পুরনো রোগ চাগাড় দেওয়ায় দেহকষ্ট ভোগ করতে হতে পারে। তীর্থ ভ্রমণ ও ধর্মকর্মে আত্মিক তৃপ্তিলাভ। ... বিশদ
১৯৮০ সালে আরএসএস বুঝেছিল, তাদের নিজেদের একটি রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম দরকার। জনতা দলের সঙ্গে জোট বেঁধে থাকলে লক্ষ্যে পৌঁছনো সম্ভব হবে না। পৃথক দল দরকার। সেই লক্ষ্যে ১৯৮০ সালের ৫ এবং ৬ এপ্রিল নয়াদিল্লিতে বসেছিল সভা। সেখানে ৬ তারিখে গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জন্ম নেয় ভারতীয় জনতা পার্টি। দলের প্রথম সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন অটলবিহারী বাজপেয়ি। এছাড়াও নরেন্দ্র মোদি আরও একটি পরীক্ষা করে নিলেন। দেশজুড়ে বিজেপির যে হিন্দু ভোটব্যাঙ্ক, তা কতটা অটুট রয়েছে, সেটাও দেখে নিলেন। নতুন করে আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে নিলেন। কয়েক মাস আগে বিভিন্ন রাজ্যের নির্বাচনে একে একে মোদি-অমিত শাহের রথ মুখ থুবড়ে পড়ছিল। সেই ছেঁড়া-ফাটা আত্মবিশ্বাসটাকে আবার তিনি ফিরিয়ে আনলেন।
সে যাই হোক, কিন্তু উচ্ছ্বাসটা প্রদীপ জ্বালানোতে সীমাবদ্ধ থাকলে ঠিক থাকত। সেটা থাকল না। সেটা যে থাকবে না, তা আগেই জানা ছিল। সেই প্রমাণ আমরা পেয়েছিলাম জনতা কার্ফুর দিন বিকেল পাঁচটায় থালা বাটি বাজানোর নমুনা দেখে। পাড়ায় পাড়ায় প্রায় সবাই সেদিন জাতীয় পতাকা হাতে রাস্তায় নেমে এসেছিলেন। কণ্ঠে স্লোগান, ভারতমাতা কী জয়। আমরা ১৯৮৩ সালে সেই ছবি দেখেছিলাম। ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে ভারত বিশ্বকাপ জয় করেছিল। মানুষ এভাবেই আনন্দে মেতে উঠেছিল। আমরা কি তবে লড়াইয়ের আগেই করোনা কাপ জিতে গেলাম?
বাস্তব পরিস্থিতি হল, আমরা এখনও কিন্তু জয়ের কোনও দিশাই খুঁজে পাচ্ছি না। এখনও সামনে অনেক প্রতিবন্ধকতা। আগামী ১৫-২০ দিন আমাদের দেশের সামনে মস্ত বড় চ্যালেঞ্জ। এই বাধাটুকু পেরিয়ে যেতে পারলে কিছুটা স্বস্তির বাতাবরণ মিলবে বলে আশা করা হচ্ছে। ইতালি, ফ্রান্স, স্পেন, আমেরিকা দাঁতে দাঁত টিপে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। এখনও বিশ্বজুড়ে করোনা তাণ্ডব চলছেই। এ যেন এক নাগরদোলার মতো। মৃত্যুর উত্তাল তরঙ্গ। কোথাও উঠছে, কোথাও নামছে। আমরা জানি না কোথায় এর শেষ। কতজনের প্রাণ নেওয়ার পর থামবে দানবের এই মৃত্যু নিয়ে পাশা খেলা। বিদেশের দিকে তাকিয়ে দেখুন, যারাই প্রাথমিক পর্যায়ে এর বিরুদ্ধে কোমর বেঁধে নামার ব্যাপারে অনীহা দেখিয়েছিল, তাদেরই আজ মৃত্যু দিয়ে প্রমাণ করতে হচ্ছে, কত বড় ভুল তারা করেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পার্ল হারবারে বোমাবর্ষণ এবং ৯/১১-র আক্রমণ, এই দুটোই এতদিন মার্কিন ইতিহাসের সব থেকে বিধ্বংসী ঘটনা ছিল। ১৯৪১ এর ৭ ডিসেম্বর পার্ল হারবারে জাপানি বোমাবর্ষণের ঘটনায় প্রায় আড়াই হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। আর ২০০১ এর ১১ সেপ্টেম্বর জঙ্গিহানায় প্রাণ গিয়েছিল প্রায় তিন হাজার জনের। সেসব মৃত্যুকে ম্লান করে ইতিমধ্যেই রেকর্ড গড়েছে এই করোনা আক্রমণ। আমেরিকায় মৃত্যুসংখ্যা ১০ হাজার ছাড়িয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ওটা হয়তো দুই লক্ষে গিয়ে থামবে। কী ভয়ঙ্কর এই ভবিষ্যদ্বাণী। ইতালি, ফ্রান্স, স্পেন, আমেরিকা বলেই দিয়েছে, এখন ঈশ্বরই তোমার একমাত্র ভরসা। বাঁচালে তিনিই বাঁচাবেন। সেখানে অসংখ্য মানুষের হাতে এখন বাইবেল। কেউ জানে না, তাদের আয়ু আর কতটুকু। ডাক্তাররা চিকিৎসা করতে করতে ক্লান্ত। তারাও একে একে আক্রান্ত হচ্ছেন। কে করবে চিকিৎসা?
অন্য দেশের এই সব চিত্র আমাদের বুকে কিন্তু একটু একটু করে কাঁপন ধরাচ্ছে। আতঙ্কিত হওয়ার নিশ্চয়ই কারণ নেই। তবে সতর্কতা তো দরকার। একদিন নিশ্চয়ই এই করোনার আক্রমণ দূর হয়ে যাবে। পৃথিবী করোনামুক্ত হবে। সেদিন কি তবে পৃথিবীটা সুন্দর হয়ে উঠবে? আমরা এখন সেই রঙিন দিনগুলোর স্বপ্ন দেখছি। কিন্তু একটা কথা আমাদের মনে রাখা দরকার, করোনার এই কামড়ের রেশ কিন্তু অনেকদিন থাকবে। করোনা কীট মরবে। কিন্তু ঘা শুকোবে না। আরও এক অজানা ভয়ঙ্কর অন্ধকার আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। সব থেকে বড় আঘাত আসবে আমাদের দেশের অর্থনীতির উপর। শুধু আমাদের দেশ নয়, সারা বিশ্বে অর্থনীতির মন্দার একটা হিম স্রোত বয়ে যাবে। দলে দলে মানুষ কাজ হারাবে। শিল্পে, বাণিজ্যে নেমে আসবে খরা। বাজারে পণ্যের জোগান থাকলেও কেনার লোক থাকবে না। কেননা, মানুষের হাতে পয়সা থাকবে না। কমে যাবে তার ক্রয় ক্ষমতা। আমরা জানি না সমাজ তখন কোনদিকে এগবে। সমাজবিজ্ঞানীরা সেই সময়ের ভয়ঙ্কর ছবিটা নিশ্চয়ই আঁচ করতে পারছেন। কেমন হবে মানুষের মনের গঠন, কেমন হবে তার আচরণ! আর শিশুরা! তাদের আচরণ, প্রকৃতি কি বদলে যাবে না? কয়েকজন মনোবিদের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে, আগামীদিনের শিশুরা ততটা কোমল স্বভাবের নাও থাকতে পারে। সার্বিকভাবে পরিস্থিতি আমাদের ঠেলে নিয়ে যাবে মননের অন্য এক অস্থির অবস্থানে।
তাই এখন বাজি, পটকা, মোমবাতির সময় নয়, দরকার আরও কড়া হাতে রাশ নিয়ন্ত্রণ করা। করোনা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আরও কড়া পদক্ষেপ দরকার। দেশের মানুষকে এখন জোর করে ঘরে আটকে রাখা দরকার। প্রয়োজনে আইন এনে আটকাতে হবে। না হলে দেশকে আটকানো যাবে না। আমাদের দেশ ঘনবসতিপূর্ণ। একবার ছড়ালে আর নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। বিশ্বজুড়ে যে ছবিটা আমরা দেখছি, তাতে শিয়রে কিন্তু শমন। একটু শৃঙ্খলার অভাব হলেই করোনা কিন্তু আমাদের দেশে ঝড়ের বেগে ছড়িয়ে পড়তে পারে। আমরা এখন থার্ড স্টেজের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আছি। এই সময়ে দেশবাসীর এমন শিশুসুলভ উন্মাদনা মোটেই শোভা পায় না। পরিস্থিতি বিচার করে দেখলে বোঝা যায়, একমাত্র অজ্ঞতা, তাচ্ছিল্য মনোভাবই এই রোগের ছড়িয়ে পড়ার কারণ। আমরা মানসিকভাবে প্রস্তুত। প্রধানমন্ত্রীকে আরও কঠোর হাতে এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হবে। দেশের সবকিছু তাঁরই হাতে। তাই সবকিছু সুরক্ষিত রাখার দায়ও তাঁরই। তিনি রামমন্দির বানান বা রামচন্দ্রের পাঁচ হাজার ফুট উঁচু মূর্তি, কারও কিছু বলার নেই। কেননা ক্ষমতা তাঁরই হাতে। তবে এখন কোনও শৈথিল্য ভাব এলেই কিন্তু দিকে দিকে ‘রাম নাম সত্য হ্যায়’ শুরু হয়ে যাবে। রামের পুজো করতে গিয়ে আমরা যেন কুম্ভকর্ণ হয়ে না উঠি।
আমরা জানি, করোনা কোনও শত্রু দেশ নয়। শুধু হুঙ্কারে সে ভয় পাবে না। কৌশলে তাকে মারতে হবে। এখন তাই যুদ্ধপ্রস্তুতি, সঙ্কল্প অনেক বড়। মানুষকে বাঁচাতে হবে। প্রতিটি রাজ্যকে কেন্দ্রের সঙ্গে হাত মিলিয়ে লড়াইয়ে শামিল হতে হবে। সেইসঙ্গে দেশের প্রত্যেকে সচেতন হোক। আগামী দু’তিন বছর ধরে কিন্তু চলবে এই লড়াই। এ আমাদের দীর্ঘ এক ব্যথার পূজা। আপন ঘরে থেকে নিভৃতে প্রদীপ জ্বালিয়ে এখন আমাদের পূজার সময়। তাড়াতাড়ি তার সমাপন হবে না। লড়াই আর পূজা আজ একসঙ্গে হাত ধরাধরি করে গিয়ে চলুক জগতের আনন্দযজ্ঞের দিকে।