর মধ্যে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল অ্যান্ড নিউরোসায়েন্সেস-এর একটি রিপোর্ট থেকে আশঙ্কা কিন্তু বেড়েই যাচ্ছে। ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে দেশের প্রায় ৬৭ কোটি মানুষ করোনায় আক্রান্ত হবে। অর্থাৎ দেশের অর্ধেক মানুষ। এদের মধ্যে আবার ৯০ শতাংশ ভারতীয় জানতেই পারবে না, তারা করোনা আক্রান্ত। কেননা তাদের সংক্রমণের তেমন লক্ষণ থাকবে না। এদের মধ্যে ৫ শতাংশের অবস্থা হবে সঙ্কটজনক। সেই হিসেবে এই বছরের শেষে প্রায় তিন কোটি ভারতীয় উপসর্গযুক্ত করোনায় আক্রান্ত হতে পারেন। সবকিছুই এখন আনলক হয়ে গেল। বিষয়টা খুবই চিন্তাগ্রাহ্য। এই সঙ্গে একটা কথা মনে রাখা দরকার। আনলক অবস্থায় এলেও কিন্তু আমরা সতর্কতা, স্বাস্থ্যবিধিকে জলাঞ্জলি দিতে পারি না। আজকে যতটা বাড়বাড়ন্ত হয়েছে, তার জন্য সাধারণ মানুষও কম দায়ী নয়। অনেকেই সেভাবে স্বাস্থ্যবিধি মানেনি।
সরকারের দ্বিতীয় ব্যর্থতার সব থেকে বড় উদাহরণ পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে উদাসীনতা। আশ্চর্য, সরকার এদের কথা ভাবলই না। সরকার দীর্ঘদিন ধরে শুধু বসে বসে দেখল, ওরা হেঁটে চলেছে শত শত কিলোমিটার। খাদ্য নেই, জল নেই। কারও কারও প্রাণ গেল পথের উপরেই। তবু সরকার চোখ বন্ধ করে রইল। অনেক মৃত্যুর পর সম্বিত ফিরলেও পরিকল্পনাহীন পদক্ষেপ নিল। অবিজেপি রাজ্যগুলিতে একের পর এক ঢুকিয়ে দিতে লাগল শ্রমিক বোঝাই ট্রেন। রাজ্যগুলিকে সেকথা জানানোর প্রয়োজনও সরকার মনে করল না।
বীরভূমের নলহাটির ইয়ার মহম্মদ ওরফে ভাদু। ৬২ বছরের এই শ্রমিক একটু ভালো কাজের আশায় রাজমিস্ত্রির হতে গিয়েছিলেন হায়দরাবাদে। অনেকদিন আটকে পড়ে থেকে যখন সব জমানো পয়সা শেষ হয়ে গেল, তখন তিনি সেখান থেকে হাঁটা শুরু করলেন বাড়ির পথে। প্রায় দেড় হাজার কিলোমিটার রাস্তা। ৬২ বছরের ভাদু কয়েকজনের সঙ্গে মনের জোরকে সম্বল করে হাঁটা শুরু করলেন। কখনও ট্রাকে, কখনও হেঁটে বাড়ির দিকে এগতে লাগলেন ভাদু। বালেশ্বর অবধি এসেছিলেন। সেদিন প্রবল ঝড়জল। সব যেন উড়ে যাবে। ট্রাকের উপর বৃষ্টিতে ঠকঠক করে কাঁপছিলেন। সেখানেই তাঁকে নামিয়ে দিয়ে যায় ট্রাকচালক। সেই রাতে একটা দোকানের শেডের নীচে কাঁপতে কাঁপতে শুয়ে পড়েছিলেন। ক্লান্তিতে ঘুমিয়েও পড়েছিলেন। কিন্তু পরদিন সকালে তাঁর আর ঘুম ভাঙেনি। পরে বাড়ি ফিরেছিল তাঁর দেহটা। সাদা কাপড়ে মোড়া। দেশ জুড়ে এমন অসংখ্য ভাদু নীরবে বিদায় নিয়েছেন। দেশের সরকার তাঁদের জন্য কোনও সুপরিকল্পিত নীতি নিতে পারেনি। অবশেষে সুপ্রিম কোর্ট একটা নির্দেশিকা দিয়েছে, অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে, কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের এই নির্দেশ কেন্দ্রের ব্যর্থতাকে চোখের সামনে তুলে ধরেছে। লকডাউনের দু’মাস পরে সুপ্রিম কোর্টকে বলতে হচ্ছে, পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য ট্রেনের ব্যবস্থা করতে, তাদের জন্য খাদ্য ও পানীয় জলের ব্যবস্থা করতে। অন্যদিকে ব্যর্থতার নামাবলি গায়ে দিয়ে বর্ষপূর্তির আত্মতুষ্টিতে উদ্ভাসিত মোদিজি।
ব্যর্থতার পাঁচালি পড়তে পড়তে এ প্রসঙ্গে পণ্ডিত জর্জ বার্নার্ড শ-এর কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। রাজনীতিকদের তিনি ভালো করেই চিনেছিলেন। তিনি একবার বলেছিলেন, যে রাজনীতিক কিস্যু না জেনেও মনে করেন যে তিনি অনেক কিছু জানেন, তিনি অনেকদূর পর্যন্ত যেতে পারেন। এমনকী পৌঁছতে পারেন শীর্ষস্থানেও। কথাটা পড়ার পরই সকলেরই মনে হতে পারে, এমন জলজ্যান্ত সত্যিটাকে তিনি উপলব্ধি করলেন কী করে? আমাদের দেশের ক্ষেত্রে কথাটা কি খাটে না? বুঝহ সুজন।
এখন যা দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি তাতে মনে হচ্ছে, খনার বচনও সম্ভবত সত্যি। আসলে খনার বচন তো কোনও অলীক বিচার নয়, তা এক কৃষিতত্ত্ব, যা নির্ভর করে আবহাওয়া এবং জ্যোতির্বিজ্ঞান সংক্রান্ত জ্ঞানের উপর। সেগুলি যে আজকের দিনে সব মেলে তা নয়, কিন্তু তাঁর কিছু কিছু সত্যদর্শন হয়তো সবসময় মেলে।
তাঁর একটি বচন হল, ‘দাবানল, শস্যহানি, ঝড় মহামারী।/একত্রে ঘটিলে জেনো রাজা দূরাচারী।/ রাজা যদি পাপমতি প্রবঞ্চক হয়।/ রাজপাপে দেশময় বহে মৃত্যুভয়।/ অধর্ম কুকর্ম যদি কভু রাজা করে।/ দেখিবে অন্নাভাবে প্রজাগণ মরে।/ বৈশাখে অকাল বন্যা, আষাঢ়েতে খরা / নিশ্চয় বুঝিবে রাজা, ভণ্ড, ইষ্টহারা।’ এরপর বোধহয় আর কিছু বলার দরকারই পড়ে না। ব্যর্থ রাজার ধন্য দেশ আজ কোন পথে এগবে, তা কেউ জানে না!