দীর্ঘমেয়াদি সঞ্চয় ও ব্যবসা থেকে অর্থাগম যোগ। প্রেমের প্রস্তাব পেতে পারেন। পুজো পাঠে মন। ... বিশদ
প্রধানমন্ত্রীর জন্য আকাশপথে বাড়তি নিরাপত্তা নিশ্চয় জরুরি। কিন্তু আর্থিক মন্দায় ডুবে থাকা দেশের পক্ষে এখনই এই বিপুল খরচ সত্যিই কি প্রয়োজন ছিল? এই ৮ হাজার ৪৫৮ কোটি টাকা— কার টাকা?
এই অভূতপূর্ব সঙ্কটকালে দেশের সরকারের প্রধান চিন্তা কী হওয়া উচিত? কীভাবে মারণ ভাইরাসকে পরাস্ত করা যাবে। কীভাবে বিপদ থেকে মুক্ত করা যাবে দেশবাসীকে। বেঁচে থাকার ন্যূনতম উপায় কী হতে পারে। কত মানুষ কাজ হারাবেন। যাঁরা হারিয়েছেন, কীভাবে কাজ ফিরে পাবেন। এবং দ্বিতীয় চিন্তা, যা আরও বেশি দীর্ঘস্থায়ী, কোথা থেকে আসবে টাকা। অপ্রয়োজনীয় কিংবা আপাতত গুরুত্বহীন খরচ কমিয়ে কীভাবে দেশের অর্থনীতি বাঁচানো যায়। তাই তো?
করোনা সঙ্কটে বেহাল অর্থনীতিকে উজ্জীবিত করতে ২০ লক্ষ কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণার সময় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি জোর দিয়েছিলেন ‘আত্মনির্ভর ভারত’ গড়ার উপর। বলেছিলেন, ‘লোকাল’ নিয়ে ‘ভোকাল’ হওয়ার কথা। কিন্তু করোনা মোকাবিলায় যা করবেন বলেছেন, আর যা করছেন তার মধ্যে ফারাক বিস্তর। দেশের সিংহভাগ মানুষের যেখানে অন্নের নিশ্চয়তা নেই, দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক যখন ধ্বস্ত, বেকারত্বের হার সর্বকালের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে, সেখানে মোদিজির ‘আত্মনির্ভরতা’-র বুলিকে উচ্চমার্গের রসিকতা ছাড়া কী বলা যায়?
এই মহামারী-দীর্ণ সময়ে দেশের জন্য প্রধানমন্ত্রী অ্যান্ড কোং কী ভাবলেন, পাঁচ কিস্তির প্রহসনে তা বোঝাই দায়। করোনা প্যাকেজে সাধারণ মানুষের হাতে টাকা পৌঁছে দেওয়া তো দূরের কথা, হিসেবের ছলচাতুরি প্রতিটি ছত্রে ছত্রে। যার শূন্য গুনতে ক্যালকুলেটার বের করেছেন কেউ, কেউ বা হাতড়েছেন গুগল। তারপরও হিসেব মেলাতে গিয়ে গোত্তা খেয়েছেন আমআদমি। তীব্র কটাক্ষের সুরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, ‘২০ লক্ষ কোটির প্যাকেজ বিগ জিরো, অশ্বডিম্ব!’ অনেকে ভেবেছিলেন মোদি সরকার করোনা ত্রাণে দেশের নিম্নবিত্ত, গরিব মানুষের হাতে টাকা আর বাড়িতে খাবার প্যাকেট পৌঁছে দেবে। অন্তত কয়েক মাসের জন্যে। পাঁচ কিস্তি শেষে বোঝা গেল সেই গুড়ে বালি। আসলে করোনা পরিস্থিতিতে যারা ভেবেছিলেন যে, বর্তমান বিজেপি সরকার কিছুটা জনদরদী পথে হাঁটবেন, তাঁরা মূর্খের স্বর্গে বাস করছিলেন।
২০ লক্ষ কোটির ‘আত্মনির্ভর ভারত’ প্রকল্প। অথচ গরিব-নিম্নবিত্ত হোক কিংবা ছোট ব্যবসায়ী— কাউকেই কোনও অনুদানই দেওয়া হয়নি। উল্টে আর্থিক সঙ্কটের মোকাবিলায় সকলের জন্য বেশি বেশি করে ঋণ নেওয়ার বন্দোবস্ত করেছেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। যে সৎ কোম্পানি দিনের পর দিন সরকারকে বিপুল ট্যাক্স দিয়ে গিয়েছে, তার জন্য যা নিদান, আর যে কোম্পানি সরকারের ট্যাক্স কীভাবে মারা যায় তা নিয়েই সারা বছর কাঁটাছাড়া করে— তার জন্যও একই ভাবনা। এই ঋণের টাকা কারা পাবেন? এই ঋণের টাকা কীভাবে ফেরত পাবে সরকার? কোনও স্পষ্ট দিশা নেই। অতএব এই টাকা কিছুদিন পরে কতটা তামাদি হবে, তার জন্য অপেক্ষায় থাকতে হবে।
অথচ, কে না জানে, গভীর সঙ্কটের মুখে ভারতের ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা। তথ্য বলছে, গত তিন বছরে ব্যাঙ্কগুলির অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ মোট ১ লক্ষ ৭৬ হাজার কোটি টাকা। এই টাকা ফেরত দেননি ৪১৬ জন। ঋণগ্রহীতা পিছু অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ গড়ে প্রায় ৪২৪ কোটি টাকা। আবার বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কের কাছ থেকে ১০০ কোটি বা তার বেশি ঋণ ফেরত না দেওয়ায় তাদের ক্ষতি হয়েছে ২ লক্ষ ৭৫ হাজার কোটি টাকা। শেষ পাওয়া তথ্যে দেখা যাচ্ছে, ৫০০ কোটি বা তার বেশি টাকা ঋণ নিয়ে ফেরত না দেওয়ায় বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলির অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬৭ হাজার কোটি টাকা। আরবিআইয়ের ভাষায় এই ঋণগ্রহীতাদের ঋণের অঙ্ক ব্যাঙ্কের হিসেবের খাতা থেকে মুছে ফেলা হয়েছে। অর্থাৎ এই ঋণ অনদায়ী বা অনুৎপাদক সম্পদ। সংসদে প্রশ্ন ওঠা সত্ত্বেও কেন্দ্র জানায়নি ৫০ জন সর্বোচ্চ ঋণখেলাপির নাম। তথ্যের অধিকার আইনে জানাতে হয়েছে রিজার্ভ ব্যাঙ্ককে। নীরব মোদি, মেহুল চোকসি, বিজয় মালিয়া, যতীন মেহতারা আছেন। তালিকায় শেষ সংযোজন, বাবা রামদেব। বিজেপির প্রবল সমর্থক।
এই সঙ্কট–পর্বের সুযোগে ‘নজর’ পড়ল ব্যাপক বেসরকারিকরণে। পাঁচ কিস্তির প্যাকেজ ঘোষণা করার সময় অর্থমন্ত্রীকে দেখে একসময় মনে হচ্ছিল, সরকার যেন এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। লকডাউনের সুযোগ নিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্র বেচে দেওয়ার নীতি নিয়েছে কেন্দ্র। জানিয়ে দিয়েছে, কয়েকটি চিহ্নিত স্ট্র্যাটেজিক ক্ষেত্র ছাড়া অন্য কোনও ক্ষেত্রে রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্র থাকবে না। স্ট্র্যাটেজিক ক্ষেত্রেও সর্বোচ্চ চারটি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা থাকবে। বাকি সব রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার হয় সংযুক্তিকরণ হবে, নয়তো বেচে দেওয়া হবে বেসরকারি সংস্থার হাতে। এটা ছিল করোনা প্যাকেজের পঞ্চম পর্বের দাওয়াই। অর্থাৎ, সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন প্রায় সমস্ত সংস্থাগুলিতেই বেসরকারি পুঁজি ঢুকবে। এতটাই যে, সংস্থার নিয়ন্ত্রণ বেসরকারি পুঁজিপতিদের হাতে চলে যাবে। অতএব, কয়লা থেকে অস্ত্র, বিদ্যুৎব্যবস্থা থেকে আকাশসীমা, সবটাই বেসরকারি বিনিয়োগের আবর্তে ঢুকে গেল। ঘরবন্দি মানুষকে আড়ালে রেখে ‘আত্মনির্ভরতা’র নামে ছুরি বসানো হল অর্থনীতিতে, জনজীবনেও।
দেখা যাচ্ছে, সব মিলিয়ে প্রায় ২১ লক্ষ কোটি টাকার প্যাকেজে সরকারি কোষাগার থেকে দেয় নগদের পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে ১০ শতাংশেরও কম। শুধু তাই-ই নয়, প্যাকেজে এমন অনেক ঘোষণা করা হয়েছে, যা বাজেটের ব্যয়বরাদ্দে আগেই হয়েছিল। নতুন যে সব প্যাকেজ ঘোষণা হয়েছে, তার মোট মূল্য মাত্র ১ লক্ষ ৮৬ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা। সঙ্কট মোকাবিলা করতে হচ্ছে রাজ্যগুলোকে। অভূতপূর্ব পরিস্থিতিতে চিকিৎসা। সতর্কতামূলক ব্যবস্থা। রাতারাতি কোভিড হাসপাতাল, কোয়ারেন্টাইন কেন্দ্র, চিকিৎসক–নার্স–স্বাস্থ্যকর্মীদের কিট ও অন্যান্য ব্যবস্থা। বিপুল খরচ। ভয়ঙ্কর চাপ। আপৎকালীন সহায়তা নেই। রাজ্যের প্রাপ্য, নির্ধারিত প্রাপ্যও, পাওয়া যাচ্ছে না। বাংলার পাওনা ৫৩ হাজার কোটি টাকা। অন্তত সেই টাকাটা দিয়ে দিলে, রাজ্য আরও ঝাঁপাতে পারত। রাজ্যকে কিছুই দিল না কেন্দ্র। শুধু ছড়ি ঘোরাচ্ছে। ১৯৭৫ থেকে দু’বছর ইন্দিরা গান্ধী স্বৈরতান্ত্রিক শাসন চালিয়েছিলেন। কিন্তু, রাজ্যগুলোকে বঞ্চিত করা হয়নি। ইন্দিরা গান্ধী গণতন্ত্রকে ধ্বংস করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু নগ্নভাবে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোটাকে ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করেননি। ভাঙার খেলায় ইন্দিরাকে ছাপিয়ে গিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি।
বাজার চালাতে হলে আমার আপনার হাতে খরচের টাকা থাকতে হবে। কিন্তু যেখানে বহু মানুষের রোজগারের রাস্তাই বন্ধ, সেখানে খরচ হবে কোথা থেকে? সরকারের সোজা পথ, প্রভিডেন্ট ফান্ডে আপনার দায় কমানো। মূল রোজগারের উপর আপনি দিতেন ১২ শতাংশ, এখন দেবেন ১০ শতাংশ। এতে নাকি মানুষের খরচ করার ক্ষমতা বাড়বে! সাধারণ চাকুরিজীবীর অবসরের পরের ভরসা ওই প্রভিডেন্ট ফান্ডের কয়েকটি টাকা। তার দায় কমলে কিন্তু আসলে চাপ আসবে অবসরের পরে। সঞ্চয় কমবে। আর যে মুহূর্তে আপনার হাতে আয় হিসেবে ওই ২ শতাংশ আসবে, সরকার তার থেকে আয়কর কাটবে আপনার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হারেই। লাভ কার? সরকারেরই। আর আখেরে ক্ষতি কিন্তু আপনারই। দেশবাসী ভেবেছিলেন, প্রাথমিকভাবে স্বাস্থ্য সঙ্কটের মোকাবিলায় ঘোষণা হবে প্যাকেজ। সেখানে স্বাস্থ্য নিয়ে একটি মাত্র ঘোষণাই চোখে পড়েছে। মেডিক্যাল আইসোটোপ নিয়ে পারমাণবিক গবেষণা। যা কি না কর্কট রোগের চিকিৎসায় কাজে লাগতে পারে। কর্কট রোগের সঙ্গে করোনার কী সম্পর্ক, তা অর্থমন্ত্রীই জানেন!
‘আত্মনির্ভর ভারত’ গড়ার কথা শুনিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। করোনাকালের তাঁর পঞ্চম ভাষণে ৩৩ মিনিটের মধ্যে গুণে গুণে ২৯ বার ‘আত্মনির্ভর’ হওয়ার কথা বলেছিলেন মোদিজি। সহজ কথায়, বিদেশি পণ্য নয়, দেশীয় পণ্য কিনুন। প্রধানমন্ত্রীকে প্রশ্ন, কোন মানুষ নিজের দেশের চাল, ডাল, তেল, নুন, অত্যাবশকীয় জিনিসপত্র ছেড়ে বিদেশি কোম্পানির
পণ্য কেনেন?
দেশকে স্বনির্ভর করতে ‘লোকাল’ নিয়ে ‘ ভোকাল’ হওয়ার আবেদনে উত্তর কোরিয়ার স্বৈরতন্ত্রী শাসক কিম জং উনের মিল খুঁজে পেয়েছেন তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্র। মোদিজিকে মশকরা করে তাঁর ট্যুইট, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কথা শুনছি। খুব মিল খুঁজে পাচ্ছি উত্তর কোরিয়ায় কিম জংয়ের সঙ্গে।’ ট্যুইটার ছেয়ে যায় তির্যক সব মন্তব্যে। কেউ লিখেছেন, ‘একজন ব্যক্তি আছেন, যিনি মেব্যাকের রোদচশমা, মোভ্যাকের ঘড়ি পরেন। মব্ল্যাঁ পেনে লেখেন। বিএমডব্লিউ গাড়ি চড়েন। তিনিই আমাকে দেশি জিনিস কিনতে বলছেন। সময়ের সঙ্গে আত্মনির্ভরতার অর্থ বদলায়!’
এসব ছেড়ে দিন। মোদির গালভরা প্রোজেক্ট ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’-র কথাই ধরুন। কী অবস্থা? গত ৬ বছরে সবচেয়ে বেশি বিদেশি সংস্থাকে ভারতে ঢুকতে দেওয়া হয়েছে। ধনীতম শিল্পপতি মুকেশ আম্বানি এই কয়েক সপ্তাহেই দেশীয় ব্যবসায় টেনে এনেছেন তিন-তিনটি মার্কিন সংস্থাকে। পেট্রোপণ্যের বাজারে ডেকে আনা হয়েছে সৌদি আরবের আরামকোকে। রাফাল বিমান কেনা হয়েছে ফ্রান্স থেকে। আরও অস্ত্র কেনার বরাত গিয়েছে আমেরিকায়। অথচ, ব্রাত্য থেকে গেল রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা হ্যাল। আর এখন সেই সরকারই বলছে ‘আত্মনির্ভর ভারত’ গড়ার কথা।
মোদিজি বলেছেন, লকডাউন ৪ নাকি রঙিন হবে! আর আমরা ক্রমশ ‘ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট’-এ চলে যাচ্ছি। এক অদ্ভুত আঁধার নেমেছে আজ। দেশবাসী বুঝে গিয়েছেন, সঙ্কটকালে আরও ভয়াবহ খবরের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।