পুরনো রোগ চাগাড় দেওয়ায় দেহকষ্ট ভোগ করতে হতে পারে। তীর্থ ভ্রমণ ও ধর্মকর্মে আত্মিক তৃপ্তিলাভ। ... বিশদ
গামছায় মুড়ি আর শুকনো চিঁড়ে বেঁধে নেমে পড়েছেন রাস্তায়। কোন পথে মালদহ, জানা নেই রাজেশের। তবে পথই পথকে চিনিয়ে দেয়। ট্রেন লাইন ধরে এগিয়ে চলা। একা নয়, হাঁটার মিছিলে আরও অনেকে। সকলে তাঁরই মতো। চলেছেন শিকড়ের টানে। হাঁটতে হাঁটতেই সিদ্ধেশ্বর মাহাত, আশিস পালদের সঙ্গে বন্ধুত্ব। কারও বাড়ি বাঁকুড়া, কারও পুরুলিয়া, কারও বর্ধমান। সংখ্যায় তাঁরা ১১ জন। টানা তিন দিন হাঁটার পর টাটা হয়ে পুরুলিয়া টাউন থানায়। পুলিস দিয়েছিল টিফিন। বেঁচে গিয়েছিল একবেলার খাবার। এই মাগ্গিগন্ডার বাজারে সেটাই অনেক। পুরুলিয়ার বিষপুরিয়ায় গাছতলায় রাত্রিবাস। তখনই রাজেশের সঙ্গে ফোনে কথা।
রাজেশ বললেন, জানেন, আমার কপালটা খুব খারাপ। যেদিন ওড়িশায় গেলাম, তার একদিন পরেই লকডাউন। কাজই শুরু করতে পারলাম না। বউকে বলেছিলাম, অনেক টাকা নিয়ে ঘরে ফিরব। ফিরছি একেবারে খালি হাতে। শরীর যে আর বইছে না। শেষ পর্যন্ত বাড়ি ফিরতে পারব কি না জানি না।
রাজেশ একা নয়, দেশজুড়ে লক্ষ লক্ষ রাজেশ বাড়ি ফিরতে পাগল। নেমে পড়েছে রাস্তায়। বড় বড় শহরের বাসস্ট্যান্ড, স্টেশন চত্বরে তাঁদের ভিড়। দমবন্ধ হওয়ার উপক্রম। কিন্তু, এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না। কেন গোরু, ছাগলের মতো পালে পালে হেঁটে হেঁটে ফিরতে হচ্ছে শ্রমিকদের? এর দায় কার?
মহারাষ্ট্রের আওরঙ্গাবাদে মালগাড়ির চাকায় পিষ্ট হয়ে ১৬ জনের মৃত্যুতে টনক নড়েছে কর্তাদের। শুরু হয়েছে রাজনীতি। দায় চাপানোর রাজনীতি। আচমকাই দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের চিঠি। চিঠি নয়, পত্রাঘাত, ‘আমরা পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রত্যাশা মতো সাড়া পাচ্ছি না। রাজ্য সরকার ট্রেন ঢুকতে দিচ্ছে না। পশ্চিমবঙ্গের পরিযায়ী শ্রমিকদের প্রতি অবিচার করা হচ্ছে। তাঁদের আরও দুর্ভোগ হচ্ছে।’ তৃণমূল নেতৃত্বের পাল্টা জবাব, ‘অমিত শাহ হয় অভিযোগ প্রমাণ করুন। না হলে ক্ষমা চান।’ পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে শুরু হয়েছে বাগযুদ্ধ, চিঠি চালাচালি। এই যুদ্ধে জিতবে কে, জানা নেই। তবে নিশ্চিত জানা গিয়েছে, এই মুহূর্তে পরিযায়ী শ্রমিকরাই চর্চার কেন্দ্রবিন্দু। আওরঙ্গাবাদ ঘুরিয়ে দিয়েছে সকলের নজর।
আওরঙ্গাবাদ একটা দুর্ঘটনা। দুর্ঘটনা কখনও বলে কয়ে আসে না। তবে, একটা ভয়ঙ্কর কিছু যে ঘটতে চলেছে, তার ঈঙ্গিত মিলেছিল আগেই। ঘরে ফেরার তাড়নায় পরিযায়ীদের স্রোত আছড়ে পড়েছিল দিল্লির স্টেশনে, মুম্বইয়ের বাসস্ট্যান্ডে। স্রেফ একটা গুজব, সরকার বাড়ি ফেরাচ্ছে। ব্যাস, সঙ্গে সঙ্গে করোনার আতঙ্ককে অগ্রাহ্য করে কাতারে কাতারে শ্রমিকের জমায়েত স্টেশনে, বাসস্ট্যান্ডে। রাজনীতির কারবারিদের টনক নড়েনি। বুঝতে পারেননি, ঘরছাড়াদের ঘরে ফেরার তাগিদ কতখানি!
টনক যদি সেদিন নড়ত, তাহলে মাত্র ২৫ বছর বয়সেই দেববতী সিংয়ের গায়ে উঠত না সাদা থান। টনক যদি সেদিন নড়ত, তাহলে গজরাজ সিংকে এক রাতে দু’টো জোয়ান ছেলেকে হারিয়ে বুক চাপড়ে কাঁদতে কাঁদতে বলতে হতো না, ‘হে ঈশ্বর, তুমি এত বড় সর্বনাশ কেন করলে?’ স্বজন হারানোর কান্নায় মধ্যপ্রদেশের আন্তোলি গ্রামের বাতাস বড্ড ভারী হয়ে উঠেছে। মালগাড়ির চাকায় ছিন্ন ভিন্ন ১৬টি লাশের ন’টিই এই আন্তোলি গ্রামের। কিন্তু, এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না।
যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় কেন্দ্রীয় সরকার অভিভাবকের মতো। কোনও বিপর্যয় ঘটলে কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশ মেনে রাজ্যগুলি। এটাই নিয়ম। তাই করোনা মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির লকডাউনের ঘোষণা দেশের প্রতিটি রাজ্য বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে নিয়েছিল। কুর্নিশ জানিয়েছিল গোটা দেশ। তাঁর অভিভাবকত্ব মেনে নেওয়ার পথে রাজনৈতিক মতপার্থক্য বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। তাঁরই নির্দেশের আসমুদ্র হিমাচল করতালি দিয়ে, কাঁসর ঘণ্টা বাজিয়ে করোনা লড়াইয়ের সৈনিকদের অভিনন্দন জানিয়েছিল। তাঁরই নির্দেশে ভারতবাসী মোমবাতি আর প্রদীপ জ্বালিয়ে অঙ্গীকার করেছিল করোনা মোকাবিলার। কিন্তু, লকডাউনের মেয়াদ যত বাড়ছে, লড়াইয়ের ফাঁকফোকর যেন ততই প্রকট হচ্ছে। আওরঙ্গাবাদের দুর্ঘটনা করোনা যুদ্ধের প্রধান সেনাপতিকে দাঁড় করিয়েছে এক ঝাঁক প্রশ্নের মুখে।
মার্চ মাসে কেরলে প্রথম করোনার অস্তিত্ব মিলেছিল। তার আগেই করোনার ভয়াবহতা জেনেছিল বিশ্ব। ফলে ভারতের সামনে করোনা মোকাবিলার জন্য পরিকল্পনা তৈরির যথেষ্ট সময় ছিল। মাত্র চার ঘণ্টার নোটিসে দেশজুড়ে ২১দিনের লকডাউন ঘোষণা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। এখন অনেকেই বলছেন, মাত্র চারটে দিন সময় দিলে লক্ষ লক্ষ শ্রমিককে এমন বিপদের মুখে পড়তে হতো না। তাঁরা শ্রমিকরা নিজের দায়িত্বেই বাড়ি ফিরে যেতেন। তাহলে পরিযায়ী শ্রমিকদের ট্রেন ভাড়া দেওয়া নিয়ে এত জলঘোলাও হতো না।
অনেকে হয়তো বলতেই পারেন, কেন্দ্রীয় সরকার লকডাউন কার্যকর করে ভেঙে দিতে চেয়েছিল করোনার চেন। কারণ তখন দেশজুড়ে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল মাত্র শ’দুয়েক। কিন্তু, যখন বোঝা গেল, ভারতেও চীন, আমেরিকা, ইতালির মতো লম্বা লড়াই লড়তে হবে, তখনই দরকার ছিল পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য মাস্টার প্ল্যানের। দরকার ছিল বিশেষ প্যাকেজ ঘোষণার। তার জন্য প্রতিটি রাজ্যকে দিতে হতো অর্থ। পরিযায়ী শ্রমিকরা সেই রাজ্যের ভোটার নন। তাই ভোট সর্বস্ব রাজনীতির যুগে তাঁদের জন্য কোনও রাজ্যেরই দায়বদ্ধতা থাকে না। প্রধানমন্ত্রী লকডাউন ঘোষণা করে যিনি যেখানে আছেন তাঁকে সেখানেই থেকে যেতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু, তাঁরা খাবেন কী করে, সেটা একবারও ভাবেননি।
দেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা পরিযায়ী শ্রমিকদের নিজ নিজ রাজ্যে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য দরকার ছিল কো-অর্ডিনেশনের। আর সেই কাজটা করতে পারে একমাত্র কেন্দ্র। কারণ যখনই কোনও ব্যাপারে দু’ই বা ততোধিক রাজ্য জড়িয়ে যায় তখন কেন্দ্রকেই হস্তক্ষেপ করতে হয়। তাই কোন রাজ্যে কত পরিযায়ী শ্রমিক আছে এবং তাদের ফেরত পাঠানোর ‘মুভমেন্ট প্ল্যান’ তৈরির দায় কেন্দ্রেরই নেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু, সেটা হয়নি। এমনকী, দিল্লি ও মুম্বইয়ে পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরে ফেরার তাগিদ দেখার পরেও নয়। ৪০দিন ভিন রাজ্যে কাটানোর পর যাঁরা এখন কোনওরকমে বাড়ি ফিরছেন তখন সকলের চোখেই সন্দেহের চাউনি। করোনার আবহে তাঁরা যেন এক একটি ‘মানব বোমা’।
এখন নয়, বাড়ির জন্য হাঁটা শুরু হয়েছিল মার্চ মাসের শেষেই। কাজের জায়গায় তালা ঝুলতেই দিন আনা দিন খাওয়া মানুষগুলো বুঝতে পেরেছিল, সেখানে থাকলে করোনায় নয়, মরতে হবে খিদের জ্বালায়। তাই যে কোনও মূল্যে ফিরতে হবে বাড়ি। শুরু করেছিল হাঁটা। কেউ উত্তরপ্রদেশ থেকে মধ্যপ্রদেশ, কেউ মহারাষ্ট্র থেকে বিহার। দূরত্বের কথা মাথায় ছিল না। মাথায় ছিল একটাই চিন্তা, যে কোনওভাবেই হোক ফিরতে হবে বাড়ি। বেরিয়েছিল পুলিসের নজর এড়িয়ে। সন্তর্পণে। কারণ লকডাউন চলছে।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সব কিছুই বদলে যায়। শুধু বদলান না রবীন্দ্রনাথ। তাঁর লেখার প্রাসঙ্গিকতা একইরকম থেকে যায়। তাই তো তিনি বিশ্বকবি। আজ থেকে প্রায় ৮০ বছর আগে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘মাটির পৃথিবী পানে আঁখি মেলি যবে/ দেখি সেথা কলরবে/ বিপুল জনতা চলে/ নানা পথে নানা দলে দলে/ যুগযুগান্তর হতে মানুষের নিত্য প্রয়োজনে/ জীবনে মরণে।’ কবি প্রয়াণের মাত্র ছ’মাস আগে যাঁদের কথা বলে গিয়েছিলেন, আজ ভারতবর্ষের রাস্তায়, রেল লাইনে তাঁদেরই মিছিল। মিছিলে চলতে চলতেই কেউ ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছেন মালগাড়ির ধাক্কায়, কেউ পিষ্ট হচ্ছেন বাসের চাকায়। কিন্তু, এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না।
দেববতীদেবী আপনাকে সান্ত্বনা জানানোর ভাষা নেই। এক লহমায় আপনার জীবন থেকে মুছে গিয়েছে সমস্ত রং। এক অসীম শূন্যতা গ্রাস করে নিয়েছে আপনার জীবন। তবে, একটা কথা জেনে রাখুন, আপনার স্বামীর জীবনদান বৃথা যায়নি। আওরঙ্গাবাদের দুর্ঘটনায় টনক নড়েছে সরকারের। আপনার ঘর চুরমার হয়ে গেলেও হাজার হাজার শ্রমিক ঘরে ফিরছে ট্রেনে চেপে। এই ট্রেনের দাবি তো আপনার স্বামীরও ছিল। পূরণ হয়েছে সেই দাবি। তবে, এসবই হচ্ছে আপনার বৈধব্য-যন্ত্রণার বিনিময়ে।