পুরনো রোগ চাগাড় দেওয়ায় দেহকষ্ট ভোগ করতে হতে পারে। তীর্থ ভ্রমণ ও ধর্মকর্মে আত্মিক তৃপ্তিলাভ। ... বিশদ
সংখ্যার বিচারে হয়তো আমরা এখনও ভালো জায়গায়। করোনার ছোবলে আমেরিকা এবং ইউরোপের দেশগুলো দিন দিন নীলবর্ণ ধারণ করছে, তার তুলনায় হয়তো বা কিছুটা ভালো। সম্ভবত সেই কারণেই ওয়ার্ল্ড হেল্থ অর্গানাইজেশন (হু) আমাদের ভারতবর্ষের প্রশংসা করছে। ভাবছে, ভারতই বিশ্বকে পথ দেখাবে। সেই ভাবনা সফল হলে ভারতবাসী হিসেবে আমাদের গর্বের শেষ থাকবে না। কিন্তু মনে রাখতেই হবে, প্রতিটি সাফল্যের পিছনেই থাকে নিখুঁত পরিকল্পনা এবং কঠিন সংকল্প।
ঠিক সময়ে লকডাউনের ঘোষণা হয়তো করোনার অগ্রগতির রাস্তায় কিছু কাঁটা বিছিয়েছে। তাতে হয়তো গতি কিছুটা মন্থর। কিন্তু, আমরা পাঁচিল তুলে দিতে পারিনি। সেই জন্যই প্রতিদিন সে সংখ্যাটা বাড়িয়ে নিচ্ছে। যেভাবে ক্রিজে টিকে থাকলে ব্যাটসম্যান টুক টুক করে রান তুলে স্কোরবোর্ড সচল রাখে, ঠিক সেইভাবেই এগিয়ে চলেছে। একটু নরম বল পেলেই শুরু করবে চার, ছক্কা হাঁকানো। স্কোরবোর্ড স্তব্ধ করতে গেলে ব্যাটসম্যানকে আউট করতে হবে। তার একটাই রাস্তা, লকডাউনকে কঠিনভাবে মেনে চলা।
যেটুকু প্রকাশ্যে আসছে তাতেও করোনার বিস্তারের সংখ্যাটা হেলাফেলার নয়। আমেরিকা বা ইতালির সঙ্গে তুলনা টেনে রাশ আলগা করলেই ভুল হবে মারাত্মক। কারণ প্রতিদ্বন্দ্বীকে ছোট করে দেখতে নেই।
ছোটবেলায় পড়া একটা গল্পের কথা খুব মনে পড়ছে। কচ্ছপ আর খরগোসের গল্প। সকলেরই জানা। তবুও একবার। দু’জনের দৌড় প্রতিযোগিতার গল্প। কচ্ছপের মন্থর গতিকে তাচ্ছিল্য করেছিল খরগোস। হেলায় জেতার আত্মবিশ্বাসে বিভোর খরগোস মাঝপথে বিশ্রাম নিতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। তারপর ঘুম ভাঙতে দেখল, কচ্ছপ পৌঁছে গিয়েছে শেষ সীমানায়। প্রাণপণে দৌড়েও খরগোস কিছুই করতে পারল না। প্রতিদ্বন্দ্বীকে ছোট করে দেখার খেসারত গুনতে হয়েছিল। গল্পের নীতিকথাটা সকলেরই জানা, প্রতিদ্বন্দ্বীকে কখনও ছোট করে দেখতে নেই।
একটা ভয় ক্রমশ জাঁকিয়ে বসছে। একটা সন্দেহ বারবার উঁকি দিচ্ছে, আমরা প্রতিদ্বন্দ্বীকে ছোট করে দেখছি না তো! আমরা যদি লকডাউনকে ছোট করে দেখি, সামাজিক দূরত্ব বজায় না রাখি, তাহলে পরাজয় স্রেফ সময়ের অপেক্ষা। খরগোসের মতোই ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে দেখতে হবে পরাজয়। আমাদের পরাজয়। হার মানতে হবে সমগ্র দেশকে। আমাদের ভারতবর্ষকে। ভারতবাসী হিসেবে, বাঙালি হিসেবে সেই পরাজয়ের গ্লানি কত মর্মান্তিক, কত হৃদয় বিদারক হবে, তা আমরা কল্পনাও করতে পারছি না। আর কল্পনা করতে পারছি না বলেই হয়তো এখনও আমরা অনেকেই ভুল করেই যাচ্ছি।
অকারণে, অপ্রয়োজনে রাস্তায় বেরচ্ছি। ঠেকে বসে একটা সিগারেট দু’জন তিনজনে ভাগ করে খাওয়ার অভ্যেস ছাড়তে পারছি না। বাজারে গিয়ে ভুলে যাচ্ছি ‘সোশ্যাল ডিস্টান্সিং’-এর পরামর্শ। চলছি গা ঘেঁষাঘেঁসি করে। তবে, একটা কথা মানতেই হবে, শতকরা ৯০ভাগ মানুষ লকডাউন মানছেন। কারণ তাঁরা করোনার বিপদ বুঝেছেন। তাঁরা বুঝেছেন, বন্দিতেই আছে মুক্তি। করোনার ছোবল থেকে মুক্তি।
স্বাধীনতা লাভের পর দেশজুড়ে সর্বক্ষেত্রে এমন ভয়াবহ বিপর্যয়, এই প্রথম। এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি। মারণ ভাইরাস মোকাবিলায় কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারের ভূমিকা এককথায় অভূতপূর্ব। আটকে পড়া শ্রমিকদের থাকা এবং খাওয়ার ব্যবস্থা, গরিবদের রেশনে বিনা পয়সায় খাদ্যের ব্যবস্থা এবং সর্বোপরি যেভাবে ব্যক্তিগত এবং সংস্থাগতভাবে সাধারণ মানুষ গরিব ও দুঃস্থদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন, আগে কখনও দেখা যায়নি। নিরন্ন ফুটপাতবাসীদের জন্য তো বটেই, অভুক্ত কুকুরদের জন্যও হচ্ছে রান্না। সঙ্কট মোকাবিলায় বাড়ির মা, বোনেরাও এগিয়ে এসেছেন।
অভাবনীয়, অকল্পনীয় এবং অভূতপূর্ব। এসব দেখে মনে হচ্ছে, ইতিহাসের পাতায় লেখা স্বাধীনতা আন্দোলনের দিনগুলো যেন আবার ফিরে এসেছে। ভারতের বুকে। বাংলার বুকে। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ আজও বেঁচে আছেন। তাঁরা বেঁচে আছেন বলেই সঙ্কটকালে জাত, ধর্ম ভুলে মানুষ ঝাঁপিয়েছে আর্তের সেবায়। অভুক্ত, নিরন্ন মানুষের সেবায় প্রসারিত হচ্ছে হাত। ক্ষুধার্তকে অন্ন দান করে সাধারণ বাড়ির মা বোনেরাও হয়ে উঠছেন সাক্ষাৎ মা অন্নপূর্ণা। তাঁদের অন্তরে সেই বাণী, জীবে প্রেম করে যেজন, সেজন সেবিছে ঈশ্বর। আধুনিক ভারতের বুকে ক্রমশই স্পষ্ট হয়ে উঠছে সনাতন ভারতের প্রতিচ্ছবি। সঙ্কট মানে শুধু আঁধার নয়, সঙ্কটকালে বিচ্ছুরিত হয় আলোও।
এরপরেও যাঁরা তর্জনী তুলছেন, সরকারের কাজের ফাঁকফোঁকর খুঁজছেন তাঁদের কাছে অনুরোধ, দয়া করে অভ্যেসটা বদলান। আর পারলে কোনও স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে গিয়ে আঙুলটা পরীক্ষা করিয়ে নিন। পাশাপাশি একটিবার, মাত্র একটিবারের জন্য সঙ্কটকালে নিজের অবদানটা পর্যালোচনা করুন। সেল্ফ ক্রিটিসিজিম। তখন দেখবেন, আঙুলের অভিমুখ ঘুরে গিয়েছে। ঠিক ১৮০ডিগ্রি।
একটা বড় ভুল হচ্ছে। রোগ গোপন করার চেষ্টা। করোনাকে হাল্কা চালে নেওয়ার পরিণতি ভয়ঙ্কর জেনেও আমরা শিক্ষা নিচ্ছি না। গোপন করে যাওয়ার এক সর্বনাশা খেলায় নিজেদের জড়িয়ে ফেলছি। কিন্তু, করোনা যে পাপ আর পারদের মতোই মারাত্মক। শরীরে ঢুকলে তার প্রকাশ অনিবার্য। মারণ ভাইরাসে সংক্রমিত ফুসফুস যখন তার অক্ষমতা জানান দেবে, তখন একটু অক্সিজেনের জন্য ছটফট করতে হবে। ছুটতে হবে সেই ডাক্তারবাবুদের কাছেই। তাই জল যখন খেতেই হবে তখন অযথা ঘোলা করে কী লাভ!
চারিদিকে ঘটে যাওয়া ঘটনায় মাঝেমধ্যেই গ্রাস করছে বিষন্নতা। কানপুরের লালা লাজপত রায় হাসপাতালের, অসমের গোলাঘাট জেলা হাসপাতালের কিছু রোগীর আচরণে জাগছে শঙ্কা। জাগছে সংশয়। মারণ ভাইরাসে আক্রান্তদের সুস্থ করার জন্য চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীরা যখন প্রাণপণ লড়াইয়ে ব্যস্ত, তখন তাঁদেরই দিকে ছেটানো হচ্ছে থুতু। এও এক ধরনের অসুস্থতা। মানসিক অসুস্থতা। বলতে দ্বিধা নেই, হাসপাতাল নয়, এদের আসল জায়গা পাগলাগারদ অথবা হাজত। কিন্তু, সমাজকল্যাণকর রাষ্ট্রের বড় জ্বালা। অনেক বাধ্যবাধকতা। কঠোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় মাথায় চেপে বসে অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা বোধ। তাই চীন যা পারে, ভারতবর্ষ তা পারে না।
ট্রেস, টেস্ট, ট্রিট অ্যান্ড আইসোলেশন। আক্রান্তকে খুঁজে বের করা, পরীক্ষা করা, চিকিৎসা করা এবং বিচ্ছিন্ন করা। করোনাকে জব্দ করার এটাই মূল মন্ত্র। সেই কাজটা করতে গিয়েই আজ বিপদের মুখে চিকিৎসক, নার্স এবং স্বাস্থ্যকর্মীরা। কিছু মানুষের জন্য আমরাও উত্তরপ্রদেশ, অসম, মহারাষ্ট্রের সঙ্গে নিজেদের জড়িয়ে ফেলছি। তমলুকের বাড়খোদা গ্রামে করোনায় আক্রান্তের খবর পেয়ে থার্মাল স্ক্রিনিংয়ের জন্য চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীদের নিয়ে যাচ্ছিল স্বাস্থ্য দপ্তরের গাড়ি। রোগকে গোপন করার এবং রোগীকে আড়াল করার চেষ্টায় মরিয়া কিছু মানুষ গাড়িতে ভাঙচুর চালায়। স্বাস্থ্য কর্মীদের হেনস্তা করে। যাদের সুস্থ করার উদ্দেশ্যে যাওয়া তারাই করছে হামলা। সত্য সেলুকাস, বড় বিচিত্র এই দেশ!
হেনস্তার শিকার হয়েও, আক্রান্ত হয়েও চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীরা সেবা করে চলেছেন। নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অন্যের জীবন রক্ষার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। আমরা জানি, দেশের মানুষকে রক্ষা করার জন্য আপনারা আত্মবলিদান দিতেও প্রস্তুত। তাই পদে পদে বিপদ বুঝেও চালিয়ে যাচ্ছেন লড়াই। এই লড়াই দেখে অনেকেই এখন আপনাদের ঈশ্বরের আসনে বসাচ্ছেন। হয়তো এও এক আবেগ। হয়তো তা সাময়িক।
তবুও সেই আবেগ নিয়েই স্মরণ করব প্রভু যিশুকে। ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার সময় তীব্র যন্ত্রণা উপেক্ষা করে প্রভু বলেছিলেন, ‘ঈশ্বর এরা জানে না, এরা কী ভুল করছে। তুমি এদের ক্ষমা করো।’ প্রভু যিশুর জন্মের ঠিক ২০২০ বছরের মাথায় দাড়িয়ে আপনাদের উদ্দেশে একটা কথা বলতে বড় ইচ্ছা করছে, ‘আমরা জানি না, আমরা কী অপরাধ করছি। আপনারা আমাদের ক্ষমা করুন।’