পুরনো রোগ চাগাড় দেওয়ায় দেহকষ্ট ভোগ করতে হতে পারে। তীর্থ ভ্রমণ ও ধর্মকর্মে আত্মিক তৃপ্তিলাভ। ... বিশদ
বিশ্বত্রাস জঙ্গি সংগঠনের এই বার্তা কারও কারও কাছে তাদের ‘আর্তনাদ’ বলে মনে হয়েছিল। তাঁরা ভেবে নিয়েছিলেন, যাক বাবা, জঙ্গিদের উৎপাত থেকে অন্তত কিছুদিনের জন্য হলেও রেহাই মিলল। এবার সন্ত্রাসবাদীরাও গোপালের মতো অতি সুবোধ বালক হয়ে যাবে!
সেটা কতটা কষ্টকল্পনা ছিল তা বুঝিয়ে দিতে তারা সময় নিয়েছিল মাত্র ন’দিন।
গত ২৫ মার্চ আফগানিস্তানের রাজধানী শহর কাবুলের এক শিখ গুরুদ্বারে ভয়াবহ জঙ্গি হামলা হয়। তাতে ২৭ জন নিরীহ পুণ্যার্থীর প্রাণ গিয়েছে। গুরুদ্বারে সংঘটিত ওই নৃশংসতা যে মুসলিম জঙ্গি সংগঠন আইএসকেপি-কে শিখণ্ডী করে পাকিস্তানের পরিকল্পিত অপরাধ, তা দ্রুত ফাঁসও হয়ে গিয়েছে। সংগঠনটির পুরো নাম ইসলামিক স্টেট ইন খোরাসন প্রোভিন্স, যা কুখ্যাত আইসিস-এর আফগান শাখা।
ঘটনাটি নিঃসন্দেহে বিরাট। এর ভিতরে ভবিষ্যতের জন্যও চরম অশুভ বার্তা রয়েছে, বিশেষ করে ভারতের জন্য। তবু ঘটনাটি ভারতবাসীরও নজর এড়িয়ে গিয়েছে। কারণ করোনা নিয়েই সবার ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা। প্রথম চিন্তা প্রাণ ও স্বাস্থ্য। তারপরের চিন্তা দু’বেলা দু’মুঠো খাবার ব্যবস্থা করা। আপৎকালীন অর্থ ও খাদ্য ভাণ্ডার ঘুচিয়ে সে না-হয় আপাতত হল। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদেও যে অর্থনৈতিক বিপর্যের সঙ্কেত! অতএব আর কিছু ভাবার, অন্যদিকে তাকাবার ফুরসত নেই কারও।
সন্ত্রাসী-অপরাধ ঘটানোই যাদের ব্যবসা, তারা তো হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারে না। কাবুলের ঘটনা সেই সাক্ষ্যই দেয়। বুঝিয়ে দেয়—দু’হাতে মুনাফা লুটে নেওয়ার এ এক বিরাট মওকা। অতি বড় শক্তিশালী রাষ্ট্রও এখন বেসামাল। অভ্যন্তরীণ এবং সীমান্ত—কোনও নিরাপত্তাই এই ক্রান্তিকালে যথাযথ গুরুত্ব পাবে না। তাদের এই আন্দাজ যে ভুল নয়, কাবুলের ঘটনায় তা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে।
এ না-হয় বহির্ভারতের মাটির কথা গেল। ভারতের মাটিকে কি তারা রেয়াত করছে?
২ মার্চ গভীর রাতে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী জম্মু ও কাশ্মীরের দু’টি জায়গায় হানা দিয়ে লস্কর-ই-তোইবার চার জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করেছে। সরকারি সূত্রে খবর ছিল, কুপওয়ারার শালপোরা গ্রামে কিছু সশস্ত্র জঙ্গি জড়ো হয়েছে, নাশকতা ঘটাবে বলে। নিরাপত্তা বাহিনী সেইমতো হানা দিয়ে দু’জনকে ধরে। একই দিনে বারামুলার সোপোরে হানা দিয়ে ধরে আরও দুই জঙ্গিকে। ধৃতদের হেপাজত থেকে একাধিক আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। গ্রেপ্তার হয়েছে তাদের পাঁচ সাগরেদও।
করোনায় ‘ভীত’ জঙ্গিরা কি এবার কাবু হল তবে?
জবাব মিলল ৪৮ ঘণ্টার ভিতরে। পুলিসের কাছে খবর ছিল, জম্মু ও কাশ্মীরে কুলগাঁও জেলার এক গ্রামে কয়েকজন জঙ্গি ঢুকেছে। ৪ এপ্রিল নিরাপত্তা বাহিনী চিরুনি তল্লাশি চালায়। অমনি চ্যালেঞ্জ জানায় জঙ্গিরা। সরকারি বাহিনীর জবাবি গুলিতে চার জঙ্গি নিহত হয়। অন্যদিকে, জঙ্গিদের হামলায় তিন গ্রামবাসীও শহিদ হন।
লক্ষ করার বিষয় এই যে, এর পরেও কিন্তু জঙ্গিদের তৎপরতায় বিরামচিহ্ন নেই। শনিবার চার জঙ্গি নিকেশ করার ঘটনা নিয়ে কাশ্মীর উপত্যকা ভীষণ উত্তপ্ত ছিল। ফলে, নিয়ন্ত্রণরেখা এবং উপত্যকাজুড়ে বিশেষভাবে সতর্ক ছিল ভারত। কিন্তু প্রতিকূল আবহাওয়ার সুযোগে ৫ এপ্রিল ভোরে একদল জঙ্গি কেরান সেক্টর দিয়ে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করে। সেনা রুখে দাঁড়াতেই শুরু হয় দু’পক্ষে তুমুল গুলি বিনিময়। তাতে জঙ্গিদের অনুপ্রবেশের অপচেষ্টা ব্যর্থ হয় এবং পাঁচ জঙ্গিও নিকেশ হয়। মাত্র ২৪ ঘণ্টায় মোট ৯ জঙ্গিকে খতম করার পর উপত্যকায় জঙ্গিদমন অভিযানে বাড়তি গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।
পরের পর ঘটনা এটাই খোলসা করে যে, করোনা নিয়ে পৃথিবী রসাতলে গেলেও সন্ত্রাসবাদীদের কোনও হেলদোল নেই। তারা বরং ভোঁতা অস্ত্রে নতুন করে শান দিতে লেগেছে। কিছু ক্লোজড চ্যাপ্টারও নতুন করে খুলবার বাড়তি উদ্যম পাচ্ছে তারা। এই নষ্টামির পিছনে কারা, তাও খোলসা হচ্ছে ইমরান খানের সাম্প্রতিক কিছু উস্কানিমূলক কথাবার্তায়। ৩৭০ ধারা বাতিল থেকে সিএএ, ডমিসাইল পলিসি প্রভৃতি ভারতের নিজস্ব বিষয়গুলিতেও তাঁর নাকগলানোর অভ্যাস বেড়েই চলেছে। দিল্লি অবশ্য এর মুখতোড় জবাবও দিয়েছে দ্রুত, ‘‘জম্মু ও কাশ্মীরের সত্যিই ভালো চাইলে পাকিস্তানের উচিত মিথ্যা প্রচার, সন্ত্রাস এবং হিংসায় মদত বন্ধ করা।’’
কাশ্মীরে বিরামহীন ছায়াযুদ্ধ থেকে কাবুলের গুরুদ্বারে নৃশংস হামলার ঘটনা—বিশেষজ্ঞরা সবেতেই পাকিস্তানের তস্করসুলভ উপস্থিতি টের পাচ্ছেন। গুরুদ্বারে হামলার পর আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে এক জঙ্গিও নিহত হয়। ওই যুবক কেরলের বাসিন্দা। স্কুলছুট। বছর দুই আগে সংযুক্ত আরব আমিরশাহিতে গিয়েছিল। সেখানেই তাকে কব্জা করে আইএসকেপি। গোয়েন্দাদের কাছে খবর, গত চার বছরে কেরল এবং ভারতের আরও কয়েকটি জায়গা থেকে শতাধিক যুবক বিপথগামী হয়ে আইসিস-এ যোগ দেয়। তাদের ভাগ ভাগ করে আফগানিস্তান, সিরিয়া, ইরাক-সহ মধ্যপ্রাচ্যের নানা স্থানে কুকর্মে নিয়োগ করা হয়েছে। আইএসকেপি হল আইসিস-এরই নবীন শাখা, আফগানিস্তানের পূর্বাঞ্চল এবং উত্তর পাকিস্তানে এখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে।
২০১৯-এর সেপ্টম্বরে আফগান সরকারের নিরাপত্তা বাহিনী (এএনএসএফ) এক সফল ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশন’ চালায়। বলা বাহুল্য, জঙ্গিদমনের ওই রাফ অ্যান্ড টাফ অভিযানে বিশেষভাবে সাহায্য করেছিল মার্কিন বায়ুসেনাও। জঙ্গি খতম হয়েছিল জনা পঞ্চাশ! ৬০ জঙ্গি ঝাঁকের কইয়ের মতো ফিরে গিয়েছিল পাকিস্তানে। আড়াইশোর বেশি আইএসকেপি সদস্য বউ-বাচ্চা সমেত আত্মসমর্পণ করেছিল।
ওই ঘটনার মাস দুই পর প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি বড়াই করেছিলেন যে, তাঁর গর্বের নিরাপত্তা বাহিনী আইএসকেপি-কে ‘পরাস্ত’ করেছে। গুরুদ্বারে সফল হামলা করে তারা বুঝিয়ে দিয়েছে যে, রক্তবীজের ঝাড় কখনও শুকোয় না, ধ্বংস হওয়া তো দূর কি বাত! গত ২৯ ফেব্রুয়ারি মার্কিন-তালিবান একটি শান্তিচুক্তি হয়। উদ্দেশ্য, আফগানিস্তানের মাটিতে ১৮ বছরের রক্তক্ষয়ী অশান্তিতে ‘পূর্ণচ্ছেদ’ টানা। গুরুদ্বারের ঘটনা এটাও বোঝাল যে, ‘শান্তি’ শব্দটি তাদের অভিধানে নেই। তাদের আস্থা শুধুমাত্র তালিবান ও আল-কায়দার কট্টর নীতিতে।
ভারতের বিরুদ্ধে ছায়াযুদ্ধে পাকিস্তানের নতুন তাজা হাতিয়ারের নাম আইএসকেপি। ভারতের পরিবর্তিত কাশ্মীর-নীতির সঙ্গে আফগান-নীতিটাও ঘেঁঁটে দিতে পাক সেনা এবং আইএসআই এটাকেই উষ্ণ আলিঙ্গনে বাঁধতে চাইছে। ৪ এপ্রিল সেটা আরও বেআব্রু হয়েছে। কাবুলের গুরুদ্বারে নৃশংসতার ‹মস্তিষ্ক› মৌলবি আব্দুল্লা ওরফে আসলাম ফারুকিকে আফগান নিরাপত্তা বাহিনী বিশেষ অপারেশনে গ্রেপ্তার করেছে। জানা যাচ্ছে, এই পাক নাগরিক ২০১৯-এ আইএসকেপি-র আমির (চিফ) হয়। আইএসআই-এর হাতের পুতুল ফারুকি তার আগে লস্কর-ই-তোইবা এবং তেহরিক-ই-তালিবানের খিদমত করত। কাবুল ও দিল্লির বিশেষজ্ঞদের মতে, হাক্কানি নেটওয়ার্ক ও লস্করের নির্দেশে ফারুকিই গুরুদ্বারে হামলাটি করিয়েছে। তার পরবর্তী লক্ষ্য ছিল ভারতীয় দূতাবাস। ভারতের অপরাধ? বিধ্বস্ত আফগানিস্তানের পুনর্গঠনে বিরাট ভূমিকা পালন করছে। এটা বানচাল করাই তালিবান ও পাকিস্তানের কমন অ্যাজেন্ডা।
সোজা কথাটি হল, প্রতিবেশীর নাম যতক্ষণ দেউলিয়া পাকিস্তান, ততক্ষণ দেশের সুরক্ষার প্রশ্নে এতটুকুও ‘পজ’ নেওয়ার সুযোগ নেই ভারতের। সে করোনার মতো ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মুখোমুখি হলেও না। অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার যাবতীয় ব্যবস্থা অটুট রাখতেই হবে। পাশাপাশি বাড়িয়ে যেতে হবে সংশ্লিষ্ট মিত্রদেশগুলির সঙ্গেও কূটনৈতিক বোঝাপড়া।