বাধা ও অসফলতার জন্য চিন্তা। মানসিক টানাপোড়েনের মধ্যে কোনও ভালো যোগাযোগ পেতে পারেন। ... বিশদ
উয়েই গুইজিয়ান। ১০ ডিসেম্বর তাঁর প্রথম কাশি শুরু হয়। ঠান্ডা লাগা। তারপর জ্বর। ৫৭ বছরের ওই প্রৌঢ়ার চিংড়ির দোকান... হুয়ানান মার্কেটে। চীনের উহানে। তারিখটা ছিল ১০ ডিসেম্বর। সাধারণ ফ্লু ভেবেছিলেন গুইজিয়ান। ডাক্তারখানায় গেলে সেখানে ডাক্তার তাঁকে একটি ইঞ্জেকশন দেন। কাজ দেয়নি তাতে। প্রতি মুহূর্তে আরও বেশি দুর্বল হয়ে পড়ছিলেন তিনি। বাধ্য হয়ে ইলেভেন্থ হসপিটাল। আর তারপর উহান ইউনিয়ন হাসপাতাল। সেখানেই গুইজিয়ান জানতে পারেন, হুয়ানান মার্কেটে দোকান রয়েছে বা সেখানে কেনাকাটা করতে গিয়েছেন এমন অনেকেই আসছেন এই হাসপাতালে। উপসর্গ সবার এক এবং প্রাণঘাতী। মুশকিল একটাই, রোগটা অজানা। তারিখটা ছিল ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৯। আর উয়েই গুইজিয়ান করোনা ভাইরাসের পেশেন্ট জিরো।
সংখ্যাটা বাড়ছে। ঠিক যেভাবে ‘কন্টাজিয়ন’-এ দেখানো হয়েছিল... সেভাবেই। স্পর্শ থেকে, হাঁচি-কাশি থেকে, ব্যবহৃত বাসন থেকে। করোনা ভাইরাসের কোনও প্রতিষেধক নেই। প্রথাগত ফর্মুলায় চিকিৎসা চলছে। কেউ বাঁচছেন। কেউ না। আক্রান্ত হলে হাতে আর বেশি সময় থাকছে না। উপায় তাই একটাই। বাড়িতে থাকতে হবে। গৃহবন্দি হয়ে। সোশ্যাল মিডিয়ায় খুব চলছে, মারাত্মক ইগো এই ভাইরাসের। ডেকে না আনলে কিছুতেই ঘরে আসবে না। তাই গৃহবন্দিত্ব। পোশাকি বা সরকারি নাম ‘লকডাউন’। গত ২৪ মার্চ থেকে যা চালু হয়েছে দেশজুড়ে। আর পশ্চিমবঙ্গে ঠিক তার আগের দিন থেকে। লক্ষ্য, ভাইরাসের চেনটাকে ভেঙে দেওয়া। একটা থিওরি এক্ষেত্রে রয়েছে... সাতদিনে চেন ভাঙবে, আর এর মধ্যে যাঁরা আক্রান্ত হবেন, তাঁদের সেরে উঠতে সময় লাগবে ১৪ দিন। মানে, সব মিলিয়ে ২১ দিন। লকডাউনের হিসেবটাও সেভাবেই করা হয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন। কিন্তু তাতেও কি লাভের লাভ কিছু হচ্ছে? এর মধ্যেও লোকজন বাজার করছেন, আড্ডা দিচ্ছেন, চায়ের দোকানে ‘একটাকে দুটো’ করার অর্ডার দিচ্ছেন...। রোগও বাড়ছে পাল্লা দিয়ে। প্রথম দিনের রেকর্ড ভেঙে যাচ্ছে পরের দিন। আর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিত্যনতুন ভাবনায় চেষ্টা করছেন দেশকে ‘একসূত্রে বাঁধার’। লকডাউনের আগেও একটা ড্রেস রিহার্সাল দিয়েছিলেন ‘জনতা কার্ফু’র মাধ্যমে। মানুষ কিন্তু সাড়াও দিয়েছিল সেদিন। কিন্তু মাঝে বিকেল ৫টায় সবাইকে দরজায় বা বারান্দায় দাঁড়িয়ে থালা বাজাতে বলে গোটা দিনের যাবতীয় ‘পুণ্য সঞ্চয়ে’ জল ঢেলে দিয়েছিলেন তিনি। লকডাউনের উদ্দেশ্য যেখানে সামাজিক বা শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা, সেখানে ওই ২২ মার্চ বিকেল ৫টায় উৎসবের মেজাজে ঢাকঢোল পেটাতে বেরিয়ে পড়েছিলেন মানুষ। জনতা কার্ফুর উদ্দেশ্য সফল হয়েছিল তো?
একসূত্রে বাঁধার উদ্যোগ। সলিডারিটি। প্রধানমন্ত্রীর লক্ষ্য এটাই। গৃহবন্দি ভারতীয়দের বোঝাতে চাইছেন, বাড়িতে আছেন... তবে নিজেকে একলা ভেবে নেবেন না! ১৩০ কোটি ভারতীয় একে অপরের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এই মারণ ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। তাই লাইট নিভিয়ে ফেলুন। মোমবাতি, টর্চের লাইট যা খুশি জ্বালিয়ে অন্ধকার বারান্দায় দাঁড়িয়ে পড়ুন। প্রধানমন্ত্রীর এই ‘দীপ জ্বেলে যাই’ ভাবনা প্রসঙ্গে অবশ্য মারাত্মক সব তত্ত্ব বাজারে ঘোরাফেরা করছে। কেউ কেউ বলছিলেন, ১৩০ কোটি ভারতীয় একসঙ্গে একটি করে মোমবাতি জ্বালালে পরিবেশের তাপমাত্রা নয় ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যাবে। তাতে করোনা ভাইরাসের মৃত্যু হবে। আবার অনেকে খোঁচা দিচ্ছেন, লকডাউনের মধ্যে তো আর ৬ এপ্রিল ধুমধাম করে বিজেপির প্রতিষ্ঠা দিবস পালন করা যাবে না... তাই জনসাধারণকে দিয়েই ঠিক আগের দিন রাত ন’টায় পালন করিয়ে দেওয়া গেল। আর মানুষ তো শুধু দীপ জ্বেলেই থেমে থাকলেন না! দেদার ফাটল শব্দবাজি, উড়ল ফানুস। লোকজন রাস্তায় নেমে এলেন। একে অপরের সঙ্গে দাঁড়িয়ে আলো জ্বাললেন। অর্থাৎ সামাজিক দূরত্বের ‘আলোক সমাধি’ ঘটল আর কী! লকডাউন সফল হল তো?
নিন্দুকে বলে, তাঁর নাকি চওড়া কপাল। যখনই সরকার সঙ্কটে পড়ে, কোনও না কোনও উপায়ে তিনি নজরটা অন্যত্র ঘুরিয়ে দিতে পারেন। নোট বাতিলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গোটা দেশ যখন ফুঁসছে, তখনই উরি হামলা এবং তারপর সার্জিকাল স্ট্রাইক। জিএসটি এবং সরকারের আরও মিসঅ্যাডভেঞ্চারের চাকায় ভর করে যখন মোদি সরকার লোকসভা ভোটের দিকে দৌড়চ্ছে, ঠিক তখনই বালাকোট। আর এখন? গত এক বছর ধরে ধুঁকতে থাকা অর্থনীতির মধ্যেই করোনা দেখা দিল মহামারী রূপে। ভেঙে পড়া বাজার অর্থনীতি, উৎপাদনে ঘাটতি, আর্থিক বৃদ্ধির হার উদ্বেগজনকভাবে নেমে আসা... আজ কি এর কোনও একটা বিষয় নিয়ে আর আলোচনা হয়? না, হয় না। এখন চর্চার বিষয়বস্তু মানেই নতুন রোগ... নতুন আতঙ্ক। এদেশে করোনার প্রবেশ ঘটেছে গত ৩০ জানুয়ারি। দু’মাসের উপর হতে চলল, অথচ এমন জনঘনত্বের দেশে আক্রান্তের সংখ্যা কিন্তু সেই অর্থে হুড়মুড়িয়ে বাড়েনি! ‘ভারত’ সরকার তাই আবার মহান। ইতালি, স্পেনের মতো দেশে মৃতের সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়িয়েছে, মৃত্যুর নিরিখে পাঁচ অঙ্ক ছুঁতে চলেছে আমেরিকা। সেখানে দু’মাস পরও সংক্রমণ ৪ হাজারে ঠেকিয়ে রাখা সত্যিই তারিফ করার মতো ব্যাপার। প্রশংসায় অবশ্য ইতিমধ্যেই নরেন্দ্র মোদি ভাসছেন। আন্তর্জাতিক মহল, এমনকী বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পক্ষ থেকেও ভারতের এই সাফল্যকে কুর্নিশ জানানো হয়েছে। যার যা ভালো, তা তো স্বীকার করতেই হয়। হতেই পারে, এখনও ভারতে সেই অর্থে করোনার র্যান্ডাম টেস্ট করা হয়নি। অর্থাৎ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যে গাইডলাইন দিয়েছিল, সেই অনুযায়ী (প্রথমত, বাড়িতে থাকা এবং দ্বিতীয়ত, লাগাতার টেস্ট করে যাওয়া) সবকিছু মেনে চলা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। বেশি করে পরীক্ষা হলে করোনার সংখ্যাতত্ত্বে পরিবর্তন আসত কি না, সে ব্যাপারে প্রশ্ন উঠতেই পারে। তবে এই এতদিনে ভারত সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সংক্রমণের ক্লাস্টার বা সোজা ভাষায় বলতে গেলে যেখানে সংক্রমণ বেশি, সেই সব জায়গায় লাগাতার নমুনা পরীক্ষা হবে। সেটাও ১০০ শতাংশ সাফল্যের সঙ্গে সম্ভব হবে তো?
এই সেদিনও রাজধানী ও তার আশপাশের এলাকা ছিল লোকারণ্য। লকডাউন উপেক্ষা করে বাড়ি ফিরতে মরিয়া পরিযায়ী শ্রমিকরা। এঁরা প্রত্যেকেই অসংগঠিত সেক্টরের সদস্য। তাঁদের অনেকেই চাষের মরশুমে ধানজমিতে কাজ করেন, আবার মরশুম ফুরিয়ে গেলে চলে আসেন কোনও শহরে... নির্মাণকাজে জোগানদারের কাজ করতে। কেউ আবার রান্নায় পারদর্শী। যাঁর হাতের তন্দুরি চিকেন খেলে পাঁচতারা হোটেলের স্বাদ মনে পড়ে... আবার লকডাউনের সময় মালিক হোটেলছাড়া করলে ভিড়ে আর তাঁকে খুঁজে পাওয়া যায় না। কারণ, তাঁর হয়তো না আছে আধার, না ভোটার কার্ড। ২১ দিনের লকডাউন পিরিয়ড অসংগঠিত এই ক্ষেত্রটিকে ধূলিসাৎ করে দিয়েছে। বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকার কি এঁদের নিয়ে আলাদা করে কিছু ভেবেছে? হাততালি দিয়ে, বা প্রদীপ জ্বালিয়ে এই শ্রেণীর মানুষের পেট ভরবে না। আর দু’বেলা খেতে না পাওয়া ভারতীয়ের সংখ্যাই কিন্তু বেশি।
সংগঠিত ক্ষেত্রই কি খুব নিশ্চিন্তে রয়েছে? জাতির উদ্দেশে ভাষণে কর্পোরেট এবং অন্যান্য সংস্থাগুলির কাছে প্রধানমন্ত্রী আর্জি জানিয়েছিলেন, এই সঙ্কটে দয়া করে কর্মীদের বেতন কাটবেন না। কিন্তু সেই আবেদন বহু সংস্থাই রাখেনি। রাখা সম্ভব হচ্ছে না। উৎপাদন না হলে, বিক্রির সুযোগ না থাকলে কোনও কোম্পানিই কর্মীদের বসিয়ে খাওয়াবে না। এটাই ব্যবসার দস্তুর। প্রথমে বেতনে কাটছাঁট হবে। তারপর চাকরি যাবে। বিশ্বের সর্বত্র এই এক নিয়ম। কেউ দানছত্র খুলে বসেনি। এমন পরিস্থিতিতে নির্দিষ্ট কোনও পরিকল্পনার মাধ্যমে মানুষের পাশে দাঁড়ানোটাই দেশের সরকারের দায়িত্ব। কর্তব্য। আপাতত তেমন সুনির্দিষ্ট কিছুও সরকারের পক্ষ থেকে নজরে আসছে না। দক্ষিণ কলকাতার এক অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তি কথায় কথায় বলছিলেন, করোনায় না মরলে মানুষ এবার না খেতে পেয়ে মরবে। কোনও দেশের পক্ষে, সমাজের পক্ষে এটা ভালো বিজ্ঞাপন হতে পারে না। এই মুহূর্তে দেশ তথা বিশ্ব অর্থনীতির যা অবস্থা, তাতে ঘুরে দাঁড়াতে ঠিক কত সময় লাগবে, তা কেউ জানে না। দু’মাস লাগতে পারে, ছ’মাস বা এক বছর। আর লকডাউনের মেয়াদ যদি বাড়ে? অন্ধকারে হাতড়ানো ছাড়া উপায়ন্তর থাকবে না।
গত ২৮ জানুয়ারি কেরলে ফিরেছিলেন তরুণী। চীনের উহান বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। ৩০ জানুয়ারি তাঁর দেহে মিলেছিল করোনার অস্তিত্ব। তিনিই ভারতে করোনার ‘পেশেন্ট জিরো’। ফেব্রুয়ারি মাসের ২০ তারিখ হাসপাতাল থেকে মুক্তি পেয়েছেন তিনি। চাকা ঘুরছে। ঘড়ির কাঁটার উল্টোদিকে। ধীরে হলেও। আজ না হয় কাল পৃথিবী শান্ত হবেই। মেয়াদ ফুরোবে গ্যালারি শোয়েরও। তখন প্রশ্ন থাকবে একটাই... পেটের জ্বালা মিটবে কীভাবে?