কর্মক্ষেত্রে সহকর্মীর ঈর্ষার কারণে সম্মানহানি হবে। ব্যবসায়ীদের আশানুরূপ লাভ না হলেও মন্দ হবে না। দীর্ঘ ... বিশদ
করোনা ভাইরাস এই সমস্ত হিসেব-নিকেশ উল্টে-পাল্টে দিয়েছে। সমস্ত অর্থনীতিবিদই পরিষ্কার বুঝে গিয়েছিলেন যে ঋণের অঙ্কটা ৭ লক্ষ ৯৬ হাজার ৩৩৭ কোটি টাকায় সীমাবদ্ধ থাকবে না, ভারতকে এবার আরও ঋণ করতে হবে। শুধু সরকারই এই বাস্তবটা অস্বীকার করেছিল। অবশেষে ৮ মে সরকার নিমরাজির মতো স্বীকার করেছে যে তারা অতিরিক্ত ৪ লক্ষ ২০ হাজার কোটি টাকা ঋণ করবে। তার ফলে ঋণের মোট পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ১২ লক্ষ কোটি টাকা। অনুমিত জিডিপি অপরিবর্তিত আছে ধরে নিলে ফিসকাল ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াবে ৫.৩ শতাংশ।
নিছক ফাঁক-ফোকর পূরণ
আমি বলেছিলাম যে গৃহীত অতিরিক্ত ঋণের টাকাটা ‘ফিসকাল স্টিমুলাস’ (উদ্দীপক) হয়ে উঠতে পারত শুধুমাত্র যদি তা জনসংখ্যার নীচের দিকের অর্ধেক মানুষ বা সবচেয়ে গরিব পরিবারগুলির জন্য খরচ করা যেত—নগদ টাকা হাতে দিয়ে ও অন্য ধরনের সহায়তার মাধ্যমে এবং সম্পূর্ণ থমকে যাওয়া অর্থনীতিতে ফের গতি এনে। শুনে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লাম যে অতিরিক্ত ঋণ হিসেবে নেওয়া ৪ লক্ষ ২০ হাজার কোটি টাকা ‘গ্যাপ ফিলিং’ বা ফাঁক-ফোকর পূরণে ব্যবহার করা হবে। সরকারের আশঙ্কা, কর সংগ্রহ এবং বিলগ্নিকরণ প্রক্রিয়া থেকে অর্থ সংগ্রহের পরিকল্পনা বিরাটভাবে ধাক্কা খাবে। যদি অর্থনীতির অনুমিত ‘গ্যাপ’টির আয়তন ৪ লক্ষ ২০ হাজার কোটি টাকার হয়, তবে গৃহীত অতিরিক্ত ঋণের টাকাতেই সেই ‘গ্যাপ’ ভরাট করে দেওয়া হবে। এটা অনিবার্যই, মানছি। কিন্তু, তখন এই ৪ লক্ষ ২০ হাজার কোটি টাকার ব্যবহার তো ‘ফিসকাল স্টিমুলাস’ বলে গণ্য হতে পারে না।
ব্যয়ের দিকের আরও কিছু আইটেমে সরকার কাটছাঁট করবে কি না তা পরিষ্কারভাবে জানা যাচ্ছে না। ব্যয় সঙ্কোচের যতটুকু ঘোষণা সরকার করেছে তাতে ৪১ হাজার ৪৯০ কোটি টাকার সাশ্রয় হবে এবং সেই টাকা কোভিড-১৯ মোকাবিলার কাজে ব্যবহার করা হবে। এই যে খরচের হিসেব দেওয়া হচ্ছে তাতে ব্যয়ের ‘অরিজিনাল লেভেল’টাই শুধু ঠিক রাখা সম্ভব হবে। এবং, এই কারণেই ব্যবস্থাটি ‘ফিসকাল স্টিমুলাস’ বলতে যা বোঝায় তা হয়ে উঠবে না।
লিকুইডিটি ও ফিসকাল স্টিমুলাস
গত ২৫ মার্চ সরকার বিভ্রান্তিকর তকমা সেঁটে ১ লক্ষ ৭০ হাজার কোটি টাকার যে আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা করেছিল, আমার আশঙ্কা হচ্ছে, এখন তারা সেটাকেও ‘ফিসকাল স্টিমুলাস’ বলে চালাবে। বাস্তবে অতিরিক্ত খরচের ব্যাপারটি হল এইরকম: নগদ হস্তান্তরের জন্য ৬০ হাজার কোটি টাকা এবং খাদ্যশস্যের জন্য ৪০ হাজার কোটি টাকা। উল্লেখ করা দরকার যে, এই খরচটা এবারের বাজেটে ধরা ছিল না। সুতরাং এই ১ লক্ষ কোটি টাকাটিকেই আমরা ‘ফিসকাল স্টিমুলাস’ হিসেবে গণ্য করতে পারি।
আমার আরও সন্দেহ, অ্যাডিশনাল লিকুইডিটি বা অতিরিক্ত নগদের জোগানের ব্যাপারে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ইতিমধ্যেই যেসব পদক্ষেপ করেছে, সরকার সেগুলিকেও ‘ফিসকাল স্টিমুলাস’ হিসেবে চালিয়ে দেবে। এক্সপেনডিচার বা ব্যয়ের সঙ্গে লিকুইডিটি গুলিয়ে দেওয়ার অর্থ ধারণাগত এক বিভ্রান্তি ছড়িয়ে দেওয়া। লিকুইডিটি ব্যাপারটা কাজ করে সাপ্লাই সাইডে বা সরবরাহের দিকে, অন্যদিকে ‘ফিসকাল স্টিমুলাস’-এর প্রয়োজন চাহিদা বৃদ্ধির কাজে। সে যাই হোক, ২৭ মার্চ থেকে আরবিআই ৫ লক্ষ ২৪ হাজার কোটি টাকার অতিরিক্ত লিকুইডিটি সাপোর্ট দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে; সেইদিন থেকে ব্যাঙ্কগুলিও পালাক্রমে আরবিআইতে অতিরিক্ত টাকা জমা করেছে ৪ লক্ষ ১৪ হাজার কোটি টাকা! সরকারের পক্ষ নিয়ে যুক্তি বিস্তারে বলা চলে যে, যদি অ্যাডিশনাল লিকুইডিটি বা অতিরিক্ত নগদের জোগানকে—ভর্তুকিযুক্ত সুদের হারে অথবা মকুবযোগ্য অতিরিক্ত ঋণের (অ্যাডিশনাল ক্রেডিট) সংস্থান বলে ধরা হয়, তবে সম্ভবত ওই ‘ইন্টারেস্ট সাবসিডি’ অথবা ‘রাইট অফ’ করে দেওয়া টাকার অঙ্কটিকে ‘ফিসকাল স্টিমুলাস’ গণ্য করা যেতে পারে। পুরোটাই অনুমানের ব্যাপার। অন্যদিকে, সব ধরনের ব্যাঙ্কঋণের মোট পরিমাণ গত ২৫ মার্চ যেখানে ১০৩ লক্ষ ৮০ হাজার কোটি টাকা ছিল, আজ তা কমে হয়েছে ১০২ লক্ষ কোটি টাকা।
১২ মে প্রধানমন্ত্রী ২০ লক্ষ কোটি টাকার আর্থিক স্টিমুলাস প্যাকেজ ঘোষণার মাধ্যমে সংবাদ মাধ্যমের শিরোনাম দখল করে নিলেন—কিন্তু পাতাটি রেখে দিলেন পুরো খালি! ১৩ মে থেকে অর্থমন্ত্রী প্যাকেজের বিষয়ে ‘বিস্তারিত’ জানাতে শুরু করলেন। অন্যদিকে মানুষ ক্ষোভের সঙ্গে বলল: কৃষক, পরিযায়ী শ্রমিক, যেসব শ্রমিক কর্মহীন বা ছাঁটাই হলেন, অসংগঠিত ক্ষেত্রে অথবা অনিবন্ধিত ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত যেসব শ্রমিক কাজ হারালেন, যে-সমস্ত স্বনিযুক্ত ব্যক্তির কোনও কাজ নেই, ‘দিন আনি দিন খাই’ দরিদ্রতম পরিবারগুলি, হাতগাঁট-শূন্য হওয়ার কারণে যেসব নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার ঋণ করতে বাধ্য হচ্ছে এবং প্রায় ৫ কোটি ৮০ লক্ষ মাঝারি-ছোট-ক্ষুদ্র (এমএসএমই) শিল্প-বাণিজ্য সংস্থা অর্থমন্ত্রীর এমএসএমই প্যাকেজের বাইরে রয়ে গেল। (অর্থমন্ত্রী দ্বিতীয় কিস্তিতে অবশ্য পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য একটি আর্থিক ব্যবস্থা নিয়েছেন: দু’মাসের জন্য খাদ্যশস্য, যার খরচ ধরা হয়েছে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা।)
প্রথম কিস্তির ঘোষণা বিশ্লেষণ করতে বসে সরকার সম্পর্কে উদার মনোভাব রেখে বলতে পারি যে, অতিরিক্ত ব্যয়ের পরিমাণ দাঁড়াবে ৩ লক্ষ ৬০ হাজার কোটি টাকা। দ্বিতীয় কিস্তির একইরকম বিশ্লেষণ থেকে ৫ হাজার কোটির একটা হিসেব পাচ্ছি আর পরিতাপের বিষয় হল, তৃতীয় কিস্তির কিছুই পরিষ্কার নয়।
ঋণবহির্ভূত ব্যয়?
আমার ভয় হচ্ছে যে মূল সমস্যাটিকে বাদ রেখেই এই সমস্ত সংখ্যার কচকচানি চলছে। ‘অতিরিক্ত ব্যয়’ শুধুমাত্র তখনই সম্ভব যখন ‘অতিরিক্ত রাজস্ব/সম্পদ’ রয়েছে। আর তা যদি না থাকে তো আমরা বাজেটে দেখানো ৩০ লক্ষ ৪২ হাজার ২৩০ কোটি টাকাতেই আটকে থাকব। অতিরিক্ত রাজস্ব/সম্পদের বিষয়ে বেগতিক বুঝেই সরকার নীরবতার নীতি নিয়েছে।
নির্দিষ্ট করে বলতে চাই, অতিরিক্ত ঋণগ্রহণ ছাড়া অতিরিক্ত খরচ করা সম্ভব নয়, এবং যুক্তি দিয়ে বুঝতে হবে যে এতে ‘ফিসকাল স্টিমুলাস’ও কিছু ঘটবে না। সারা পৃথিবীতে ফিসকাল স্টিমুলাসের উপায়ের নাম অতিরিক্ত ঋণগ্রহণ: বেশি ঋণ নাও ও বেশি খরচ করো, এবং ঋণের পরিমাণটা যদি একটা অস্বস্তিকর জায়গায় পৌঁছে যায় তবে অতিরিক্ত ঋণগ্রহণ বা ঘাটতির একটা অংশকে মুদ্রায় রূপান্তরিত করো—সোজা কথায় টাকা ছাপাও।
অতিরিক্ত ঋণের অনুপস্থিতি মানে অর্থনীতিতে চাহিদা বৃদ্ধির উপযুক্ত ‘ফিসকাল স্টিমুলাস’ না-পাওয়া। ২০ লক্ষ কোটি টাকা হবে অন্য একটি ‘জুমলা’ (মিথ্যে প্রতিশ্রুতি)। আমরা জুমলায় ‘আত্মনির্ভর’ হয়ে উঠব।