দীর্ঘমেয়াদি সঞ্চয় ও ব্যবসা থেকে অর্থাগম যোগ। প্রেমের প্রস্তাব পেতে পারেন। পুজো পাঠে মন। ... বিশদ
‘ল্যাপটপ নিয়ে কাজ করতে পারছি না। ছেলে যখন ঘুমোয় তখন অফিসের কাজ করি। ঘুম ভাঙলেই হামলে পড়ছে ল্যাপটপের উপর। আগে মোবাইল নিয়ে খেলত। মোবাইল একঘেয়ে হয়ে গিয়েছে। এখন ওর টার্গেট ল্যাপটপ। মাঝেমধ্যে রেগে গিয়ে মারধরও করে ফেলছি। জানি, কাজটা ঠিক হচ্ছে না। কিন্তু, পারছি না। বিশ্বাস করুন, ছেলে জেগে থাকলে বাথরুমে বসে অফিসের কাজ করছি। একদিন বাথরুম থেকে বেরতে দেরি হওয়ায় এমন দরজা ধাক্কা দিতে শুরু করল যে, স্টেশনে গিয়ে কাজ করতে হল।’ সাড়ে তিন বছরের ছেলের কথা বলার সময় বেসরকারি সংস্থার কর্মী সন্তু নিজেই যেন কেমন অস্থির হয়ে যাচ্ছিলেন।
‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’। বাড়িতে বসে অফিসের কাজ। এমন কাজে ভীষণ লোভ ছিল অরূপের। কারণ অরূপের চাষ আর বাস ভিন্ন জায়গায়। বাড়িতে বৃদ্ধ বাবা, মা, স্ত্রী আর দু’টি বাচ্চা। একজনের বয়স ৪, অন্যজন ১১। স্ত্রী স্কুলে পড়ান। আর অরূপ বেসরকারি সংস্থার কর্মী। বাড়ি বলতে সপ্তাহে একদিন। বাড়ির সারা সপ্তাহের কাজ ওই ছুটির দিনেই। ছুটি তো নয়, আসলে ছুটোছুটি। ফুড়ুত করে পালিয়ে যায় সাপ্তাহিক ছুটির দিনটা। তাই আইটি সেক্টরে, বিদেশে ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’-এর গল্প শোনার সময় অরূপের চোখ জ্বল জ্বল করে উঠত। বলত, আহা, এমনটা আমাদের হয় না কেন?
করোনা অরূপের জীবনে সেই সুযোগটাই এনে দিয়েছে। অরূপের এখন ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ চলছে। কেমন আছে অরূপ? অরূপ বলে, দাদা, বাড়ি আর এখন বাড়ি নেই, মনে হচ্ছে যুদ্ধক্ষেত্র। কাজের লোকের সবেতন ছুটি চলছে। তাই ঘর মোছা থেকে রান্না, বাসন মাজা, সবই করতে হচ্ছে নিজেদের। চাপের চোটে সকলের মেজাজ সপ্তমে বাঁধা। তার উপর ছেলে দু’টোর বায়না দিন দিন বাড়ছে। স্কুল বন্ধ, খেলা বন্ধ। সব সময় বাড়িতে। কেমন যেন জেদি হয়ে যাচ্ছে। রেগে যাচ্ছে, জিনিসপত্র ছুঁড়ে ফেলছে, ভাঙছে। উঠতে বসতে মারও খাচ্ছে। এক যাচ্ছেতাই কাণ্ড। তার উপর ‘অন লাইন ক্লাস’-এর ফ্যাচাং। মোবাইল নিয়ে রীতিমতো কাড়াকাড়ি চলছে। শুরু হয়েছে মোবাইলে গেম খেলা। ছেলেদের মোবাইলের নেশা ছিল না। লকডাউনে সেটাও ধরে গেল। জানি না, এর শেষ কোথায়?
বিদ্যালয় তো শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়। বিদ্যালয় বাড়ির বাইরে একটা বৃহত্তর বাড়ি। সেখানে শিক্ষকদের স্নেহ, ভালোবাসা, অনুশাসনের পাশাপাশি আছে বন্ধুর স্পর্শ, খুনসুটি, আরও অনেক কিছু। বিদ্যালয় স্বাধীনতার অঙ্গন। বাবা, মায়ের আঙুল ছেড়ে নিজের মতো করে পরিচালনার পাঠ শুরু
হয় এখানেই। স্কুল থেকে ফিরে ঘুম, খেলার মাঠ অথবা পার্ক। তারপর সন্ধ্যায় বাড়িতে পড়তে বসা, অথবা শিক্ষকের কাছে পড়তে যাওয়া। দিনের প্রায় ৮০ ভাগ সময়ই কাটত স্কুল আর স্কুলের পড়াশোনা নিয়ে। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর, এটাই ছিল অভ্যেস। ছাত্রজীবনের এটাই
নিয়ম। কিন্তু, একটা সুইচেই বন্ধ হয়ে গেল বৃহত্তর বাড়ির দরজাটা।
লকডাউন। আচমকাই স্কুলে ঝুলল তালা। বন্ধ হয়ে গেল অনাবিল মুক্তি আর আনন্দের প্রাঙ্গণটি। হারিয়ে গেল বন্ধুরা। হারিয়ে গেল টিফিন ভাগ করে খাওয়া, কেড়ে খাওয়ার আনন্দ। হারিয়ে গেল জীবনের বৈচিত্র্য। জীবনের আসল রং তো লুকিয়ে আছে বৈচিত্র্যের মধ্যেই। তা না থাকলে জীবন বিবর্ণ, ফ্যাকাসে, একঘেয়ে। আট থেকে আশি সকলেরই। জীবনের ঘাত প্রতিঘাত মানুষকে করে অভিজ্ঞ। তাই বড়রা কঠিন পরিস্থিতি মানিয়ে নিতে পারেন। কিন্তু, শৈশব, কৈশোর তা পারে না। তাই একটু এধার ওধার হলেই তারা হয়ে ওঠে বিদ্রোহী।
ভঙ্গুর যৌথ পরিবার ভাঙতে ভাঙতে আজ নিউক্লিয়ার। বেশিরভাগ পরিবারে সদস্য সংখ্যা তিন অথবা চার। লকডাউনের প্রথম প্রথম সব কিছুই ছিল বেশ অন্যরকম। হাতে হাতে উঠে যাচ্ছিল বাড়ির সমস্ত কাজ। সন্তানরাও সর্বক্ষণ পাচ্ছিল তাদের বাবা, মাকে। আনন্দে ভরে উঠেছিল গৃহকোণ। কিন্তু, লকডাউন লম্বা হতেই চার দেওয়ালের বন্দি জীবনে ফিরে এল সেই একঘেয়েমি। হারিয়ে গেল বৈচিত্র্য। তাই অনেকের কাছেই লকডাউন হয়ে উঠেছে অভিশাপ। তবে, বৈচিত্র্য ফিরিয়ে আনতে পারলেই অভিশাপ হয়ে উঠবে আশীর্বাদ। আনন্দকে উপলব্ধি করতে পারলেই কমে যায় যন্ত্রণা। তাই লকডাউনের বন্দি জীবনের কষ্টকে বড় করে না দেখে, সুযোগগুলো কাজে লাগাতে হবে।
মনরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক মহুয়া জানা দুবের স্বামীও চিকিৎসক। দু’জনেই সরকারি হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত। থাকেন ভিন্ন ভিন্ন জায়গায়। রান্নার জন্য সহযোগী থাকলেও হাসপাতালে ডিউটির পাশাপাশি দুই শিশুসন্তানকে সামলান তিনিই। দু’টি শিশুর দিনের অনেকটা সময় কাটে বাবা মাকে ছাড়াই। তবুও তিনি মোবাইলকে সন্তানদের খেলনা হতে দেননি। বুঝিয়েছেন, মোবাইল খেলনা নয়, কাজের জিনিস।
মহুয়াদেবী বলেন, আমরা যে অবস্থাটার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি, সেটা আমাদের সকলের কাছেই নতুন। ছোটরা, বড়রা, আমরা চিকিৎসকরা, সকলেই চাপে আছি। তাই পা ফেলতে হবে সন্তর্পণে। তাঁর কথায়, লকডাউন যেমন যন্ত্রণার, তেমনই একটা সুযোগও। এই সময় আনন্দের উপকরণগুলো বাচ্চাদের নাগালের বাইরে। তাই পড়াশোনার খুব বেশি চাপ না দেওয়াই ভালো। গান, নাচ, ছবি আঁকা, কবিতা, যে যেটা পছন্দ করে, তাতেই তাকে উৎসাহ দিতে হবে। তবে, কাজের চাপ সামলে সন্তানদের সময় দিতেই হবে। সৃষ্টির আনন্দে ভরিয়ে দিতে হবে শিশুমন। সেটা করতে পারলেই লকডাউন হয়ে উঠবে আশীর্বাদ।
যে কোনও সৃষ্টির পিছনেই থাকে যন্ত্রণা। মুক্তোর অপরূপ সৌন্দর্যে আমরা মুগ্ধ হই। সেই মুক্তো তো যন্ত্রণারই ফসল। পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর হল শিশু। মাতৃজঠর ছিন্ন ভিন্ন করে সেই শিশু যখন পৃথিবীর আলো দেখে তখন মাকেও সহ্য করতে হয় তীব্র যন্ত্রণা। যন্ত্রণার মধ্যেই লুকিয়ে থাকে সৃষ্টির আনন্দ। লকডাউনের বন্দি জীবনে যন্ত্রণা যেমন আছে, তেমনই আছে সৃষ্টির উপাদান। যন্ত্রণাকে উপেক্ষা করে মেতে উঠতে হবে সৃষ্টি সুখের উল্লাসে।
বন্দি জীবনে সৃষ্টি সুখের উল্লাসে মেতে ওঠার রাস্তা আমাদের দেখিয়ে গিয়েছেন নজরুল ইসলাম। সালটা ১৯২৩। কবির তখন দিন কাটছে প্রেসিডেন্সির জেলে। তরোয়ালের চেয়েও তীক্ষ্ণ তাঁর লেখনি প্রতিনিয়ত ব্রিটিশ শাসকদের করছিল ক্ষতবিক্ষত। উত্তাল হচ্ছিল ইংরেজ খেদাও আন্দোলন। কবিকে ক্ষান্ত করার কোনও রাস্তা না পেয়ে তাঁকে নিক্ষেপ করা হয়েছিল কারাগারে। বন্দি ছিলেন এক বছর। কিন্তু, বন্দি জীবন কেড়ে নিতে পারেনি কবির মনের বিদ্রোহের আগুন, দমিয়ে দিতে পারেনি তাঁর সৃষ্টির শক্তিকে। কারাগারে বসেই তিনি লিখেছিলেন, ‘আজকে আমার রুদ্ধ প্রাণের পল্বলে/ বান ডেকে ঐ জাগল জোয়ার দুয়ার-ভাঙা কল্লোলে/ আসল হাসি, আসল কাঁদন/ মুক্তি এলো, আসল বাঁধন/ মুখ ফুটে আজ বুক ফাটে মোর তিক্ত দুখের সুখ আসে/ ঐ রিক্ত বুকের দুখ আসে/ আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে।’
স্বাধীনতার ৭৩ বছর পরেও রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শরৎচন্দ্র, বিবেকানন্দই আমাদের বেঁচে থাকার শক্তি, লড়াইয়ের প্রেরণা। তাঁদের অমরসৃষ্টি, তাঁদের জীবনদর্শন আমাদের যুদ্ধজয়ের সাহস জোগায়। ১২ মাসের বন্দি জীবন, গোরা পুলিসের অত্যাচারেও তিনি ভেঙে পড়েনি। কারারুদ্ধ জীবনে বদ্ধ জলাশয়েও তিনি আনতে চেয়েছিলেন জোয়ার। কবির রিক্ত, শূন্য হৃদয় ভেসে যেতে চেয়েছিল সৃষ্টি সুখের উল্লাসে। সেই বিদ্রোহী কবিই হোন আমাদের লকডাউনের যন্ত্রণাকে উপেক্ষা করার আদর্শ, সৃষ্টি সুখের উল্লাসে মেতে ওঠার প্রেরণা।