কর্মলাভের যোগ রয়েছে। ব্যবসায়ী যুক্ত হওয়া যেতে পারে। কর্মক্ষেত্রে সাফল্য আসবে। বুদ্ধিমত্তার জন্য প্রশংসা দুযবে। ... বিশদ
কতটা কঠিন? বিশ্ব ব্যাঙ্কের প্রাক্তন প্রধান নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্টিগলিটজ তার ব্যাখ্যা করেছেন খুব সুন্দর। ২০০৮ সালে মার্কিন মন্দার পর বিশ্ব অর্থনীতি যখন মুখ থুবড়ে পড়ে, তখন রাষ্ট্র সংঘের গড়া স্টিগলিটজ কমিশন রিপোর্টে তিনি লিখেছিলেন, খুব বড় কোনও সঙ্কটের সঙ্গে লড়াই করবার ক্ষমতা উন্নয়নশীল দেশগুলোর মানুষের হাতে থাকে না। কারণ আর্থিক ও সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থার অভাবে এরা এমনিতেই কোণঠাসা অবস্থায় থাকে। একই অবস্থা সরকারের। রাজস্ব আয় ক্রমশ কমতে থাকে, দেশ চালানোর খরচটুকু যথেষ্ট থাকে না, সেখানে আর্থিক ও রাজস্ব ঘাটতি মিটিয়ে উন্নয়নের খরচ জোগান ও কঠিন সমস্যা হয়ে ওঠে। হঠাৎ কোনও বিশ্বসঙ্কটের মুখে মূলধনের অভাব পড়ে গেলে, ঘুরে দাঁড়াবার পথ খুঁজে পাওয়া সহজ কাজ নয়। এই মূলধন মানে শুধুই আর্থিক লগ্নি করার মতো পুঁজি নয়। প্রাকৃতিক ও শিল্প রসদের অভাবটা বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। যে-দেশ থেকে সেগুলো আসার কথা, বিশ্বমন্দা হেতু তার জোগানে ঘাটতি থাকায় দেশের উন্নয়নের জন্য চাহিদা থাকলেও উৎপাদন করার উপায় থাকে না।
ঠিক এই অবস্থা এখন ভারতীয় অর্থনীতির। করোনার জন্য নানা দেশের লকডাউন বিশ্ব অর্থনীতির জোগানের চেইন ছিন্ন করে দিয়েছে। আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার বিশ্বমন্দা ঘোষণার পর স্টিগলিটজ গত পরশু বলেন, এবারের সমস্যাটা আরও জটিল এবং কঠিন। কারণ সঙ্কটের কারণ যে করোনা তার সমাধান আগে জরুরি, কিন্তু তার পূর্ণ সমাধান পেতে পেতে সেপ্টেম্বর মাস! অর্থাৎ, কমপক্ষে ছয় মাসের ব্যাপার। তারপর বিশ্ব অর্থনীতির সাপ্লাই-সাইড মেরামত হবে। তার আগে ঘুরে দাঁড়ানোর কোনও উপায় নেই।
হ্যাঁ। এটা ঠিক। এই অর্থনৈতিক সঙ্কট থেকে বেরিয়ে আসতে মার্কিন ও ইউরোপীয় অর্থনীতির জন্য যতটা সময় লাগবে, চীন বা ভারতের জন্য তা লাগার কথা নয়। এর আগে ২০০৮ সালের মন্দার পরেও তাই দেখা গিয়েছিল। লকডাউন তোলার পরেই গত দু'সপ্তাহের মধ্যে চীন যেভাবে উৎপাদন বাড়িয়ে ফেলেছে তাতে চীনের সাপ্লাই সেন্টার দ্রুত ছন্দে ফিরছে। এর সুফল পড়বে বিশ্ব অর্থনীতিতে। ওষুধ, কেমিক্যাল, সার ইত্যাদি কিছু শিল্পের কাঁচামাল আসে চীন থেকে। করোনা লকডাউন ও বিশ্বমন্দা শুরু হওয়ায় দেশের শিল্পমহল সঙ্কটে। সিআইআই এবং ফিকি-র সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, দেশের বিভিন্ন কোম্পানির চাহিদা ৫০% কমে গিয়েছে। নগদ লেনদেন কমে গিয়েছে ৮০%। এতৎসত্ত্বেও মার্কিন বা ইউরোপের চাইতে ভারতের চিত্রটা তুলনামূলকভাবে ভালো। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পরে যথাযথ পদক্ষেপ করতে হবে সরকারকে।
ভারতীয় অর্থনীতির মূল শক্তির জায়গাটা হল দেশের অভ্যন্তরে বিপুল বড় একটা বাজার। ১৩০ কোটি মানুষের বাজার। এই বাজারে টাকার লেনদেন ঠিক থাকলে অর্থনীতির গতি বজায় রাখা যায়। এবার করোনা আতঙ্কে লকডাউনের পর সমস্যা হল, বিভিন্ন ক্ষেত্রে বহু লক্ষ কোটি টাকার উৎপাদিত বিক্রয়যোগ্য পণ্য আটকে যাওয়া। ইনভেন্টরি আটকে যাওয়ায় গাড়ি শিল্প, কিংবা রিয়াল এস্টেট এই কারণেই ঘুরে দাঁড়াতে সময় নেবে। এই পরিস্থিতিতে সরকারের উচিত হবে অভ্যন্তরীণ বাজারে চাহিদা বাড়ানোর জন্য কৃষি ও গ্রামোন্নয়নে জোর দেওয়া যাতে গ্রামীণ অর্থনীতির চাহিদাটা ঠিক থাকে। এজন্য জরুরি হল ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পটির সঙ্গে যুক্ত ৮ কোটি মানুষকে লকডাউন উঠে গেলেই কাজ দেওয়া। দরকার সরাসরি তাদের ব্যাঙ্কে টাকা জমা দেওয়া। একইসঙ্গে কৃষিক্ষেত্রে ভর্তুকি দিয়ে গ্রামীণ চাহিদা শক্তিশালী করা। তাহলে ভারতের ভোগ্যপণ্যের শিল্প চাঙ্গা হতে পারবে। আসলে এই সময়ে শিল্পকে চাঙ্গা করতে পুঁজিভিত্তিক উন্নয়নের বদলে বেশি নজর দিতে হবে গণমুখী পদক্ষেপের উপর। কারণ, এই কৌশলটা স্বল্পমেয়াদে অনেক বেশি কার্যকর হয়। উন্নয়নের লক্ষ্য করে তুলতে হবে আপামর দরিদ্র, স্বল্পবিত্ত, মধ্যবিত্ত আম জনতাকে।
করোনা লকডাউনের জন্য এদের মধ্যে কমপক্ষে ১৩ কোটি মানুষ কর্মহীন হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে। এর প্রভাবটা সরাসরি এসে পড়বে বাজারের উপর। হু হু করে কমে যাবে চাহিদা সমস্ত ক্ষেত্রে। তাই এই মানুষগুলো যাতে জীবিকাহারা না-হয় তার জন্য সরকারের উচিত অসংগঠিত ক্ষেত্র নিয়ে অবিলম্বে বড়সড় নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া।
সেটা কেমন হতে পারে? এমন ধরনের মহামারী, প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখে অর্থনীতির বিপন্নতা নিয়ে গবেষণা করে যে মার্কিন সংস্থা তার প্রধান জানাচ্ছেন, সমস্ত রকম সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির মাধ্যমে সরকারকেই ন্যূনতম একটি অর্থ এদেরকে দিতে হবে। ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে সরাসরি ট্রান্সফার করে দিতে হবে। তাহলে বেঁচে যাবে দেশের অভ্যন্তরীণ বাজার, সেই বাজারকে ভিত্তি করে চলা আরও ৪০ কোটি মানুষের জীবন। শুধুমাত্র কৃষি গ্রামোন্নয়ন ও অসংগঠিত ক্ষেত্রের সঙ্গে যুক্ত এদেশের ১০০ কোটি মানুষ। তাদের মুখে দুবেলা দুটো অন্ন দেওয়ার ব্যবস্থা করা সম্ভব। সরকার সেটাই করেছে প্রধানমন্ত্রী অন্নযোজনা প্রকল্পের মাধ্যমে। এবার পরিযায়ী শ্রমিকসহ সকল কর্মহারাদের জন্য ন্যূনতম আর্থিক সহায়তা চালু করুক। এই প্রকল্প বলে পরিবারপিছু ১০ হাজার টাকা কম করে আগামী ছ'মাস দেওয়ার ব্যবস্থা করুক। তাহলে আস্তে আস্তে ঘুরে দাঁড়ানোর লক্ষণ দেখা যেতে পারে দু'মাসের ভিতরেই। এর জন্য যদি সরকারকে খোলা বাজার থেকে ঋণ নিতে হয় সেটাও অনেক গ্রহণযোগ্য পথ। তাতে রাজস্ব ঘাটতির মুখোমুখি হতে হলেও আশঙ্কার কিছু নেই।
চলতি পরিস্থিতিতে রাজ্যগুলোর প্রাপ্য দ্রুত মিটিয়ে দিতে কেন্দ্র সাহায্য করুক। রাজ্যগুলোর জন্যে প্রয়োজনীয় ঋণ ও ওভার-ড্রাফট সীমা শিথিল করা হোক। তাতে বাজারে নগদের জোগান বাড়বে। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের বিধি ভেঙে ফেলে রাজ্যগুলিকে সাহায্য করা দরকার। এসবের ফলে মুদ্রাস্ফীতি বাড়বে। টাকার দাম এখনই তলানিতে। বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছে। এর মধ্যে একটাই আশার বাণী: বিশ্বের অর্থনীতি স্তব্ধ, তাই খনিজ তেলের দাম খুব কম গিয়েছে। ফলে বিদেশি মুদ্রা বাঁচবে। কিন্তু টাকার দাম না-বাড়লে তো আমদানি খরচ বাড়বেই। তাই সরকার ও রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সামনে বিরাট চ্যালেঞ্জ হল টাকার দাম কমতে না-দেওয়া। তবে রপ্তানি কমে যাবে বলে মনে হয় না। বরং ভারতীয় পণ্য রপ্তানির বাজারটা অনেক উজ্জ্বল হয়ে দেখা দিচ্ছে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে। এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করার জন্য ভারত সরকারকে রপ্তানি ভর্তুকি বাড়াতে হবে। আর প্রয়োজন বিভিন্ন দেশের সঙ্গে নতুন অনুকূল বাণিজ্য চুক্তি করা। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অংশীদার হতে পারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন।
মোদি-ট্রাম্প দু'জনের কেউই কাউকে বাণিজ্য সুবিধা দিতে একটুও বেশি জায়গা ছাড়তে চান না। তবে, ইতিমধ্যেই ২০০-র বেশি মার্কিন কোম্পানি চীন ছেড়ে ভারতে এসে ব্যবসা করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। সেক্ষেত্রে তাদের মতো শ্রমসংস্কার প্রয়োজন। সস্তার দক্ষ শ্রম এখানেও জরুরি। ভারতে সেটা সহজলভ্য। তাই করোনা-পরবর্তী সময়ে আন্তর্জাতিক পুঁজি কতটা ভারতে আসবে সেটা নির্ভর করবে তাদের শর্ত পূরণে এদেশের সরকার কতটা আগ্রহী ও সচেষ্ট। সরকার এখনও এক্ষেত্রে খুবই অসফল। আগ্রহী বিদেশি কোম্পানিগুলোকে এদেশে আনতে পারেনি সরকার, ব্যর্থ মেক ইন ইন্ডিয়া। উৎপাদন শিল্পে বৃদ্ধি নেই বলে ক্রমশ পিছিয়ে যাচ্ছে ভারতের সম্ভাবনা।
বিদেশি লগ্নি আরও বেশি আকর্ষণ করবার জন্যে প্রয়োজন সংস্কার—শ্রম আইন, কর ব্যবস্থা। বহুজাতিক পুঁজির লগ্নি দরকার। চীন সেটা করতে পেরেছে বলেই ম্যানুফ্যাকচারিং সেক্টরে এতটা নিয়োগ সম্ভব হয়েছে। সেটা করবার জন্য চীনকে প্রথমে সস্তায় উৎপাদনে সক্ষম হয়ে উঠতে হয়েছে। দেশের সংগঠিত শ্রমশক্তি দিয়ে ওটা হয় না। বরং এদেশের বিপুল অসংগঠিত ক্ষেত্রেকে নিয়ে এবার সরকার ভাবুক।
লকডাউন পরবর্তী সময়ে সবচেয়ে বেশি নজর দিতে হবে বাজারে নগদ জোগানের উপর। কারণ, দীর্ঘ লকডাউনে স্তব্ধ সমস্ত প্রায় অথনৈতিক কর্মকাণ্ড। স্বাভাবিকভাবেই ব্যবসায়িক কাজ, আয় ও সঞ্চয় নেমে আসবে তলানিতে। এই সময়ে নগদ জোগানের অভাবে যাতে উৎপাদন ক্ষেত্রে কাজ বন্ধ না-হয় তার জন্য একটা তিন মাসের ক্যাশ ক্রেডিট ওভার ড্রাফট অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে সমস্ত ক্ষুদ্র সংস্থা, ছোট ও মাঝারি শিল্প সংস্থাকে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল বা চলমান পুঁজির একটি সহায়তা ভীষণ জরুরি। একইভাবে জরুরি যারা নতুন তাদের জন্য উৎপাদন শুল্ক কমিয়ে বাজার ধরতে সাহায্য করা। এই মর্মে কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশে সহজ শর্তে ঋণদানের বিষয়টি দেখা দরকার।
এমন সঙ্কটকে সম্ভাবনায় রূপ দিতে পারে একমাত্র দেশের রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ।সেই লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে পারে সরকারি ব্যাঙ্কগুলোর জনগণের মধ্যে রিটেল লোন ছড়ানোর মধ্য দিয়ে। এখনও পর্যন্ত রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ও কেন্দ্রীয় সরকার যে সমস্ত ব্যবস্থা নিয়েছে তার প্রত্যেকটি অত্যন্ত কার্যকর পদক্ষেপ। আশা করা যায়, সুফল আসবে। তবে, সব ক'টি কেবলমাত্র শিল্পমহলের দিকে তাকিয়ে, দেশের সার্বিক উন্নয়নের দিকে তাকিয়ে সরকারকে সামগ্রিক অবস্থান নিতে হবে সকল শ্রেণীর মানুষের কাছে সুফল পৌঁছে দেওয়ার জন্য।
সবচাইতে বড় দরকার সব শ্রেণীর মানুষের হাতে উদ্বৃত্ত নগদ। নইলে বাজার তার শক্তি হারাবে। নোবেলজয়ী অভিজিৎ বন্দোপাধ্যায় সতর্ক করে বলেছেন, করোনা-পরবর্তী পর্বে সবচেয়ে বড় কাজ চাহিদা বাড়ানো। সেটা করা না-গেলে অর্থনীতিতে ধস নামবে। সমাজ অশান্ত হয়ে উঠবে। নগদ সঙ্কটে ভোগা একটি অর্থনীতিতে সব মিলিয়ে কমপক্ষে ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ধাক্কা। এর মধ্যেই অর্থনীতি সচল রাখতে হবে, নগদ জোগানের ব্যবস্থাও করতে হবে। নতুন করে পুঁজির বিনিয়োগ ও বিশেষ ছাড়—দুটোই দিতে হবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে। তার মধ্যে অ্যাভিয়েশন, হসপিটালিটি, ট্যুরিজম, রিয়েল এস্টেটে চাই সহায়তা চাই সবার আগে এবং সবার চেয়ে বেশি। করোনা লকডাউনে এগুলোই ধাক্কা খেল মারাত্মক। এর সঙ্গে যুক্ত কয়েক কোটি মানুষ, রাষ্ট্রের সাহায্য ছাড়া পুঁজি যে তার লগ্নি টিকিয়ে রাখতে পারে না সেটা বিশ্ব জুড়ে আবারও প্রমাণ হল করোনা আতঙ্কে। তাহলে কি ফিরে আসবে মানুষ কেইনসিয়ান অর্থনীতির উন্নয়ন মডেলে—রাষ্ট্রকে সামনে রেখে? বিশ্বায়নের অর্থনীতির মডেল উন্নয়নকে গণমুখী করতে ব্যর্থ। নানা চ্যালেঞ্জের মুখে উন্নয়নকে ধরে রাখতে পারছে না, এমনকী একচেটিয়া বিশ্বায়িত পুঁজির উন্নত দুনিয়াও। তাই ভারত বিকল্প উন্নয়নের পথ খুঁজে নিক নিজের মতো করেই।