বিদ্যার্থীরা কোনও বৃত্তিমূলক পরীক্ষার ভালো ফল করবে। বিবাহার্থীদের এখন ভালো সময়। ভাই ও বোনদের কারও ... বিশদ
তৎকালীন মাদ্রাজের ভয়ানক কমিউনিস্ট-বিরোধী সরকার ১৯৫০-এর ১০ মার্চ একটি নয়া আদেশ পাশ করে ঘোষণা করল যে, পিপলস এডুকেশন সোসাইটি একটি ‘বেআইনি অ্যাসোসিয়েশন’। সরকার এটা করেছিল ইন্ডিয়ান ক্রিমিনাল ল’ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট, ১৯০৮-কে শিখণ্ডী খাড়া করে—আমি পুনরাবৃত্তি করছি যে, ১৯০৮ সালেরটা ছিল একটি ঔপনিবেশিক আইন। ওই ঔপনিবেশিক ফৌজদারি আইন এবং নয়া সরকারি আদেশটিকে হাইকোর্টে চ্যালেঞ্জ জানানো হয়েছিল। নয়া সরকারি আদেশ আদালতের বিচারে টিকবে না অনুমান করে, মাদ্রাজ রাজ্য সরকার ১৯৫০-এর ১২ আগস্ট পুরনো আইনের একটি সংশোধনী পেশ করল—এটা করা হল মূল আইনটিকে আরও পোক্ত করার অছিলায়, এবং একটি ‘লিগাল ফিকশান’-এর সাহায্যে পূর্ববর্তী আদেশটিতে নয়া সংশোধনী প্রযোজ্য হল। উল্লেখ করা যায়, ‘লিগাল ফিকশান’ হল সেই ধরনের একটি ঘোষণা যা আইনি প্রয়োজনে ‘সত্য’ বলে গ্রাহ্য হয়ে থাকে, যদিও সেটি তখনও পর্যন্ত কোনও ‘প্রমাণিত সত্য নয়’।
প্রহরীর বিরাট দায়িত্ব
আইনি ভোজবাজিটা হাইকোর্টের ফুল বেঞ্চের কাছে সুবিধা করতে পারেনি। (উল্লেখ করা যায় যে, প্রধান বিচারপতি রাজামান্নারের নেতৃত্বাধীন তিনজনের ওই ফুল বেঞ্চে অন্য দুই বিচারপতি ছিলেন সত্যনারায়ণ রাও এবং বিশ্বনাথ শাস্ত্রী।) মাদ্রাজ সংশোধনীর সঙ্গে আদেশটিও হাইকোর্ট খারিজ করে দিয়েছিল।
সুপ্রিম কোর্টে করা আপিল খারিজ করে দিয়ে, প্রধান বিচারপতি পতঞ্জলি শাস্ত্রী পাঁচজনের সাংবিধানিক বেঞ্চের সুপারিশ করেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন:
‘‘তখন এ দেশের আদালতগুলিকে যদি এই ধরনের গুরুত্বপূর্ণ এবং জটিল কাজগুলি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়তে হয়, তখন সেটা ইচ্ছে করে আইনসভার কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে জেহাদি মনোভাব নিয়ে যুদ্ধ নয়, বরং সংবিধান বলে যে দায়িত্ব তার উপর অর্পিত হয়েছে সাধারণভাবে সেটারই পালন বলে গণ্য হবে। যখন এই আদালতকে সতর্ক প্রহরীর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তখন ‘মৌলিক অধিকার’ প্রসঙ্গে কথাটি বিশেষভাবে সত্য।’’
অন্য যে কোনও প্রতিষ্ঠান এবং অন্য যে কোনও দেশের মতো সুপ্রিম কোর্টও ক্ষেত্রবিশেষে হোঁচট খায়, আবার অনেক বছরের অভিজ্ঞতার নিরিখে দ্রুত উঠে দাঁড়ায়, ধুলোবালি ঝেড়ে নেয় এবং অতিকায় পদক্ষেপে এগিয়ে যায়। এই কারণে আদালতগুলি (তাদের সমস্ত রকমের অসম্পূর্ণতা বা ত্রুটি সত্ত্বেও) এবং বিশেষ করে সুপ্রিম কোর্টের মতো প্রতিষ্ঠান জনগণের সর্বোচ্চ আস্থাভাজনের মর্যাদা পাচ্ছে।
দেশের আইনের শাসনের পক্ষে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দু’টি বিচারাধীন মামলায় সুপ্রিম কোর্টের সমালোচনা আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। ওই সমালোচনাটিকে নরম করার জন্যই আমি এই দীর্ঘ মুখবন্ধ লিখলাম।
বিমুদ্রাকরণের পরাজয়
প্রথমটি হল ডিমানিটাইজেশন কেস বা বিমুদ্রাকরণ মামলা। সকলেই জানেন যে, ২০১৬ সালের ৮ নভেম্বর কেন্দ্রীয় সরকার ১০০০ এবং ৫০০ টাকার নোট দু’টিকে বেআইনি ঘোষণা করেছিল। সরকারের এই একটিমাত্র পদক্ষেপ ভারতীয় অর্থনীতিকে নিম্ন গতিপথ নির্দিষ্ট করে দিল। ২০১৭-১৮ অর্থবর্ষের শেষ ত্রৈমাসিকের গোড়াতেই দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের (জিডিপি) হার নামতে আরম্ভ করে। এবং এই পতন উপর্যুপরি সাত সাতটি কোয়ার্টারে বজায় ছিল এবং অষ্টম ত্রৈমাসিক (জানুয়ারি-মার্চ, ২০২০) নতুন এক পতন স্পর্শ করল। করোনা ভাইরাস ভারতকে আঘাত হানতেই আমাদের দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরে গেল। সবসময় মনে রাখবেন, হালফিল যে অর্থনৈতিক সঙ্কট তার সূচনা কিন্তু মহামারী এবং লকডাউনের পূর্বেই।
ডিমানিটাইজেশনকে সুপ্রিম কোর্টে এবং কয়েকটি হাইকোর্টেও চ্যালেঞ্জ জানানো হয়েছিল। ২০১৬ সালের ১৬ ডিসেম্বর প্রধান বিচারপতি ঠাকুরের নেতৃত্বাধীন তিন বিচারপতির বেঞ্চ একটি বিস্তারিত নির্দেশ জারি করেন। আদালত রিট পিটিশনগুলি গ্রহণ করেছিল, নয়টি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তৈরি করেছিল, হাইকোর্টগুলিতে ঝুলে থাকা এই সংক্রান্ত মামলাগুলি প্রত্যাহার করেছিল, অন্য আদালতগুলিকেও বারণ করে দিয়েছিল যাতে তারা বিমুদ্রাকরণ বিষয়ে মামলা গ্রহণ না করে এবং রায় না দেয়, এগুলি সাধারণ মানুষের স্বার্থযুক্ত গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হিসেবে গণ্য, তাই নির্দেশ দিয়েছিল বিষয়গুলি পাঁচ বিচারপতির সাংবিধানিক বেঞ্চ শুনবে। বিমুদ্রাকরণ মামলাটি প্রায় চার বছর যাবৎ ঠিক ওখানেই দাঁড়িয়ে রয়েছে।
সংবিধানের উপর আঘাত
অন্য মামলাটি হল জম্মু ও কাশ্মীর এবং ৩৭০ ধারা সংক্রান্ত। ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট। রাষ্ট্রপতি ৩৭০ ধারা বাতিল এবং জম্মু ও কাশ্মীরের উপর সংবিধানের সমুদয় ব্যবস্থাদি প্রযোজ্য জানিয়ে দু’টি সাংবিধানিক নির্দেশ জারি করেন। পরিণামে এক বিশাল পরিবর্তন ঘটে গেল: জম্মু ও কাশ্মীর যে বিশেষ মর্যাদা ভোগ করত সেটি বিলুপ্ত হয়ে গেল, রাজ্যটি দু’টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে বদলে গেল, একটি সম্পূর্ণ লকডাউন চাপিয়ে দেওয়া হল, বিলোপ করা হল লেজিসলেটিভ কাউন্সিল বা বিধান পরিষদ এবং বিধানসভা ভেঙে দেওয়া হল, রাষ্ট্রপতির শাসন দীর্ঘায়িত হল এবং তার দ্বারা রাজ্যপালের শাসন প্রত্যাহৃত হল, রাজ্য মানবাধিকার কমিশন-সহ সমস্ত বিধিবদ্ধ সংস্থাকে ভেঙে দেওয়া হল, কয়েকশো রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীকে আটক করা হল (যাঁদের ভিতরে মেহবুবা মুফতি এবং সৈফুদ্দিন সোজ ‘বিনা অপরাধে’ এখনও আটক রয়েছেন), স্থায়ী নিবাস সংক্রান্ত আইনগুলি (ডোমিসাইল ল’জ) আমূল বদলে ফেলা হয়েছিল, এবং অনেকগুলি অধিকার (মিডিয়া বা সংবাদ মাধ্যমের অধিকারগুলি সমেত) আজ মুলতুবি রয়েছে।
২০২০ সালের ২ মার্চের এক আদেশ বলে, বিচারপতি রামনের নেতৃত্বাধীন এক সাংবিধানিক বেঞ্চ কিছু প্রাথমিক আপত্তি খারিজ করে দেয় এবং তার মৌখিক পর্যবেক্ষণে জানায় যে, মামলাগুলি শুনানির জন্য নথিবদ্ধ করা হবে। মাঝখানে চলে এল করোনা ভাইরাস এবং ২৫ মার্চ দেশব্যাপী জারি হয়ে গেল লকডাউন। পরিণামে মামলাগুলি হিয়ারিং বা শুনানির জন্য তালিকাবদ্ধ হল না। মে মাসের ৪ তারিখ ইন্টারনেট এবং ফোর-জি’র উপর নিষেধাজ্ঞা সংক্রান্ত পৃথক একটি মামলায় আদালত একটি আদেশ জারি করল।
এই বিশেষ নিবন্ধের মোদ্দা বক্তব্য হল, সুপ্রিম কোর্টের সতর্ক প্রহরী থাকার যে স্থিরসঙ্কল্প সেটি বারংবার পরীক্ষিত হতে থাকবে। তার দায়িত্বপালন থেকে আদালত অবশ্যই বিচ্যুত হবে না, কখনওই না।
সাম্প্রতিক কালে সমান গুরুত্বপূর্ণ অন্যকিছু ইস্যুও আদালতের গোচরে আনা হয়েছে—কিন্তু সেগুলি ‘হ্যাপেনিং ইভেন্টস’ বলে আজ কোনও মন্তব্য করছি না, অন্য একদিন বলব বলে রেখে দিচ্ছি। সমস্ত নাগরিকের একান্ত প্রার্থনা এই যে, ‘প্রধান বিচারপতি পতঞ্জলি শাস্ত্রী যে মহান দায়িত্ব স্থির করে দিয়ে গিয়েছেন, ভারতের উচ্চতর আদালতগুলি সবসময় তেমনই জাগ্রত ও নিরপেক্ষ থাকবে।’