কর্মলাভের যোগ রয়েছে। ব্যবসায়ী যুক্ত হওয়া যেতে পারে। কর্মক্ষেত্রে সাফল্য আসবে। বুদ্ধিমত্তার জন্য প্রশংসা দুযবে। ... বিশদ
প্রশ্ন হল বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও সর্বোপরি চিকিৎসা বিজ্ঞানের এই বিপুল অগ্রগতির পরেও এই মহামারীর কাছে আমরা কেন এত অসহায়? চোখের সামনে এই মৃত্যুমিছিল চলতে থাকার পরেও কেন আমরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে থাকতে বাধ্য হচ্ছি? ভাবতে অবাক লাগে, দুনিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ আমেরিকায় এই মুহূর্তে সর্বাধিক মানুষ করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত। এক অতিক্ষুদ্র ভাইরাস সে দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার বেহাল অবস্থা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। এই তো বছর দুয়েক আগে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সরকারি স্বাস্থ্য সুরক্ষা সংস্থায় ৮০ শতাংশ বরাদ্দ ছাঁটাই করে, শূন্য পদে নিয়োগ প্রক্রিয়া বাতিল করে আমেরিকার স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে ঠেলে দিয়েছিলেন আরও বেসরকারিকরণের পথে। প্যান্ডেমিকের প্রাদুর্ভাবে তারই মাশুল গুনছেন সাধারণ নাগরিকরা। কিছু প্রভিন্সে নামমাত্র সরকারি ভর্তুকির কথা ঘোষণা করলেও গোটা আমেরিকায় করোনা ভাইরাসের টেস্ট এবং চিকিৎসা মূলত বেসরকারি এবং ব্যাপক খরচ সাপেক্ষ। তার উপর ৩ কোটি মর্কিন নাগরিকের নেই কোনও মেডিক্যাল ইনসিওরেন্সই। ইতিমধ্যে বেশিরভাগ হাসপাতাল জানিয়ে দিয়েছে, তারা এতটাই অসহায় যে, কোনও আর্থিক সাহায্য না পেলে ঝাঁপ ফেলতে বাধ্য হবেন। স্বাস্থ্য পরিষেবাকে মুনাফার আখড়ায় পরিণত করলে কী পরিণতি হতে পারে, আমেরিকা তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। আসলে মার্কিন স্বাস্থ্যব্যবস্থা এই মহামারীর জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিল না। মার্কিন মুলুকের স্ট্যাচু অব লিবার্টি, শাহরুখের হেঁটে যাওয়া ব্রুকলিন, আলো ঝলমলে টাইম স্কোয়ার, দুরন্ত সিলিকন ভ্যালি আজ থমথমে। গোটা বিশ্বের মতো আজ মার্কিন আকাশেও জমেছে কালো মেঘ। মৃত্যুর সংখ্যা প্রতিদিন বেড়ে চলেছে। ধসে পড়েছে অর্থনীতি। হোয়াইট হাউসের রোজ গার্ডেনে দাঁড়িয়ে ট্রাম্প তো বলেই ফেলেছেন, মৃতের সংখ্যা ১ লক্ষ থেকে ২ লক্ষের মধ্যে রাখতে পারলেই বুঝতে হবে তাঁর প্রশাসন ‘ভালো কাজ করেছে’। তাঁরই প্রশাসন, গত ১৮ মার্চে, মার্কিন কংগ্রেস যে বিল পাশ করেছে, তার আওতায় শুধু রয়েছে করোনা-পরীক্ষা। এতে নেই চিকিৎসার কোনও সরকারি দায়ভার। এর অর্থ, করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হলে গুনতে হবে বিপুল অঙ্কের অর্থ। সোজা কথায় অর্থ থাকলে চিকিৎসা, না থাকলে মৃতের তালিকায়।
শুনলে অবাক হবেন, এক দশকের বিনিয়োগহীন দেউলিয়া ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের ভার লাঘব করার জন্যে ব্রিটিশ সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, সব অসুস্থ লোককে পরীক্ষা না করার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ‘পরীক্ষা-পরীক্ষা-পরীক্ষা’ উপদেশ সত্ত্বেও ব্রিটেনে অসুস্থ হলে ১৪ দিন ঘরবন্দি থাকতে বলা হয়েছিল, পরীক্ষা ছাড়াই। প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন তাঁর প্রথম সাংবাদিক সম্মেলনে জানিয়েছিলেন, অনেকেই তাঁদের প্রিয়জন হারাবেন।
তবে কারও সর্বনাশ তো কারও পৌষ মাস! লক্ষ্য করুন, করোনা ভাইরাসের প্রকোপ বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে যাওয়ার পর গোটা দুনিয়ায় শেয়ার বাজারে কার্যত ধস নেমেছে। কিন্তু এই বিশ্বব্যাপী মহামারীর মধ্যে ওষুধ শিল্পের শেয়ারের দাম হু হু করে বাড়ছে। এই পড়তি বাজারে যেখানে অনেক বড় বড় কোম্পানি তলিয়ে যাচ্ছে, সেখানে ওষুধ কোম্পানির শেয়ার নিয়ে এত উল্লাসের কারণ কী? তাহলে কি এই বিশ্বব্যাপী সঙ্কট তাদের বিক্রয় ও মুনাফা বিপুল বাড়িয়ে তুলবে এবং মহামারী যত খারাপ দিকে যাবে তাদের মুনাফা বৃদ্ধির সুযোগ তত বেশি হবে? প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, ছয়ের দশক থেকে করোনা ভাইরাস গোত্রের সন্ধান পাওয়া গেলেও আজ পর্যন্ত কোনও প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়নি কেন? এমনকি সার্স বা মার্স থাবা বসানোর পরেও তারা এ ব্যাপারে চুপ করে বসেছিল কেন? কেন ছোঁয়াচে রোগের প্রতিরোধ নিয়ে গবেষণায় বড় বড় কর্পোরেট ফার্মা কোম্পানির কোনও আগ্রহ নেই? প্রশ্ন আছে, উত্তর নেই।
আসলে স্বাস্থ্য পরিষেবা নিয়ে বহুদিন ধরেই পৃথিবীজুড়ে যে ধরনের ছিনিমিনি খেলা চলছে, এই মহামারী তা জনসমক্ষে নগ্নভাবে ফাঁস করে দিয়েছে। সরকারি ব্যয় সঙ্কোচের অজুহাতে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে কর্মী সঙ্কোচন, ঠিকা কর্মী নিয়োগ, হাসপাতালগুলির শয্যাসংখ্যা কমানো, স্থানীয় ছোট ছোট স্বাস্থ্যকেন্দ্র বন্ধ করা, ওষুধের দাম ও স্বাস্থ্য পরিষেবার ব্যয় বৃদ্ধি, পরিকাঠামো ও চিকিৎসা সরঞ্জামে কম বিনিয়োগ, বড় বেসরকারি ওষুধ শিল্পের স্বার্থে চিকিৎসাশাস্ত্রের গবেষণা ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে সরকারি ক্ষেত্রের বিনিয়োগ দিনের পর দিন কমেছে। এক মহামারী চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, স্বাস্থ্যক্ষেত্রের মতো স্পর্শকাতর পরিষেবাকে বেসরকারি সংস্থার হাতে তুলে দিলে কী হয়! আমতা আমতা করে তা এখন স্বীকার করে নিচ্ছেন দুনিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী দেশগুলির রাষ্ট্রনেতারা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিভিন্ন দেশের যাঁরা এখন এই মহামারী নিয়ন্ত্রণে কাজ করছেন, তাঁরা সাধারণত যুদ্ধের কথা বলতেই ভালোবাসেন। তাঁরা রূপক অর্থে যুদ্ধকে ব্যবহার করেন না, আক্ষরিক অর্থেই যুদ্ধ করেন। আর যুদ্ধের কথাই যদি আসে, তবে আমেরিকার চেয়ে আর কে বেশি প্রস্তুত? এমন যদি হতো, এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সামনের সারির সেনাদের মাস্ক বা গ্লাভসের বদলে বন্দুক, স্মার্ট বোমা, বাঙ্কার বাস্টার, সাবমেরিন, ফাইটার জেট, পারমাণবিক বোমার প্রয়োজন হচ্ছে, তাহলে কি কোনও ঘাটতি থাকত?
কে না জানে, ২০১৭ সালে গোটা বিশ্ব সরাসরি সামরিক খাতে ব্যয় করেছে ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি ডলারের বেশি। এটা মোটা দাগের হিসেব। এর সঙ্গে আরও নানা হিসেব জুড়ে দিলে সেই অঙ্ক মাথা ঘুরিয়ে দেবে। সামরিক শক্তির সবচেয়ে বড় আস্ফালন দেখানো দেশ আমেরিকার দিকে তাকালেই বিষয়টি বোঝা যাবে। ২০১৮ সালে আমেরিকার সামরিক খাতের বাজেট ছিল ৬৩৯ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু এর সঙ্গে যখন অন্য অঙ্কগুলো যুক্ত হয়, তখন অন্য ক্ষেত্রের সঙ্কোচন ও এই ক্ষেত্রের প্রসারণ রীতিমতো চমকে দেয়। মার্কিন সাময়িকী সায়েন্সম্যাগ জানাচ্ছে, ওই একই বছর গবেষণা খাতে বরাদ্দ ছিল ১৫৫.৮ বিলিয়ন ডলার। এই বরাদ্দের পর ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন নিজেদের গবেষণাবান্ধব হিসেবে জাহির করতে শুরু করে। কারণ, আগের বছরের তুলনায় বরাদ্দ বেশ খানিকটা বাড়ানো হয়েছিল। কিন্তু এই গবেষণা বরাদ্দের মধ্যেই রয়েছে খেলাটা। সায়েন্সম্যাগই জানাচ্ছে, এই বরাদ্দের মধ্যে ৮২.৯ বিলিয়ন সামরিকক্ষেত্র সংশ্লিষ্ট গবেষণার জন্য বরাদ্দ। আর বাকিটা অসামরিক ক্ষেত্রে গবেষণায়। শুধু আমেরিকা নয়, প্রায় সব দেশের অবস্থা একই। এমনকী শান্তির সময়েও সামরিক ক্ষেত্রে বিনিয়োগ শুধু চলেই না, বাড়তেও থাকে। অস্ত্রের মজুত বাড়ানোকেই রাষ্ট্রগুলো নিরাপত্তা নিশ্চিতের একমাত্র পন্থা মনে করে। বন্দুক আর গোলাবারুদের পরিসংখ্যান তুলে ধরে, নানা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহড়া দিয়ে সাধারণ মানুষকে রাষ্ট্র দেখাতে তৎপর যে, ‘দেখো তোমাকে কতটা নিরাপদ করলাম’। সীমান্তে সীমান্তে বন্দুক উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে সবাইকে বোঝাতে চায় যে নিরাপত্তা মানেই বন্দুক, নিরাপত্তা মানেই নজরদারি। কিন্তু ‘নিরাপত্তা’র এই ব্যাখ্যা কতটা ভ্রান্ত, তা এবার দেখিয়ে দিল করোনা ভাইরাস। যাকে চোখে দেখা যায় না। ফলে অজস্র গোলাবারুদ মজুত রেখেও, সীমান্তগুলোয় অতন্দ্র প্রহরী বসিয়েও তাকে ঠেকানো যায়নি। মানুষ বুঝতে পারছে, নিরাপত্তার নামে কত ঠুনকো ব্যবস্থা তারা গড়ে তুলেছে।
রাতের পর রাত বিশ্বের বহু মানুষ নিউ ইয়র্কের গভর্নরের হতাশ বক্তব্য যে নিস্তব্ধতার সঙ্গে শুনছেন, তা ব্যাখ্যা করা মুশকিল। আমরা পরিসংখ্যানের কথা শুনছি। শুনছি রোগীর ভারে নুয়ে পড়া আমেরিকার সেই সব হাসপাতালের গল্প, যেখানে স্বল্প মজুরিতেই বাড়তি কাজ করে চলা নার্সরা ময়লা ফেলার পলিথিন বা রেনকোট দিয়ে মাস্ক তৈরি করছেন। আমরা শুনছি আমেরিকার অঙ্গরাজ্যগুলোর মধ্যে ভেন্টিলেটর নিয়ে চলা যুদ্ধের গল্প। শুনছি ভেন্টিলেটর কে পাবে, আর কে পাবে না—এ নিয়ে উভয়সঙ্কটে পড়া চিকিৎসকদের কথা। শুনছি দিশেহারা মার্কিন প্রেসিডেন্টের আবোল-তাবোল বকা। এমনকী, হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন নিয়ে ভারতকে হুমকিও। আর আমরা হঠাৎ চমকে উঠে বলছি, এটাই আমেরিকা? যাদের থেকে আমরা শিখি!
আমরা ভাবছি, হয়তো ইতিহাসের পৃষ্ঠায় কোনওদিন লেখা হবে, করোনা মহামারীর সময় আমেরিকার মতো দুনিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী, নিউক্লিয়ার পাওয়ার দেশগুলি জানিয়েছিল, তারা মাস্ক, ভেন্টিলেটারের অভাবে ভুগছে। কী ভয়ঙ্কর ভাবুন!