রাজনীতিক ও পেশাদারদের ব্যস্ততা বাড়বে। বয়স্করা শরীর স্বাস্থ্যের প্রতি যত্ন নিন। ধনযোগ আছে। ... বিশদ
ওখানে আটকে পড়া ভারতীয়দের উদ্ধারের জন্য যে দু’টি বিমান উহান পাড়ি দিয়েছিল, তার প্রথমটিতে ছিলেন ক্যাপ্টেন অমিতাভ। সুবিধা ছিল একটাই... উদ্ধার-অভিযান এয়ার ইন্ডিয়া আগেও করেছে। তাই এমন পরিস্থিতির জন্য টিম তৈরিই থাকে। তবে ছিল খচখচানিও। কারণ, এর সঙ্গে অন্য অভিযানকে গুলিয়ে ফেললে চলবে না। তাঁদের যে করোনা নামক মহামারীর আগুনে প্রবেশ করতে হবে। ফোন ঘোরালেন ক্যাপ্টেন। প্রথম ক্রু মেম্বারকে বলা মাত্র উত্তর এল... অসুবিধা নেই স্যর। দ্বিতীয়, তৃতীয়... শেষ ফোনেও উহান যাওয়া নিয়ে কোনও আপত্তি এল না। নিশ্চিন্ত হলেন ক্যাপ্টেন। বাকি শুধু ভিসা বানানো। এর জন্য অবশ্য বেশ কাঠখড় পোড়াতে হল তাঁকে। উহান শহরের উপর পাক খেয়ে যখন বোয়িং ৭৪৭ ল্যান্ডিংয়ের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে, তখন হয়তো এই ঘটনাক্রমটাই ছবির স্লাইডের মতো মুহূর্তে ক্যাপ্টেনের সামনে দিয়ে চলে গিয়েছিল। অবাক হয়ে দেখছিলেন আলো ঝলমলে শহরটাকে। বিস্ময়ের কারণ? আকাশ থেকে দেখে যেন মনে হচ্ছে, উহান যেন চলতে চলতে হঠাৎ জীবনশূন্য। আলোয় শহরকে ভাসিয়ে সবাই হঠাৎ কোথাও উবে গিয়েছে। তাও ভয় লাগেনি তাঁর। কোনও অঙ্ক কষেননি তিনি... লক্ষ্য ছিল একটাই, আটকে থাকা ভারতীয়দের ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
অথচ অঙ্কটা তাঁরই করা উচিত ছিল। নিজের কথা, পরিবারের কথা ভেবে। তিনি করেননি। অঙ্ক কষছি আমরা। বাড়ির চার দেওয়ালের মধ্যে, ঠান্ডা ঘরে বসে। রাস্তায় ঘুরে, মাস্কটাকে থুতনির নীচে নামিয়ে। আর ঘরবন্দিত্বের সাবধানতা ভুলে বেরিয়ে পড়ার লাইসেন্স? ওই বাজারের ব্যাগটা আছে না! বেরিয়ে না এলে লোকজনকে বলব কী করে... আজ কত মানুষ বিশ্বে মারা গিয়েছে, দেশে কত আক্রান্ত, করোনায় মৃত্যু কত, কো-মরবিড কত...।
করোনা যে আমাদের অঙ্ক কষতে শিখিয়েছে!
এর মধ্যে সবচেয়ে বড় অঙ্ক অবশ্যই ‘কো-মরবিড’। এর অর্থ? হয়তো কোনও ব্যক্তির কিডনি বা হার্টের সমস্যা ছিল। কারও ছিল শ্বাসকষ্ট। সেই অসুস্থতা নিয়েই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছে, তাঁর শরীরে করোনা ভাইরাস হানা দিয়েছে। যদি তাঁর মৃত্যু হার্ট অ্যাটাকে হয়, তাহলে সেটাই প্রাথমিক কারণ। করোনা নয়। সেক্ষেত্রে এই মৃত্যু কো-মরবিড। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার যখন এই বিভাজনটা সামনে নিয়ে এসেছিল, তখন গোটা দেশে ত্রাহি ত্রাহি রব। ভাবটা এমন, পশ্চিমবঙ্গের জন্য গোটা দেশটাই করোনা আক্রান্ত হয়ে গেল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তথ্য লুকোচ্ছেন। এমন একটা সঙ্কটজনক মুহূর্তেও প্রকাশ্যে এল রাজনৈতিক বিভাজন। শাসক-বিরোধী। আর আমরাও খোল-করতাল বাজাতে বাজাতে তাতে সায় দিলাম। বঙ্গ সিপিএম-প্রদেশ কংগ্রেস হাঁ হাঁ করে উঠল। তারপর? পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে গুজরাতে গেলেন দিল্লি এইমস-এর ডিরেক্টর ডঃ রণদীপ গুলেরিয়া। তিনি রিপোর্ট দিলেন, আতঙ্কের কারণে হাসপাতালে ভর্তিতে অযথা দেরি এবং কো-মরবিডিটি আসলে গুজরাতে মৃত্যুমিছিল দীর্ঘ করেছে। অর্থাৎ, মৃত্যুর কারণ ডায়াবেটিস বা হাই প্রেশার। প্রাথমিকভাবে করোনা নয়। এখানেই শেষ নয়, ভারতে জৈবরাসায়নিক গবেষণার ধারক-বাহক আইসিএমআর পর্যন্ত গাইডলাইন দিয়েছে যে, অন্য বড়সড় রোগ থাকলে ডেথ সার্টিফিকেটে সেটা উল্লেখ করতে হবে। প্রাথমিকভাবে করোনার উল্লেখ করলেও।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম শুনলেই দাঁত-নখ বের করে হামলে পড়া রাজনীতির সব ‘অবৈতনিক’ দালালদের এখন অবশ্য আর এ বিষয়ে কথা নেই। সাবজেক্ট বদলে গিয়েছে। যত সংখ্যক পরীক্ষা করানোর কথা, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার নাকি তা করছে না। তাই আক্রান্তের পরিসংখ্যানে ঘাটতি হচ্ছে। নতুন ইস্যু। রাজনীতি কিন্তু একটাই। এই তীব্র সঙ্কটেও। আর আমরাও তাতে তাল দিচ্ছি। দেশের ভালো, মানুষের ভালো... সব পিছনের সারিতে। বিজেপি-তৃণমূল হাঁকডাকটাই হটকেক।
করোনা আমাদের নতুন করে রাজনীতিও শেখাচ্ছে।
কীভাবে? সৌজন্যে সোশ্যাল মিডিয়া। জ্ঞান আহরণের নতুন মাধ্যম। যেমন পারো লেখো, যেমন পারো বানাও। তারপর ছেড়ে দাও সোশ্যাল মিডিয়ায়। হোয়াটসঅ্যাপে এক গ্রুপ থেকে অন্যে। ফেসবুক, ট্যুইটার... যাবতীয় প্ল্যাটফর্ম বিশ্লেষক, বোদ্ধা মানুষজনে ছেয়ে গিয়েছে। করোনা ঠেকাতে নরেন্দ্র মোদির কী করা উচিত ছিল, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাস্তায় বেরিয়ে করোনা বিরোধী প্রচার করে আসলে রাজ্যের মানুষকেই বিভ্রান্ত করছেন... এই জাতীয় নানা জ্ঞানগর্ভ বার্তা। সোশ্যালে পোস্ট করেই উৎসুক হয়ে তাকিয়ে থাকা... ‘এক লাইক তো বনতা হ্যায়!’ তারপর ফরওয়ার্ড করার বদভ্যাস তো আছেই। যাচাই করার বালাই নেই! ভয়ঙ্কর সামাজিকতায় নেশাগ্রস্ত আমরা।
করোনা যে আমাদের নতুন করে ‘সোশ্যাল’ বানিয়েছে।
হবে নাই বা কেন? আমাদের দেশের হর্তাকর্তাবিধাতারা আজকাল সোশ্যাল মিডিয়াতেই বেশি বিশ্বাস করেন। ভোটের সময় হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের মাধ্যমে চলেছিল জোর প্রচার। ধর্ম, জাতপাত, অর্থনৈতিক স্টেটাসের ভিত্তিতে বিভিন্ন ক্যাটিগরিতে ভাগ করে নেওয়া হয়েছিল সমাজকে। তারপর রাজনৈতিক দলগুলির সাইবার সেল হয়ে উঠেছিল সক্রিয়। ভোট বিদায় নিয়েছে। অথচ নেটওয়ার্কিং মাধ্যমগুলির ব্যবহারে বিরাম নেই। নরেন্দ্র মোদি ‘স্ট্যাচু অব ইউনিটি’র উদ্বোধন করছেন, তার ছবি পোস্ট হচ্ছে ইনস্টাগ্রামে। রেলমন্ত্রী ‘শ্রমিক স্পেশাল’ নিয়ে কিংবা পরিযায়ী শ্রমিক নিয়ে বিবৃতি দিচ্ছেন... তাও ট্যুইটারে। সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং মেনে চলার বার্তা পর্যন্ত আসছে সোশ্যাল সাইটে। ইদানীং আবার এই সরকারকে রাতের রোগ ধরেছে। রাতবিরেতে হঠাৎ বিবৃতি বা নির্দেশনামা ইস্যু হচ্ছে... লকডাউন মানার নয়া নিয়মাবলি। অহরহ বদলে যাচ্ছে সেই বিধিনিষেধ। এই বলা হল, সবাই কারখানা খুলে দাও... তারপর আবার গাইডলাইন এল, লকডাউন উঠলে বিধি মেনে ফ্যাক্টরি, অফিসপত্র খুলতে হবে। আর সবটাই হবে ‘ট্রায়াল’। তাজ্জব ব্যাপার! এই দু’রকম নির্দেশিকার মানেটা কী? যাঁরা এতদিন ধীরে ধীরে লকডাউনের নিয়ম মেনে দপ্তর খুলেছিলেন, তাঁরাও এখনও পিছু হটছেন। ভাবছেন, এত কষ্টেসৃষ্টে সব শুরু করলাম, যদি আবার সব বন্ধ করে দেয়? তাহলে তো সবটাই জলে যাবে! নতুন করে লোকসান। এ গেল না হয় একটা ক্ষেত্র। অন্য ক্ষেত্র হল সিদ্ধান্তহীনতা। লকডাউন কতদিন চলবে? এর থেকে বেরনোর যথাযথ রুটটাই বা কী? এই সব প্রশ্নের সুনির্দিষ্ট উত্তর কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে নেই। আজও না। আগামী ১৭ মে’র পর যদি লকডাউনের মেয়াদ না বাড়ানো হয়, তাহলে এখনই সেই মতো গোটা দেশকে তৈরি করতে হবে এবং তৈরি হওয়ার সময়ও দিতে হবে। কেন্দ্রকে স্পষ্ট জানাতে হবে, তাদের নিয়মনীতি চলবে, নাকি রাজ্যের। ফেডেরাল গঠনতন্ত্রকে গুরুত্ব দেওয়ার কথা মুখে বলব, অথচ পরে রাজ্যগুলি কোনও সিদ্ধান্ত নিলে ‘আমি তো কলা খাইনি’ জাতীয় প্রতিক্রিয়া দেব... এর কোনও অর্থ হয় না। গোটা দেশের অর্থনীতির চাকা একসঙ্গে গড়াতে হলে সবার আগে স্বাভাবিক করতে হবে গণপরিবহণ। বাস এবং লোকাল ট্রেন। পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতি কলকাতার ভিতের উপর দাঁড়িয়ে। এই শহরে প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ মানুষ কাজের সূত্রে বর্ধমান, মেদিনীপুর, কৃষ্ণনগর থেকে ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করেন। একই অবস্থা মুম্বইতেও। দিল্লিতে যেমন মেট্রোরেল। সবটাই বাঁধা একসূত্রে। যতদিন না এই লাইফলাইন ফের চালু হচ্ছে, জীবন-জীবিকাকে স্বাভাবিকতায় ফেরানোর কোনও সম্ভাবনাই নজরে আসে না। এ ব্যাপারে কী ভাবছে কেন্দ্র? আদি অনন্তকাল লকডাউন চলবে না। স্বাস্থ্যমন্ত্রকই বলছে, করোনাকে সঙ্গে নিয়ে বাঁচতে হবে আমাদের। কিন্তু কীভাবে? সেই দিশা নেই।
আমরা ভোট দিয়ে মাথার উপর শাসক বসিয়েছি। দক্ষ প্রশাসক নয়।
অথচ, তারপরও এই সব ‘হতে পারে’, ‘বোধ হয়’, ‘সম্ভবত’ শুনেই আমরা নাচানাচি করছি। একবারও ভাবছি না, নাগরিক হিসেবে কর্তব্য আমরা ঠিকমতো পালন করছি কি না। যেখানে আমরা জানি, বাড়ি থেকে বেরনো মানে করোনাকে আমন্ত্রণ জানানো... সেখানে রোজ আলু-পটল কিনতে বাজারে যাওয়াটা কি খুব দরকার? মৃত্যু শুধু একটা সংখ্যা নয়। একটা জীবন চলে যাওয়া মানে গোটা পরিবারের পথে বসা। একটা প্রজন্ম শেষ হয়ে যাওয়া। আর এটা সবে শুরু। আজ বাদে কাল দেশের জাতীয় গড় উৎপাদনের হার যদি সত্যিই শূন্যে নেমে যায়, তাহলে লক্ষ লক্ষ মানুষ কর্মহারা হবেন। না খেতে পেয়ে মৃত্যু কিন্তু করোনার থেকেও মর্মান্তিক হয়ে তখন দেখা দেবে। এমন একটা সময়ে একবারের জন্য কি মনে হয় না যে, মানুষের পাশে দাঁড়াই! সঙ্গে থাকি প্রত্যেক সেই ভারতীয়ের, লকডাউনের বাজারে যাঁদের পেটে একবেলার খাবারও জুটছে না! আচমকা কেউ দরজায় এসে দাঁড়িয়ে খেতে চাইলে অধিকাংশই হয় মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দেন। কিংবা মুখ চেনা হলে বলেন, ‘কাল সকালে এসো দেখছি’। এমন কিছু বলার আগে একবারের জন্য আমাদের মনে হয় না, আজ লোকটা কী খাবে? মানুষ সমাজের শ্রেষ্ঠ জীব। কিন্তু শ্রেষ্ঠত্বের অহঙ্কার যদি মনুষ্যত্ব ভুলিয়ে দেয়, তার থেকে দুর্ভাগ্যজনক আর কিছু হতে পারে না। ছেলেবেলা থেকে পড়ে আসা, বাঁদরের বিবর্তন হয়ে মানুষের জন্ম। কিন্তু স্বার্থপরতা ও ক্ষুদ্রচিন্তা আমাদের আবার পিছনদিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে না তো? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘বানরের শ্রেষ্ঠত্ব’ শীর্ষক প্রবন্ধে লিখেছিলেন, ‘আর যে যা খায় খাক আমরা যেন কেবল কলা খাইতেই থাকি, এবং শ্রেষ্ঠ বানর ব্যতীত অন্য জীবকে দেখিবামাত্র দাঁত খিঁচাইয়া আনন্দলাভ করি।’ আমাদের অবস্থা অনেকটা আজ এইরকম। স্বার্থের লক্ষ্মণরেখার বাইরে থেকে কেউ টানাটানি করলেই দাঁত খিঁচিয়ে উঠি।
মনুষ্যত্বের শিক্ষাটাই আসলে আমাদের মধ্যে থেকে ধীরে ধীরে অবলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।
ফিরে আসার পর ক্যাপ্টেন অমিতাভ সিংকে যখন জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, আবার যদি উহান যেতে হয়? তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, ‘যদি যেতে বলে? অবশ্যই যাব’।
মহামারীর এই মহাসঙ্কটে দক্ষ প্রশাসক, গণিতজ্ঞ বা সমাজতাত্ত্বিক নয়... আজ সত্যিই দরকার ক্যাপ্টেনের মতো মানুষ।