কর্মলাভের যোগ রয়েছে। ব্যবসায়ী যুক্ত হওয়া যেতে পারে। কর্মক্ষেত্রে সাফল্য আসবে। বুদ্ধিমত্তার জন্য প্রশংসা দুযবে। ... বিশদ
বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ভাববার সময় এখন নয়। মানব সভ্যতাকে রক্ষা করার এই লড়াইয়ে অর্থনীতির ভাবনা এই মুহূর্তে তুচ্ছ। যদিও আগামী সময়ের নিরিখে অর্থনীতির প্রভাবকেও উপেক্ষা করা যায় না। করোনার প্রভাবে বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যে সঙ্কটে পড়বে সেটা মানবসভ্যতা রক্ষার লড়াইয়ের আরেকটি পর্ব হিসাবে চিহ্নিত থাকবে।
বিপুল জনসংখ্যার প্রেক্ষিতে করোনার সংকট আলাদা মাত্রা পেয়েছে ভারতে। চেষ্টা করেও এর প্রভাব নির্দিষ্ট কয়েকটি রাজ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা সম্ভব হয়নি। প্রায় সারাদেশেই মানুষ আক্রান্ত, তেমনি লকডাউনের ফলে গোটা দেশই আর্থ-সামাজিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে। পরিস্থিতি ইউরোপ আমেরিকার মতো নয় ঠিকই, কিন্তু সংক্রমণ এবং মৃত্যু দুটোই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। তা এ এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। লকডাউন কতদিন চলবে কারও জানা নেই। রাজ্যগুলো স্বাস্থ্য পরিকাঠামো ও প্রয়োজনীয় সাজসরঞ্জাম বৃদ্ধির জন্য চার সপ্তাহ ধরে নানা উদ্যোগ নিয়েছে। কেন্দ্র ১.৭০ লক্ষ কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। বহু ধরনের ব্যয় হ্রাসের সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে সরকারকে। সাংসদ তহবিলে টাকা খরচ দু›বছরের জন্য বন্ধ রাখা, রাষ্ট্রপতি, উপরাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও রাজ্যপালদের বেতন ৩০% হ্রাস করার মতো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারও ২০০ কোটি টাকার তহবিল গড়েছে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে বেশ কয়েকটি প্রশ্ন উঠে আসছে:
ক) রাষ্ট্রের এসব উদ্যোগের পাশাপাশি নাগরিক হিসাবে আমরা নিজেদের দায়িত্ব ঠিক মতো পালন করছি তো?
খ) যদি দীর্ঘদিন লকডাউন থাকে তার জন্য দীর্ঘমেয়াদি কৌশল কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলি নিচ্ছে তো?
গ) কেবল প্রশাসনিক উদ্যোগের উপর নির্ভর করে দীর্ঘ লড়াই জারি রাখা বাস্তবে সম্ভব হবে কি?
ইতালি, স্পেন বা আমেরিকার মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে তা মোকাবিলা করা কেবল রাজ্য বা কেন্দ্রীয় প্রশাসনের পক্ষে মোটেই সম্ভব হবে না। দীর্ঘমেয়াদে নাগরিক জীবনের উদ্যমী মানুষ ও সামাজিক সংগঠনগুলিকে প্রস্তুত করা ও রাখার বিষয়টি নিয়ে পরবর্তী পর্যায়ে আলোচনায় আসা যাবে। এখন দেখা যাক, লকডাউন ঘোষণার পর সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার প্রশ্নে মূল সমস্যা কোথা থেকে উঠে আসছে এবং সমস্যা সমাধানের জন্য কী করা যেতে পারে।
অত্যাবশ্যকীয় পণ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে বাজারগুলিতে মানুষের ভিড় এড়ানো সম্ভব হচ্ছে না বিভিন্ন কারণে। সকালে ১০টা পর্যন্ত হাটবাজার খোলা থাকায় বিপুল সংখ্যক ক্রেতা একইসময়ে বাজারে জড়ো হওয়ায় এবং বিপদ এড়ানো কঠিনই হচ্ছে। বহুক্ষেত্রে ১ মিটার দূরত্ব বজায় রেখে হাটবাজার করার মতো অবস্থা নেই। এক্ষেত্রে প্রশাসন পুরনো বাজারগুলি সরিয়ে নিয়ে জেলাস্তরে বড় খেলার মাঠে চালু করার যে উদ্যোগ নিয়েছে তা অবশ্যই প্রশংসনীয়। কিন্তু কলকাতায় বড় জায়গার অভাব আছেই। বাজার স্থানান্তরের ক্ষেত্রে পার্ক ও খেলার মাঠগুলিকে ব্যবহার করা যায় কি না বাবা মেতে পারে। দিতীয়ত, একেকটি পাড়ার পরিবারগুলিকে বাজার বা দোকানে প্রবেশ করবার জন্য একেকটি নির্দিষ্ট দিন এবং সময় নির্ধারণ করে দিলে বাজারে একই সময় বহু সংখ্যক মানুষের ভিড় আটকানো সম্ভব। তৃতীয়ত, অনলাইন পরিষেবা শহরে এখনও সেভাবে পাওয়া যাচ্ছে না। অনলাইন পরিষেবার মাধ্যমেও বাজারে ভিড় আটকানোর উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।
এখনও পর্যন্ত কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারগুলি স্বল্প মেয়াদি পরিকল্পনার ভিত্তিতে পুলিস এবং সাধারণ প্রশাসনকে ব্যবহার করছে। বাংলায় মূলত পুলিশ প্রশাসনকে এই কাজে যুক্ত করা হয়েছে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার জন্য নাগরিকদের সচেতন করার উদ্যোগ যেমন পুলিস নিয়েছে তেমনি প্রস্তুত খাবার বিতরণের ক্ষেত্রেও তাদের ভূমিকাই মুখ্য। একইসঙ্গে হাসপাতলে রোগীকে পৌঁছে দেওয়া থেকে শুরু করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বও তাদের। পুলিস প্রশাসনের উপর এই অতি নির্ভরতা স্বল্পমেয়াদে সুফল দিলেও দীর্ঘমেয়াদে ব্যাপারটি কঠিন হয়ে উঠতে পারে।
বিপদ পরে ভয়ঙ্কর আকার নিলে সমাজের নানা স্তরের মতন পুলিস প্রশাসনও সেই প্রভাবের বাইরে থাকবে না। আশঙ্কাটি একইভাবে চিকিৎসার সঙ্গে যুক্ত ডাক্তার থেকে নার্স, প্যারামেডিকেল স্টাফ থেকে হাসপাতালের একজন ওয়ার্ডবয় সবার জন্যই প্রযোজ্য। অর্থাৎ বৃহত্তর বিপর্যয়ের কথা মাথায় রাখলে কেবল প্রশাসনিকভাবে করোনা বিপর্যয়ের মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। এখানেই প্রশ্ন আসবে বিকল্প কর্মিবাহিনী কোথা থেকে আসবে এবং কীভাবে তৈরি করা সম্ভব? সময় নষ্ট না-করে এখনই সংগঠিতভাবে বিভিন্ন পরিষেবা দেওয়ার জন্য স্বেচ্ছাসেবকদের আহ্বান করা হোক। যোগদানে ইচ্ছুক স্বেচ্ছাসেবকদের জন্য স্বল্পমেয়াদি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হোক এবং বড় বিপর্যয় এলে নির্দিষ্টভাবে কোন কাজ কাকে দেখতে হবে তা আগাম নির্ধারণ করে দেওয়া হোক। এই সমগ্র প্রক্রিয়াটিতে অবশ্যই অগ্রাধিকার পাবে মান্য স্বাস্থ্যবিধি। এমন হতেই পারে বড় বিপর্যয়ে একটি নির্দিষ্ট থানার বহু সংখ্যক পুলিস আধিকারিক ও কর্মী করোনায় আক্রান্ত হয়ে কাজের বাইরে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। এই অবস্থায় স্বল্প মেয়াদি প্রশিক্ষিত স্বেচ্ছাসেবকদের কিছু সময়ের জন্য থানার কাজে সহায়তা করার জন্য দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে। এভাবে সমাজের বিভিন্ন সেক্টরের কাজে প্রয়োজনে স্বেচ্ছাসেবকদের যাতে পাওয়া যায় তার প্রস্তুতি এবং প্রশিক্ষণের জন্য এটাই শেষ উপযুক্ত সময়।
গত ১৫ দিনের লকডাউনে সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়েছে অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের উপর। দিন আনা দিন খাওয়া মানুষগুলোর দুরবস্থা ক্রমশ বাড়ছে। পাশাপাশি, লকডাউন অনির্দিষ্টকাল চললে সংগঠিত এবং অসংগঠিত ক্ষেত্রের ছোট বড় সংস্থাগুলি তাদের শ্রমিকদের নিয়মিত মজুরি দিতে পারবে কি? এই অবস্থায় সারাদেশের রেশন ব্যবস্থাকে জোরদার করা ছাড়া উপায় নেই। এপর্যন্ত বাংলায় রেশন ডিলারদের মাধ্যমে চাল ও গম দেওয়া হচ্ছে। সমস্যা এক্ষেত্রেও। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা নিয়ে। বাড়ি বাড়ি রেশন পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ অনেক বেশি কার্যকরী হতে পারে। অসংগঠিত ক্ষেত্রের মানুষদের জন্য প্রথাগত রেশনের বাইরেও একটু ভাবার সুযোগ রয়েছে। চাল ডাল আটার সঙ্গে অন্যকিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যও যদি তাঁরা এই মুহূর্তে পান তবে রাষ্ট্রের পক্ষে এই সঙ্কট মোকাবিলা করা অনেক সহজ হবে।
দীর্ঘ লকডাউনে জীবিকার প্রশ্নে যে অনিশ্চয়তা অসংগঠিত ক্ষেত্রে থাকছে রেশনব্যবস্থা ঢেলে না-সাজলে সামাজিক উত্তেজনা তৈরি হওয়া অস্বাভাবিক নয়। এই প্রশ্নে রাষ্ট্রের যথাযথ দায়িত্বপালনের উপরেই নির্ভর করবে সামাজিক সুস্থিরতা এবং সামাজিক সুরক্ষা। একইসঙ্গে একথা বলা প্রয়োজন যে, এই মহাসঙ্কটে যে-কোনও গুজব যেমন নতুন বিপদ ডেকে আনতে পারে তেমনি নির্ভুল তথ্যের প্রবাহ অব্যাহত না-থাকলে সেটাও বড় বিপদ সৃষ্টি করতে পারে। এই প্রসঙ্গে বিগত শতাব্দীর ৬০ এবং ৭০ দশকে চীন এবং ভারতের দুর্ভিক্ষের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। অর্থনৈতিকভাবে ভারত চীনের থেকে দুর্বল হলেও ভারতে দুর্ভিক্ষের সময় চীনের মতো লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়নি। কারণ, ভারত একটি উদার গণতান্ত্রিক দেশ হওয়ায় স্বাধীন সংবাদ প্রবাহের ফলে কোনও এক অঞ্চলের দুর্ভিক্ষের খবর দ্রুততার সঙ্গে অন্য অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল। ফলে বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সাহায্য অল্প সময়ের মধ্যে দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের কাছে পৌঁছেছিল। অন্যদিকে চীনে কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থা থাকায় সরকার দুর্ভিক্ষের খবর চেপে যাওয়ায় অন্য অঞ্চলের মানুষ দুর্ভিক্ষ সম্পর্কে অবহিত হতে পারতেন না। ফলে, বহু মানুষ সাহায্যের হাত বাড়াতে পারতেন না সুযোগ থাকা সত্ত্বেও। তাই চীনে দুর্ভিক্ষ এবং মৃত্যু, দুটিই ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিল। সুতরাং মুক্ত তথ্যপ্রবাহ সঙ্কট মোকাবিলার প্রাথমিক ও গুরুত্বপূর্ণ শর্ত।
লেখক রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক