দীর্ঘমেয়াদি সঞ্চয় ও ব্যবসা থেকে অর্থাগম যোগ। প্রেমের প্রস্তাব পেতে পারেন। পুজো পাঠে মন। ... বিশদ
সবথেকে বড় দুর্ভাগ্য হল, বাঙালি নিজেই সেই দুর্দশাকে মনে রেখে সামগ্রিকভাবে রাজ্যের উন্নয়নে ঝাঁপিয়ে পড়ছে, এরকম দেখা যায়নি। বরং প্রতিটি সর্বনাশের পরই বাংলার অভ্যন্তর থেকেই সবথেকে বেশি প্রতিবন্ধকতা ও অন্তর্ঘাত এসেছে। যে ট্র্যাডিশন এখনও চলছে। আর বহিরাগত শাসক বরাবরই এই সুযোগটা নিয়ে বাঙালিকে নানারকমভাবে বিভাজিত করার ইন্ধন দিয়েছে। কখনও সম্প্রদায়গতভাবে, কখনও রাজনৈতিক। সেই ফাঁদে বাঙালির একটি অংশ পা দিয়েছে বরাবর। বাংলার সর্বনাশে দেশ উদাসীন, এই প্রবণতা মোটেই নতুন নয়। মন্বন্তর, দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা, দেশভাগ। ১৭৭০ সাল থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত সময়সীমায় প্রধানত এই চারটি মহাসঙ্কট বাঙালি জাতিকে বারংবার অগ্রসর হওয়া থেকে পিছিয়ে দিয়েছে। বিদেশি শাসক, রাজনৈতিক স্বার্থান্বেষীরা তো বটেই, প্রকৃতিও ভারতের এই পূর্ব প্রান্তের প্রতি বহুবার নির্দয় আচরণ করেছে।
১৭৬৮ সালে শেষবার সামান্য হলেও একটু বৃষ্টি হয়েছিল। ১৭৬৯ সালে প্রায় হলই না। অক্টোবর মাসেই মুর্শিদাবাদ থেকে কলকাতায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাউন্সিল অফিসে খবর আসতে শুরু করল, মানুষ নাকি না খেতে পেয়ে মারা যাচ্ছে। ধানের চাষ হয়নি। চরম খরা। নভেম্বর মাসে চাষিরা জানিয়ে দিল, তুঁতে আর তুলোচাষও করা যাবে না। জল নেই। যা সাধারণত ধানের পর করা হয়। ডিসেম্বর মাসে মুর্শিদাবাদের প্রশাসক রেজা আলি খান কলকাতায় কোম্পানি অফিসে চিঠি পাঠিয়ে বললেন, পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গিয়েছে যে, মানুষ চাল কেনার জন্য সন্তান বিক্রি করতে শুরু করেছে। সবথেকে বেশি অনাহারে মারা যাচ্ছে ভূমিহীন মজুর, মাঝি, ক্ষুদ্রশিল্পীরা। কেউ কিছু করেনি। ১৭৭০ সাল। ফেব্রুয়ারি মাসে চালের দাম ১০ গুণ বৃদ্ধি পেল। তখন আর মন্বন্তর আটকে নেই মুর্শিদাবাদে। কলকাতার রাস্তায় আছড়ে পড়ছে মানুষ। হেঁটে হেঁটে চলে আসছে গ্রামগঞ্জ থেকে ক্ষুধার্ত। জুলাই থেকে নভেম্বর, এই চার মাসে শুধু কলকাতার রাস্তায় কতজন মারা গেল অনাহারে? ৭৬ হাজার! কোম্পানি থেকে বলা হয়েছিল যারা রাস্তা থেকে মৃতদেহ সরিয়ে গঙ্গায় ফেলবে, তারা চাল পাবে। মৃতদেহ সরানোর প্রতিযোগিতা শুরু হয় নিম্নবর্গের বাঙালির মধ্যে। শুধু মন্বন্তর? বাংলার ভাগ্যকে ধ্বংস করতে তার আগেই হাজির হয়েছিল স্মল পক্স। শুধু মুর্শিদাবাদ সংলগ্ন বিস্তীর্ণ অঞ্চল থেকে এসেছিল ৬৩ হাজার মৃত্যুর খবর। স্বয়ং ছোট নবাব সঈফ-উদ-দৌল্লার মৃত্যু হয় স্মল পক্সে। অচিরেই ১২ লক্ষ মানুষের মূত্যু হয়েছিল মন্বন্তরে। বিচ্ছিন্নভাবে কিছু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাহেব শস্যের ভাণ্ডার খুলে দিলেও কোম্পানি এই সময়টায় কী করেছিল? খাজনা আদায় বাড়াতে সেপাইয়ের সংখ্যা বাড়িয়ে দেয়। ডিফেন্স বাজেট ২ কোটি পাউন্ড থেকে বাড়ানো হয় ৪৪ শতাংশ। যারা খাজনা দিতে পারেনি অথবা বাধা দিয়েছে, তাদের গাছে গাছে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এর ফলশ্রুতি কী? ১৭৭০-৭১ সালে কোম্পানি তাদের লন্ডন হেড কোয়ার্টারে ১০ লক্ষ ৮৬ হাজার ২৫৫ পাউন্ড ট্যাক্স সংগ্রহ ট্রান্সফার করেছিল। সমস্ত চাল বাজেয়াপ্ত করে বিপুল অর্থ মুনাফা হয়ে গেল ছ’মাসে। যা ছিল রেকর্ড। বাঙালির মৃত্যুও হয়েছিল রেকর্ড। বাংলার মানবসম্পদের বিপুল অংশ ধ্বংস হয়ে গেল অনাহারে।
১৯৪২ সালের ৭ মার্চ, রেঙ্গুন প্রায় জনশূন্য। কারণ জাপানের আক্রমণ। বার্মার চাল বাংলায় নিয়ম করে এসেছে। কিন্তু সেইদিন থেকে বার্মার ওই বিপুল চালের স্টোরেজ ভারতের জন্য বন্ধ হল। ওদিকে সমুদ্র আর স্থলপথে দলে দলে মানুষ ও ব্রিটিশ সেনা বার্মা থেকে পালিয়ে ভারতে ফিরছে। এদের সিংহভাগ কোথায় এসে থাকছে? কিছু অসম, বেশিটাই বাংলায়। প্রথম ছ’মাসে বাংলা নিজের জনসংখ্যাকে ছাপিয়ে প্রতিদিন অতিরিক্ত এই ৫ লক্ষ মানুষ ও সেনাকে খাইয়েছে। বাংলার ভাণ্ডারে থাকা অতিরিক্ত কত টন শস্য এভাবে খরচ হয়েছে? দেড় লক্ষ টন! বাকি ভারতের গায়ে কিন্তু আঁচ পড়ছে না। বরং উলটে ভারত থেকে বিদেশে ১৯৪২ সালে ৩ লক্ষ ১৯ হাজার টন চাল রপ্তানি করে দেয় ব্রিটিশ সরকার। পাশাপাশি জাপানকে আটকাতে কী সিদ্ধান্ত নেওয়া হল? ডিনায়াল পলিসি। বাংলার জেলায় জেলায় জোর করে ধান-চাল কিনে নিতে শুরু করল সরকার। না দিতে চাইলে ছিনিয়ে নেওয়ার হুমকি। প্রাথমিক ধাক্কা খুলনা, মেদিনীপুর আর বরিশালে। শুধু এই তিন জেলা থেকেই ৩০ হাজার টন চাল নিয়ে নেওয়া হল। আর ৫ হাজার টন পাঠিয়ে দেওয়া হয় বাংলার বাইরে। আর এক ধ্বংসাত্মক নীতি। নৌকা অপসারণ। জাপানিরা যাতে নৌকা না পায়, অগ্রসর হতে না পারে, তাই হাজার হাজার নৌকা সাধারণ মানুষের থেকে কেড়ে নেওয়া হল এবং ধ্বংস করা হল। পাঁচ মাসে অন্তত ৪৬ হাজার নৌকা ধ্বংস হল। নৌকা মানে কি? নৌকা মানে নদীমাতৃক বাংলায় চাষ করতে যাওয়া, বীজ আনা-নেওয়া, লেবারদের আসা যাওয়া, মাছ ধরা। অর্থাৎ জীবনযাপনের প্রাথমিক ভিতটাই ধ্বংস। চাষিরা নিজেদের খাবার চাল না রেখেই সরকারকে ভয়ে ভয়ে সব চাল দিয়ে দিতে বাধ্য হল। এসব চাল কোথায় গেল? ২৫ মার্চ ১৯৪৩ সালে বাংলার বিধানসভায় রাজস্বমন্ত্রী প্রমথনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় একটি প্রশ্নের উত্তরে জানালেন, সরকারের কোনও ধারণাই নেই যে, কীভাবে এজেন্টদের মাধ্যমে গভর্নর চুক্তি করেছিলেন। এমনকী বাংলা থেকে চাল বাইরে রপ্তানি করে দেওয়া হয়েছে এটাও প্রদেশ সরকারের অগোচরে হয়েছে। গভর্নরের নাম ছিল জন আর্থার হার্বার্ট। ব্রিটিশ সরকারের দিল্লির ভাইসরয় অথবা ভারতের সব প্রদেশের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে দেশ উত্তাল করে দিতে দেখা যায়নি। যদিও জাতীয় কংগ্রেসের সিংহভাগ নেতা তখন জেলবন্দি। কিন্তু অন্য কোনও প্রদেশ থেকে কংগ্রেস অথবা কংগ্রেস বিরোধী কোনও দলের নেতানেত্রীকে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখা যায়নি বাঙালির দুঃসময়ে। ১৯৪৩ সালের সেই দুর্ভিক্ষে ভাতের জন্য কী দেখা গিয়েছিল? চলন্ত ট্রেনের সামনে সন্তানকে ছুঁড়ে ফেলেছে বাবা। স্বামীরা স্ত্রীকে, বাবারা মেয়েকে ঠেলে দিয়েছে শরীর বিক্রি করে চাল আনার জন্য। বগুড়া, জলপাইগুড়িতে দেখা গিয়েছে, গাছের পাতা খেয়ে মারা যাচ্ছে বহু মানুষ। এবং কলকাতার রাস্তায় যখন গড়ে ১২০ জন করে মারা যাচ্ছে অনাহারে, তখন অশোককুমারের ‘কিসমৎ’ হাউসফুল ‘রক্সি’ সিনেমা হলে। কিসমতের ১৯৪৩ সালের বক্স অফিস কালেকশন ছিল ১ কোটি ২৩ হাজার টাকা। ৩০ লক্ষ বাঙালির মৃত্যু হয়েছিল ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষে। মুনাফা করেছিল মজুতদার আর ব্যবসায়ীরা। ভারত ছিল উদাসীন।
মাত্র তিন বছরের মধ্যে ১৯৪৬ সালে কলকাতা আর বাংলায় ছড়িয়ে পড়ল দাঙ্গা। বাংলা একপ্রকার শ্মশান হয়ে যাচ্ছে। নোয়াখালি থেকে কলকাতা। থামেনি সেই দাঙ্গা। ১৯৫০ সালে আবার। লাগাতার। কিন্তু বাকি প্রদেশগুলির হস্তক্ষেপ কোথায়? কেন্দ্রীয় সরকার কতটা মরিয়া হয়ে ঠেকাচ্ছে? আর কারাই বা বাংলার সর্বনাশ ঠেকানোর চেষ্টা না করে শুধু আরও বেশি করে দাঙ্গায় প্ররোচনা দিয়ে চলেছে ওই সময়টায়? এসবই ইন্ধন এসেছে বাংলার বাইরে থেকে। বাকি সব রাজ্য তখন নতুন স্বাধীনতায় কেন্দ্র থেকে বেশি আর্থিক প্যাকেজ জোগাড় করে রাজ্যটাকে সাজিয়ে নিতে আগ্রহী। আর বাংলা ডুবছে অন্ধকারে।
১৯৫০ সালের পর শিয়ালদহ, এসপ্ল্যানেড, ডালহৌসি স্কোয়ারের রাস্তায় রাস্তায় দেখা গেল দু’-চারজন করে যুবতী হাতে বাক্স নিয়ে চাঁদা তুলছেন। উদ্বাস্তু সম্মিলিত বিদ্যালয়ের জন্য। তাদের দেখে কেউ এগিয়ে এসে পয়সা দিয়েছে। কেউ কেউ ব্যঙ্গ করে বলেছে, সবটাই ধাপ্পা। এই যুবতীরা কেউ ছিল ময়মনসিংহে স্কুলশিক্ষকের মেয়ে, কারও বাবা ছিলেন পাবনার উকিল। এরকম ভিক্ষাবৃত্তির অভ্যাস নেই। তবু এই অপমান সহ্য করে তারা কলোনির স্কুলের বইখাতা কেনা কিংবা স্ট্রাকচার করার জন্য টাকা তুলেছেন চোখের জল লুকিয়ে। দাঁতে দাঁত চেপে। বিধানচন্দ্র রায় এরপরই উদ্যোগী হন উদ্বাস্তুদের স্কুলের জন্য। ১৯৪৯ সালে উদ্বাস্তুদের স্কুলের সংখ্যা ছিল ৩৪০। সেটাই ১৯৬০ সালে বেড়ে হয় ১৪০০। কোথায় তখন কেন্দ্রীয় সরকার? কোথায় বাকি ভারত?
১৯৫০ সালের অক্টোবর মাসে বিধানসভায় মুখ্যমন্ত্রী জানান, ৩২ লক্ষ উদ্বাস্তু এসেছে। সেই বছরের ১৯ মার্চ সংসদ সদস্যা রেণুকা রায় সংসদে বললেন, পশ্চিমবঙ্গের মতো একটি ছোট্ট রাজ্যে এত উদ্বাস্তু এসেছে। আমাদের একার পক্ষে কি এই বিপুল চাপ সহ্য করা সম্ভব? ভারতের অন্য রাজ্য কেন ভাগ করে নেবে না? জওহরলাল নেহরু ও বল্লভভাই প্যাটেল তার আগেই অবশ্য বিভিন্ন রাজ্যের সঙ্গে কথা বলে উদ্বাস্তুদের ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু প্রশ্ন হল, কটা রাজ্য নিয়েছে উদ্বাস্তুদের ভার? পাঞ্জাব থেকে দিল্লিতে আসা উদ্বাস্তুদের আজকের আর্থিক স্ট্যাটাস আর বাংলার উদ্বাস্তুদের স্ট্যাটাসে এখনও বিরাট ফারাক। সব চাপ নিতে হয়েছে একা বাংলাকে। শুধু ব্যতিক্রম হিসেবে দণ্ডকারণ্য এবং আন্দামান রয়েছে। অর্থাৎ এই দুই জনমানবশূন্য স্থানে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল উদ্বাস্তুদের। দেশ ছিল উদাসীন।
আজ সাইক্লোন আসার পর গোটা দেশ অথবা কেন্দ্রীয় সরকার তাই ইতিহাসগতভাবেই নির্লিপ্ত। গোটা রাজ্যের বহু অংশ ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে। ৬ কোটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত। কিন্তু প্রাথমিকভাবে কেন্দ্রীয় সরকার কত টাকা সাহায্য করল? ১ হাজার কোটি টাকা। বাকি ক্ষতিপূরণ হিসেবপত্র করে দেওয়া হবে বলে জানানো হয়েছে। কেন শুরুতে আরও বেশি দেওয়া গেল না? ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় ১৯৪৯ সালে জওহরলাল নেহরুকে একটি চিঠি লেখেন অত্যন্ত ক্ষোভ ও দুঃখের সঙ্গে। চিঠিতে বলেছিলেন, আপনি যে টাকা বাংলায় আসা ১৬ লক্ষ উদ্বাস্তুর জন্য বরাদ্দ করেছেন, সেটা পাঞ্জাবের উদ্বাস্তু তহবিলের তুলনায় অনেক কম। মাথাপিছু ২০ টাকা হয়! ৭৩ বছর পর উম-পুন নামক একটি সাইক্লোনে সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকার বাংলাকে যে আর্থিক সাহায্য প্রাথমিকভাবে দিয়েছে, সেটা ৬ কোটি ক্ষতিগ্রস্তর জন্য বরাদ্দ ধরা হলে, মাথাপিছু পড়ে ১৬৬ টাকার মতো। অথচ অন্তহীন মানুষ আজ অর্থ, খাদ্য, বাসস্থানে নিঃস্ব।
সুতরাং, মন্বন্তর, দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা, দেশভাগ কিংবা উম-পুন...। বাংলার সর্বনাশে দেশ চিরকালই উদাসীন।