দীর্ঘমেয়াদি সঞ্চয় ও ব্যবসা থেকে অর্থাগম যোগ। প্রেমের প্রস্তাব পেতে পারেন। পুজো পাঠে মন। ... বিশদ
শুক্রবারই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হেলিকপ্টারে প্রধানমন্ত্রীকে রাজ্যের বিস্তীর্ণ দুর্গত এলাকা ঘুরিয়ে দেখিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীও ভয়ঙ্কর অবস্থা নিজের চোখে দেখে রাজ্যের জন্য ১ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করেছেন। বাংলার এই দুর্দিনে জানিয়েছেন সমবেদনা। কিন্তু ওইটুকু অর্থে কী হবে? মুখ্যমন্ত্রী নিজেই হিসেব দিয়েছেন, ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১ লক্ষ কোটি টাকার। এক হাজার কোটি টাকা তো সেখানে নস্যি। তার উপর রাজ্যের প্রাপ্য ৫৩ হাজার কোটি টাকা এখনও মেটায়নি কেন্দ্র। করোনা মোকাবিলার জন্যও মেলেনি আলাদা কোনও সাহায্য। বুলবুলের ক্ষতিপূরণ পেতে রাজ্যকে কতটা নাকাল হতে হয়েছে, তা তো রাজ্যবাসীর অজানা নয়। কিন্তু এবার চ্যালেঞ্জটা অনেক বড়। এই দুর্দিনেও কেন্দ্র যদি মুখে এক আর কাজে আর এক করে, তবে মানুষ ক্ষমা করবে না, কেন্দ্রের সরকার বাহাদুর যেন তা মনে রাখেন। আর ক্ষুদ্র, সংকীর্ণ রাজনীতির শিকার বাংলা তো গত একশো বছরে বারবার হয়েছে, কিন্তু কোনও কিছুই তার অদম্য গতিকে রোধ করতে পারেনি। এবারও পারবে না।
অথচ এত বড় বিপদ যে দরজায় কড়া নাড়ছে, তা কয়েকমাস আগে আমাদের কল্পনাতেও ছিল না। গোটা একটা বছর যে এভাবে সর্বনাশে ডুবে যাবে, তা মার্চ মাসের গোড়াতেও আঁচ করা যায়নি। করোনা নামটা যেমন ৬-৭ মাস আগেও মানুষের কাছে অজানা-অচেনা ছিল, তেমনি ‘উম-পুন’এর কথা তো দু’দিন আগেও কেউ শোনেনি। শক্তিশালী ঝড় হয়তো আগেও হয়েছে, প্রাণহানি, ক্ষয়ক্ষতি, সব হারানোর কান্না আগেও বহু মানুষের দু’চোখের পাতা এক করতে দেয়নি। একেবারে শূন্যতে টেনে নামিয়েছে শতশত পরিবারকে। আইলা, ফণী, বুলবুলের ভয়ঙ্কর আঘাত এখনও হয়তো দুঃস্বপ্নের ভয়াল স্মৃতি হয়েই চেপে বসে আছে, কিন্তু বিশ্বব্যাপী মহামারীর মধ্যেই সর্বনাশী সাইক্লোন যে এভাবে দুমড়ে মুচড়ে দেবে পশ্চিমবঙ্গের একের পর এক জেলাকে, তা কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। সকাল থেকে রাত, এতটা সময় ধরে এমন মারণ ধ্বংসলীলা সুন্দরবন, হিঙ্গলগঞ্জ, পাথরপ্রতিমা সহ রাজ্যের বিশাল অংশের মানুষ আগে দেখেছে বলেও মনে করতে পারছেন না। বুধবার দুপুর থেকে রাত, টানা প্রায় ৬-৭ ঘণ্টা যেন দাপিয়ে বেড়াল ‘উম-পুন’ নামক হঠাৎ জেগে ওঠা সুপার সাইক্লোনের স্বার্থপর দৈত্য। সঙ্গে ব্যাপক বৃষ্টি। উথাল পাতাল বড় বড় গাছ গাছালি। ঠিক যেন বিরামহীনভাবে কোনও চাপা আক্রোশে বারবার ঝাঁপিয়ে পড়ে সবকিছুকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়ার উন্মত্ত বাসনাকে চরিতার্থ করার চেষ্টা প্রকৃতির। উত্তাল সমুদ্রের মতো কোথাও সর্বোচ্চ দেড়শো তো কোথাও ১৩০ কিলোমিটার বেগে একের পর এক ঝড়ের ঢেউ ধেয়ে আসছে। যার অভিঘাতে হাজারে হাজারে কাঁচা বাড়ি ধূলিসাৎ। খোদ কলকাতার বুকেও হাজারের বেশি পাকা বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত। পাকা বাড়ির কার্নিশ ভেঙে, দরজা জানলা উড়ে গিয়ে, বড় বড় গাছ পড়ে তছনছ অবস্থা। বিদ্যুৎ নেই, জল নেই, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। প্রাণান্তকর অবস্থা।
টানা লকডাউনে রাজ্যবাসীর এমনিতেই মনোবল তলানিতে। কাজ নেই, ব্যবসা নেই, চাকরিও থাকবে কি না অনিশ্চিত। স্কুল কলেজ দু’মাসের উপর বন্ধ। চারদিকে শুধু স্বপ্নভঙ্গের বেদনা। চাপা দীর্ঘশ্বাস। অ্যাকাডেমিক ক্যলেন্ডার বিপর্যস্ত। মে মাস শেষ হতে চললেও দ্বাদশ শ্রেণীর পরীক্ষা শেষ হয়নি। জয়েন্ট পরীক্ষা পিছিয়ে জুনে। অন্যবার এই সময় ভর্তি শুরু হয়ে যায়। নতুন বই, নতুন পড়াশোনায় বুক বাঁধে ছেলেমেয়েরা। এবার সব শিকেয়। রং হারিয়ে সব কেমন যেন বিবর্ণ, ধূসর। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শিক্ষা ব্যবস্থা। শহরে অনলাইন ক্লাস শুরু হয়েছে। কিন্তু বাংলার গরিব গ্রামে, যেখানে ছেলেমেয়েদের স্কুলে এখনও বসতে দেওয়ার ব্যবস্থাটুকুই নেই, সেখানে ডিজিটাল শিক্ষার স্বপ্ন কি অলীক কল্পনা নয়!
কিন্তু বিধ্বস্ত হলেও অসহায়ভাবে হাল ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নন পশ্চিমবঙ্গের মানুষ। বিশেষত আমাদের বাংলার অবিসংবাদী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। গত ন’বছর শুধু অদম্য সাহস, নাছোড়বান্দা উদ্যম আর আপসহীন মাথা উঁচু করে চলার মানসিক জোরকে সম্বল করেই মা-মাটি-মানুষের নেত্রী কেন্দ্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন। বাংলাকে একের পর এক বিপদ থেকে উদ্ধার করেছে তাঁর হার না মানা জেদ। গত ৬ বছর কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদি সরকারের সঙ্গে কার্যত সম্মুখ সমর চলছে বাংলার জননেত্রীর। মোদির দল যেনতেন অশান্তি, অস্থিরতা তৈরি করে রাজ্যকে টালমাটাল করতে মরিয়া। রাজ্য বিজেপির সঙ্গে যোগ্য সঙ্গত করছেন মহামান্য রাজ্যপালও। মহামারীর ভয়ঙ্কর দিনে সেই অসহযোগিতার চূড়ান্ত ক্লাইম্যাক্স দেখেছে রাজ্যবাসী। করোনা মোকাবিলায় রাজ্যকে অর্থসাহায্য তো দূরস্থান, কখনও কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি পাঠিয়ে, আবার কখনও রাজ্যের দেওয়া যাবতীয় তথ্যকে উপহাস করে বিজেপির নেতারা মমতার নেতৃত্বাধীন বাংলার সরকারের ভাবমূর্তিকে কালিমালিপ্ত করার চেষ্টা করেছে। অথচ জিএসটির প্রাপ্য টাকা পেলেই করোনা মোকালিায় আরও ফলপ্রসূ ভূমিকা নিতে পারত মমতার সরকার। তা না করে দিল্লি থেকে এই দুঃসময়ে রাজ্য সরকারকে বারবার হতোদ্যম করার পথই বেছে নেওয়া হল। কেন্দ্রের মন্ত্রী-সান্ত্রীরা পর্যন্ত যা খুশি বলছেন। সরকার করোনা নিয়ে ভুল তথ্য দিচ্ছে বলেও তারা অন্যায় তোপ দাগছে। যেন গোটা কেন্দ্রীয় সরকারের একটাই কাজ মমতার সরকারের ব্যর্থতাকে যে কোনওমূল্যে সামনে আনা ও জনগণের সামনে তা তুলে ধরা। কিন্তু এই ভয়ঙ্কর সময়েও কি রাজনীতিই সব। এ রাজ্যের বিরোধী শক্তির কি আর কোনওদিন চেতনা হবে না। এটা ভোটের সময় নয়। এই বিপদের সময় সঙ্কীর্ণ লাভ ক্ষতি ভুলে সবাইকে রাজ্যের হিতে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়, এটাই সংসদীয় রাজনীতির শিক্ষা। এমন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মধ্যে যাবতীয় বিভেদ ভুলে প্রতিটি রাজনৈতিক দলের উচিত ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করা। আর অগ্নিকন্যা মমতা যতদিন আছেন এই বাংলার ক্ষতি করা মোটেও খুব সহজ হবে না। করোনা মোকাবিলায় তিনি যেমন রাস্তায় নেমে মানুষকে সচেতন করেছেন, ঠিক তেমনি বুধবার যখন সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো একের পর এক প্রলয়ঙ্কর ঝড়ের দাপটে সাগরদ্বীপ, কলকাতা সহ একের পর এক জেলা ক্ষতিগ্রস্ত নেত্রী তখন কন্ট্রোল রুম সামলাচ্ছেন। অফিসারদের নির্দেশ দিচ্ছেন। মানুষের দুর্দশায় কাতর হচ্ছেন। এমন আঘাত গত একশো বছরে একসঙ্গে এই রাজ্যের উপর আগে কখনও নেমে আসেনি। আর বিপদের দিনে মানুষের পাশে না দাঁড়িয়ে শুধু আগামী বছর বিধানসভা ভোটে ক্ষমতা দখলের খেলা খেললে তো চলবে না। এখন তাই কী সরকার পক্ষ, আর কী বিরোধী পক্ষ সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। শুধু ছিদ্র খুঁজলে, আর ভাষণ দিলে চলবে না। গঠনমূলক কিছু করার চেষ্টা করুন।
এ লড়াই কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা তৃণমূলের একার নয়, গোটা বাংলার। বাংলার প্রতিটি মানুষের। তাই সবাইকে একযোগে পুনর্গঠনের কাজ করতে হবে। সবশেষে বলি, কাজ করলেই ভুল হয়। কিন্তু যে কোনও সঙ্কটকে একেবারে সামনে থেকে মুখোমুখি মোকাবিলা করায় এখনও এই বাংলায় বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর কোনও বিকল্প নেই। রাজ্যের প্রতিটি মানুষ জানে, বাংলার অগ্নিকন্যাই একমাত্র মেলাতে পারবেন ‘ঝোড়ো হাওয়া আর পোড়ো বাড়ির দরজাটাকে’। তাঁর অসম সাহসে ভর করে মহামারী ও মহাপ্রলয় কাটিয়ে বাংলা আবার দ্রুত ঘুরে দাঁড়াবেই। জয় হবে মানুষের।